দেড়শ’ বছরের পাবনায় নেই মাস্টারপ্লান, বাড়ছে ঝুঁকি


কলিট তালুকদার, পাবনা:

দেড়শ’ বছরের পুরোনো পাবনা শহর। বাড়ছে মানুষ, যত্রতত্র গড়ে উঠছে বহুতল ভবন। অপরিকল্পিত এই নগরায়নে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে পাবনা পৌরবাসী। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা অনুপাতে অবকাঠামো উন্নয়ন না হওয়ায় মিলছে না নাগরিক সেবাও। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই যত্রতত্র গড়ে ওঠা বহুতল ভবনে বাড়ছে ঝুঁকি।

দেড়শ’ বছরের পুরোনো শহর পাবনায় অপরিকল্পিত নগরায়ন চলছেই

১৯৮৯ সালে ‘ক’ শ্রেণীভুক্ত হওয়া এ পৌরসভার নেই কোনো মাস্টারপ্ল্যানও। এতে ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশংকা করছেন বিশেষজ্ঞরা। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনায় শহর বিকেন্দ্রীকরণের তাগিদ দিয়েছেন নগরবিদরা।

পৌরসভার বাসিন্দারা জানান, ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে পাবনার মধ্য শহরের আব্দুস সাত্তার বিশ্বাসের বাণিজ্যিক ভবনে ঘটে যায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড।  কোনো প্রাণহাণি না ঘটলেও, সেদিন পুড়ে যায় মার্কেটের ব্যবসায়ীদের প্রায় দশ কোটি টাকার মালামাল।

ফলে নিঃস্ব হয়ে যান এখানকার ব্যবসায়ীরা। পরবর্তীতে তদন্ত কমিটির অনুসন্ধানে জানা যায় শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল।  তবে ক্ষয়ক্ষতি বৃদ্ধির জন্য তদন্ত কমিটি অগ্নিনির্বাপনে কার্যকর ব্যবস্থা না থাকাকে দায়ী করেছেন। ঘটনাস্থলের আশেপাশে পানির উৎস না থাকায়, দূরের একটি পুকুর থেকে পানির সংস্থান করেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা।

কাছাকাছি পানির উৎস না থাকায় দূরবর্তী উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করতে সময় বেশী লাগায় ভয়াবহ এ আগুন নেভাতে সময়ও লেগে যায় অনেক, এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা।

ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষও দিয়েছেন একই ধরণের মত। তারা জানিয়েছেন আরও ভয়াবহ আশংকার কথা। তা হলো- কেবল দূর্ঘটনা কবলিত ভবনটিই নয়, দুর্বল নির্বাপন ব্যবস্থার কারণে অগ্নিদূর্ঘটনার ঝুঁকিতে রয়েছে শহরের অধিকাংশ বহুতল বাণিজ্যিক ভবন।

ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, সংকীর্ণ রাস্তার পাশে, ভবন নির্মাণ নীতিমালা (বিল্ডিং কোড) না মেনে তৈরি হচ্ছে একের পর এক বহুতল ভবন। সাত তলার বেশি উঁচু যেকোনো ভবন নির্মাণে ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও, তোয়াক্কা করছে না কেউ। এক্ষেত্রে পৌর কর্তৃপক্ষের অবহেলা রয়েছে বলেও অভিযোগ ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের।

জানতে চাইলে পাবনা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সহকারি পরিচালক কে.এম সাইফুল ইসলাম জানান, যেকোনো দূর্ঘটনা ঘটলেই ফায়ার সার্ভিসকে দোষারোপ করা হয়। অথচ নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে আনছেন, সেটা কেউ খেয়াল করেন না।

তিনি আরও বলেন, আমরা বারবার সতর্ক করছি। কিন্তু প্রভাব খাটিয়ে অনেকেই আপত্তিপত্রে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বড় বড় ভবন গড়েছেন, রাখেননি পানির রিজার্ভারও। এই অবহেলার পরিণাম যে কি ভয়াবহ হতে পারে তা ধারণা করাও কঠিন।

বহুতল বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবনে কমপক্ষে এক লাখ লিটার পানি ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন রিজার্ভার রাখা বাধ্যতামূলক করার পরামর্শ দিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা।

নির্মাণ কোড না মেনেপাবনা শহরে গড়ে উঠছে বহুতল ভবন

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,  পাবনা পৌরসভার আয়তন ২৭ দশমিক ২০ বর্গকিলোমিটার। এলাকায় সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মানুষ। তবে বাড়েনি রাস্তাঘাট, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নির্মিত বহুতল বিপণীকেন্দ্র ও আবাসিক ভবনগুলোর অধিকাংশেরই নেই পার্কিং, অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা।

অভিযোগ রয়েছে, সড়ক ও ড্রেনের জায়গা দখলেরও। গত দশ বছরে শহরতলীতে গড়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ সহ বেশকিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি চালু হয়েছে রেলপথ। ১৯৮৯ সালে ‘ক’ শ্রেণীভুক্ত হওয়া এ পৌরসভার নেই মাস্টারপ্ল্যানও। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনায় শহর বিকেন্দ্রীকরণের তাগিদ দিয়েছেন নগরবিদরাও।

বাড়তি মানুষের চাপে, অপ্রশস্ত সড়কে যানজট এখন নিয়মিত চিত্র। সামান্য বৃষ্টিতেই জলমগ্ন হয়ে পড়ে অধিকাংশ সড়ক। কখনো সড়ক উপচে পানি ঢোকে বাড়িঘরেও। যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকা আবর্জনায় চরমে পৌঁছায় জনদুর্ভোগ।

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সোহেল রানা বলেন, পাবনা অনেক পুরনো শহর হলেও তার কোন আধুনিকায়ন হয়নি। সমস্ত প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক স্থাপনা, গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর, হাসপাতাল সবকিছুই এত কাছাকাছি যে সব জায়গা থেকে মানুষ এসে একই এলাকায় ভিড় করে।

তিনি বলেন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সাথে সমন্বয় করে শহর বিকেন্দ্রিকরণ করে, আধুনিক সড়ক ও পয়ঃ নিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। তার জন্য প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগের একটি মাস্টারপ্ল্যান।

পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী তবিবুর রহমান জানান, স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয় পৌরসভার মাস্টারপ্লান তৈরিতে সহায়তা দেয়। আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। নির্দেশনা পেলে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হবে। অপরিকল্পিত বহুতল ভবনের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এক্ষেত্রে আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি পৌরবাসীর সচেতনতাও প্রয়োজন।

জেলা প্রশাসক মুহম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, অনুমোদনহীন ভবনের ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব পৌর কর্তৃপক্ষের। ইতোমধ্যেই এ ব্যপারে তাদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছি।

আরও পড়ুন: হোমিও ঔষধ খেয়ে যুবকের ভয়াবহ পরিণতি

               ….কৃষকের ছেলে নুরু যেভাবে ডাকসুর ভিপি


শর্টলিংকঃ