দেশে দারিদ্র্য কমছে অসমভাবে: বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন


দারিদ্র্য নিরসনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও এখনও প্রতি চারজন মানুষের মধ্যে একজন দরিদ্র। দেশে দারিদ্র্যের হার ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ। এ হিসাবে প্রায় ৪ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। তবে এ হিসাব ২০১৬ সালের। ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ছয় বছরে দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে এসেছে ৮০ লাখ মানুষ।

ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি এবং শ্রম আয় বৃদ্ধির কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু দেশের সব অঞ্চলে দারিদ্র্য কমার হার সমান নয়। আর দারিদ্র্য কমার হার দিন দিন কমে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ পভার্টি অ্যাসেসমেন্ট : ফেচিং ওল্ড অ্যান্ড নিউ ফ্রন্টিয়ারস ইন পভার্টি রিডাকশনস’- শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সোমবার রাজধানীর একটি হোটেলে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।

বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডাইরেক্টর মার্সি মিয়াং টেম্বনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব বিকাশ কিশোর দাস এবং বিশ্বব্যাংকের পভার্টি অ্যান্ড ইক্যুইটি গ্লোবাল প্র্যাকটিসের গ্লোবাল ডাইরেক্টর ক্যারেনিনা সানসেজ প্রমো।

প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ মারিয়া ইউজেনিয়া জেননি। মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন পিপিআরসি’র নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান ও পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর।

মারিয়া ইউজেনিয়া জেননি জানান, জোরালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমাচ্ছে। তবে দারিদ্র্য কমছে তুলনামূলক কম গতিতে। ২০১০ সাল থেকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি বাড়লেও দারিদ্র্য বিমোচনের গতি কম। এছাড়া দারিদ্র্য সারাদেশে সমানভাবে কমছে না। ২০১০ সাল থেকে পূর্ব এবং পশ্চিমের বিভাগগুলোর মধ্যে দারিদ্র্য পরিস্থিতির ঐতিহাসিক পার্থক্য আবার ফিরে এসেছে। পশ্চিমে রংপুর বিভাগে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে।

এ বিভাগে দারিদ্র্য হার এখনও ৪৭ শতাংশ। রাজশাহী ও খুলনায় একই জায়গায় রয়েছে অর্থাৎ ২৮-২৯ শতাংশের মধ্যে। অন্যদিকে চট্টগ্রামে দারিদ্র্য কমেছে পরিমিতভাবে এবং বরিশাল, ঢাকা ও সিলেটে দ্রুত কমেছে। এসব বিভাগের কোথাও ১৬-১৮ শতাংশ এবং কোথায় ২১ থেকে ২৬ শতাংশের মধ্যে দারিদ্র্য হার রয়েছে।

তিনি বলেন, প্রথাগত বিভিন্ন চালিকাশক্তি দারিদ্র্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখছে। কিন্তু অগ্রগতি আনার ক্ষেত্রে কিছু চালকের ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়েছে। আগামী দশকের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্য অর্জনে অর্থনীতিতে দারিদ্র্য মোকাবেলায় আরও জোরালো উদ্যোগ থাকতে হবে। বাংলাদেশের দারিদ্র্য দূর করতে হলে প্রথাগত ও নতুন উপায় উভয়কেই কাজে লাগাতে হবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০০ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৮ দশমিক ৯ শতাংশ। সেটি কমে ২০০৫ সালে ৪০ শতাংশ, ২০১০ সালে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ২০১৬ সালে ২৪ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে অতিদারিদ্র্য ২০০০ সালে ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশ, ২০০৫ সালে সেটিও কমে গিয়ে ২৫ দশমিক ১ শতাংশ, ২০১০ সালে ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ২০১৬ সালে ১৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই দারিদ্র্য কমাতে কৃষি খাত খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারেনি।

গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্য কমাতে শিল্প ও সেবা খাত বেশি অবদান রেখেছে। এই সময়ে কৃষি প্রবৃদ্ধি ধীর ছিল এবং আগের চেয়ে দারিদ্র্য বিমোচনে কম অবদান রেখেছে। শহর অঞ্চলে ম্যানুফ্যাকচারিং বা উৎপাদন খাত বিশেষত তৈরি পোশাক খাত দারিদ্র্য কমাতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে।

এদিকে উৎপাদন খাতে কর্মসংস্থানে ধীরগতির কারণে সুবিধা পেতে পারত এমন পরিবারের অংশ সীমিত হয়েছে। অন্যদিকে সেবা খাতে আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিতদের মধ্যে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে, যা নগর দারিদ্র্য কমানোর ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করেছে।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রতিবেদন তৈরিতে পুরনো তথ্যের ব্যবহার করা হয়েছে। নতুন তথ্য পর্যালোচনা করলে পরিস্থিতি আরও অনেক উৎসাহব্যঞ্জক হতো। তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধি হচ্ছে এ দেশের দারিদ্র্য নিরসনের মূল চাবিকাঠি। দেশে টেকসই ও মানসম্পন্ন প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে।

প্রবৃদ্ধির এ অর্জন প্রত্যেক মানুষকে স্পর্শ করছে। প্রত্যেক মানুষ অর্থনীতির মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি দারিদ্র্য কমাচ্ছে। আশা করছি আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে এ দেশে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য থাকবে না। দারিদ্র্য নিরসনে আমরা সঠিক পথেই আছি। গত ১০ বছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় ভালো হয়েছে।

মার্সি মিয়াং টেম্বন বলেন, বিগত দশকে দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ প্রশংসনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে। কিন্তু এখনও প্রতি ৪ জনের ১ জন দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করছে। বাংলাদেশকে আরও অনেক কিছু করতে হবে। বিশেষ করে দারিদ্র্যের নতুন ক্ষেত্রগুলোর দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।

যেমন, শহর এলাকার দারিদ্র্য মোকাবেলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষের অর্ধেক শহরে বাস করবে। গত ছয় বছরে দারিদ্র্য বিমোচনের ৯০ শতাংশই গ্রামে হয়েছে। শহরে দারিদ্র্য কমছে সীমিত হারে এবং অতিদারিদ্র্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে শহরের লোকের অংশ একই রয়ে গেছে। ফলে জাতীয় দারিদ্র্য বিমোচনের গতি ধীর হয়েছে।

ড. শামসুল আলম বলেন, সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসন সম্ভব হচ্ছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধিও এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। তবে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দারিদ্র্য নিরসনের গতি বাড়ানো। ২০০৫ সাল পর্যন্ত দারিদ্র্য কমেছে বার্ষিক ১ দশশিক ৭ শতাংশ হারে।

২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বার্ষিক ১ দশমিক ৫ শতাংশ হারে এবং ২০১০ থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দারিদ্র্য কমেছে ১ দশমিক ২ শতাংশ হারে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে তৈরি হতে যাওয়া দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ও অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

সূত্র: যুগান্তর


শর্টলিংকঃ