দ্রোহে ভালোবাসায় আমার রাজশাহী কলেজ


রহমত উল্লাহ ইমন, যুক্তরাজ্য:

আজ থেকে শুরু হয়েছে দুই দিনব্যাপী রাজশাহী কলেজের এইচএসসি অ্যালামনাই পুনর্মিলনী‌। প্রায় দেড়শ বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য সংগ্রাম ও আন্দোলন ও শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে এই কলেজ। এরই মধ্যে কয়েক বছর দেশসেরা কলেজের স্বীকৃতি পেয়েছে রাজশাহী কলেজ। 

রাজশাহী শহরেই আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা। সে কারণেই আশৈশব এর গৌরব, ঐতিহ্যের সাথে একাত্ম আমি। খুব ছোটবেলায় প্রতিদিন রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যেতে হত ফিজিওথেরাপি নিতে। যাবার পথেই পড়ত রাজশাহী কলেজ। বাবা এই কলেজের ছাত্র ছিলেন না, কিন্তু তিনি যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন রাজশাহী কলেজেই তাঁদের ক্লাস হত। এমন কি তাঁর আবাসস্থল ছিল ফুলার হোস্টেল। কত স্মৃতি তাঁর এই কলেজের সাথে। তাঁর রুমমেট ছিলেন প্রফেসর মনিরুজ্জামান মিয়া।

ফুটবল খেলতেন ভাষা সৈনিক গোলাম আরিফ টিপুর সাথে। তাঁর মুখেই শুনেছি মর্যাদার দিক থেকে অবিভক্ত ভারতবর্ষে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের পরেই স্থান ছিল রাজশাহী কলেজের। কিংবদন্তির সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, শিল্পী, গবেষক, বিপ্লবী, সমাজকর্মীদের সূতিকাগার এই রাজশাহী কলেজ। বাবার মুখে এসব গল্প শুনতাম আর ভাবতাম আমার কি কখনো সৌভাগ্য হবে এমন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ার?

রাতের রাজশাহী কলেজ
রাতের রাজশাহী কলেজ

আমার সেই স্বপ্ন সফল হল ১৯৮২ তে এসে। একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হলাম। এ যেন তারার মেলা। আমার বন্ধুভাগ্য বরাবরই খুব ভাল। রাজশাহী কলেজেও এর ব্যতিক্রম হল না। আমি নিজে মানবিক শাখার ছাত্র। আবার বিষয় হিসেবে গণিত পাঠ্য ছিল বলে বিজ্ঞান শাখার ছাত্রদের সাথে ক্লাস করতাম। আর পরিসংখ্যান ক্লাস করতাম মূলত বাণিজ্য শাখার ছাত্রদের সাথে। তাই আমার তখন জগত জোড়া বন্ধু। অসংখ্য মেধাবী মুখ! কাকে বাদ দিয়ে কার কথা বলি। এইচএসসিতে সম্মিলিত মেধা তালিকার ২০ এর মধ্যে ১৬ জনই আমার কলেজের। মানবিক আর বাণিজ্য শাখাতেও সেই একই অবস্থা।

প্রণব, মিজান, দুলাল, শামীম, লুসি, আসিফ, রাবেয়া, সাইফুল, ডানা, শামস সুমন, ওবায়েদ, মালা, কেয়া আরও কত উজ্জ্বল সব মুখ। বন্ধু নাফিজ, কামরুল বাহার আরিফ এমি, শফিকুল ইসলাম মন্টুর সাহিত্য আর কাব্য প্রতিভায় আমি ছিলাম দারুন ঈর্ষান্বিত। কলেজে ঢুকতেই একটি ছিপছিপে ছেলের সাথে দেখা হত। মেয়েদের কমনরুমের পাশ দিয়েই ছিল তার নিত্য ঘোরাফেরা। তার সাথে সবসময় ১০/১২ জন ছেলে থাকত। ওরা প্রায়ই মিছিল করত, ‘কানে কানে ফিস ফিস সবাই বল ইবলিশ’ বা ‘ইবলিশের রক্ত লোহার মত শক্ত’।

পুনর্মিলনীতে এইচএসসি '৮৮ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা
পুনর্মিলনীতে এইচএসসি ‘৮৮ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা

ইবলিশ পার্টির এই নেতা ছিল আমার ঘনিষ্ট বন্ধু সুমন (শামস ইবনে ওবায়েদ), যে পরবর্তীতে শামস সুমন নামে অভিনয় জগতে নাম করেছে। মেয়েদের উত্যক্ত করার ক্ষেত্রে সুমনের জুড়ি ছিল না। রাজশাহী কলেজে পড়েছে অথচ সুমনের উত্যক্তের শিকার হয় নি, এমন কোন মেয়ে খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে মজার ব্যাপার হল এই যে সুমনের হাতে সবচে বেশি উত্যক্ত হয়েছে আমার এমন কিছু বান্ধবী পরে আমাকে বলেছে যে তারা নাকি সেটা রীতিমত উপভোগ করত। হায় রে- একেই বলে নারী চরিত্র। দেবা ন জানন্তি! আমার সাথে অবশ্য সুমনের বন্ধুত্ব গাঢ় হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে। সে তখন অন্য এক মানুষ। নিবেদিত প্রাণ সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক কর্মী। রাজশাহী কলেজে আমাদের ‘গুরু’ ছিলেন সাইফুল ভাই। বর্ণাঢ্য এক চরিত্র। শুধু তার কাহিনীকে উপজীব্য করে ঢাউস বই লিখে ফেলা যায়।

ইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের নেতৃত্বে পুনর্মিলনীর শোভাযাত্রা
ইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের নেতৃত্বে পুনর্মিলনীর শোভাযাত্রা

মেয়েদের উত্যক্ত করার যে সব অভিনব পন্থা তিনি আবিস্কার করেছিলেন তাতে তাকে গুরু না মেনে উপায় ছিল না। ১৯৭৫ এ প্রথম বার এসএসসি দিয়ে শেষে ৮২ তে এসে কৃতকার্য হন তিনি। খুব অনিয়ম করতেন, শরীর বলতে ছিল শুধু হাড্ডি আর চামড়া, মাথায় এক বিশাল উইগ পরতেন, দেখার মত। ক্লাসে বসতেন একেবার প্রথম সারিতে। স্যার ম্যাডামেরা পড়ানোর সময় তিনি নানা মন্তব্য করে জমিয়ে রাখতেন ক্লাস। বাংলার হারুনুর রশিদ স্যার তো একবার বলেই ফেললেন, ‘আমার সামনে এটা কে বসে?’ সাইফুল ভাইয়ের তড়িৎ জবাব, ‘আল্লাহর এক উদ্ভট সৃষ্টি।‘ বাংলার বার্ষিক পরীক্ষায় প্রশ্ন এসেছিল রাজলক্ষ্মীর চরিত্র। সাইফুল ভাই এর এক লাইনের উত্তর, ‘রাজলক্ষ্মী পতিতা। সে চরিত্রহীনা তাই তাহার কোন চরিত্র নাই’। এই উত্তরের জের ধরে প্রিন্সিপাল স্যারের অফিসে তলব হয়েছিল তার। কিন্তু তিনি তার উত্তরে অনড়। হররোজ আড্ডার সাথী ছিল রাফিজ, পিটার, ফখরুল, মালেক, মাসুদ, লাকী, আরও অনেকে। খেলার মাঠে টুকু আর সন্টু। কলেজে আমার সব অপকর্মের সঙ্গী ছিল আমার খালাতো ভাই টিটু। প্রায় দুপুরেই ওর সাথে চলে আসতাম টিকাপাড়ায় ওদের বাসায়। রাণী খালাম্মা সবসময় আমার জন্য ভাতের চাল দিয়ে রাখতেন।

পূনর্মিলনীতে '৮৭ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের আনন্দ শোভাযাত্রা
পূনর্মিলনীতে ‘৮৭ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের আনন্দ শোভাযাত্রা

একজন মানুষ যাই রান্না করুক তাই কিভাবে অমন উপাদেয় হয় রাণী খালাম্মার রান্না যে খায় নি সে তা উপলব্ধি করতে পারবে না। টিটু সাংঘাতিক মিষ্টি পছন্দ করত। মাঝে মাঝে বাটার মোড়ে যেতাম ওর সাথে, কখনো কখনো এক কেজি জিলাপি ও অনায়াসে হজম করে ফেলত। তুলাপট্টির সব্জির চপ, বড় মসজিদের গায়ে লাগানো চায়ের দোকানের চা, জলযোগের লুচি নিরামিশ সন্দেশ, উড়িয়া ঠাকুরের ছানার জিলাপি, রহমানিয়া বা আজাদ হোটেলের কলিজার সিঙ্গাড়া শীষ কাবাব, নিউমার্কেটের খাসির মাংশের চপ সবখানেই আমি আর টিটু। রাজশাহী কলেজের সাথে জলযোগের সম্পর্ক ছিল নাড়ির বন্ধনের মত, আজকের ছেলে মেয়েরা হয় তো জানেও না রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী এই রেস্তোঁরাটির নাম। জলযোগের মত হারিয়ে গেছে আমার ভাই টিটু। নব্বই এর শেষে এক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয় সে। প্রায় পাঁচ বছর কোমায় থেকে সে চলে গেল না ফেরার দেশে তার পরিবারের সব প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে। পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা তার আত্মার চিরশান্তির জন্য।

অনেকেই বলে থাকেন যে রাজশাহী কলেজে ভাল ছাত্ররা আসে বলেই এই কলেজের ফলাফল এত ভাল। কথাটি আংশিকভাবে সত্য হলেও পুরো সত্য নয়। এই কলেজে আমি পেয়েছি অনেক নিবেদিতপ্রাণ ও গুণী শিক্ষককে যাদের অবদান কখনও ভোলার মত নয়। ইংরেজিতে অসাধারণ পড়াতেন খালেক স্যার। জলিল স্যার, শহিদুর রহমান স্যার, আমীর আলী স্যার ভাল পড়াতেন। খুব উপভোগ করতাম দীন মোহাম্মদ স্যারের ক্লাস। স্যার প্রায়ই সাধারণ জ্ঞানের ওপর প্রশ্ন করতেন। এই বিষয়টি ছিল আমারও খুবই প্রিয়। স্যার আমার উত্তর শুনে মাঝে মাঝে উচ্ছ্বসিত হয়ে আমার প্রশংসা করতেন। বলতেন শুধু বই মুখস্থ করে পরীক্ষায় ভাল নম্বর পাওয়া যায় বটে তবে তাতে জ্ঞান অর্জন হয় না। ছাত্র হতে হবে ইমনের মতন। শেহনাজ ম্যাডামের ক্লাস খুব ভাল লাগত। বাংলা নিয়ে আমি বরাবরই বিব্রত থাকতাম।

হাবিবুন্নবী স্যার ছিলেন আমার বাবার সহপাঠী, আর বাকি সবাই ছিলেন বাবার সরাসরি ছাত্র ছাত্রী। হাবিবুন্নবী স্যারের ক্লাস একদিন ফাঁকি দিয়েছি, পরদিনই বলেছেন, কি রে মোল্লার ব্যাটা, চোখ ফুটে গেছে, তোর বাপকে বলছি দাঁড়া। হারুন স্যারের কথা আগেই বলেছি। তাঁর অনবদ্য বর্ণনার গুণে বইয়ের চরিত্রগুলো জীবন্ত হয়ে উঠত। অসাধারণ পড়াতেন ফরিদা সুলতানা ম্যাডাম। সাইফুল ভাই সব ম্যডামের ক্লাসেই একটু বিশেষ ক্যারিশমা প্রকাশ করতেন। কিন্তু ফরিদা আপা প্রথম রাতেই বিড়াল মেরে দিলেন। সাইফুল ভাইকে খুব শান্ত কিন্তু কঠোর কন্ঠে বললেন, চাবকে তোমার পিঠের চামড়া তুলে নেব। সঙ্গে সঙ্গেই অফ হয়ে গেলেন গুরু আর আমরা শিষ্যরাও বুঝে গেলাম যে এই ম্যাডামের ক্লাসে নো বাঁদরামি। অর্থনীতিতে মাসুম স্যার, আনসার স্যার, মজিদ স্যার সুশিক্ষক ছিলেন। তবে আমি বেশি উপভোগ করতাম সুভাষ স্যারের ক্লাস। অসাধারণ পড়াতেন তিনি। আমার নিয়মিত লাইব্রেরি করার ‘বদভ্যাস’ ছিল। ক্লাস করি বা নাই করি, ২ টা থেকে ৫ টা আমি নিয়মিত লাইব্রেরিতে কাটাতাম।

রাজশাহী কলেজ লাইব্রেরী ছিল খুবই সমৃদ্ধ। এমন অনেক বই যা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে মিলত না তা পাওয়া যেত এখানে। আমার প্রিয় তিনটি বিষয় ইতিহাস, দর্শন আর অর্থনীতির খুব সমৃদ্ধ সংগ্রহ ছিল এখানে। স্যারকেও নিয়মিত লাইব্রেরি করতে দেখতাম। আমি অর্থনীতিতে পড়ব যেনে স্যার খুব উৎসাহ দিতেন। পরিসংখ্যান বিভাগে মোজাম্মেল স্যার তখন কেবল জয়েন করেছেন। খুব যত্ন করে পড়াতেন। আমাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন স্যার। তবে পরিসংখ্যানে কিংবদন্তির শিক্ষক ছিলেন লতিফ স্যার। কত সহজে যে একটা কঠিন বিষয় পড়ানো সম্ভব তা স্যারের কাছে যে না পড়েছে সে বুঝবে না। স্যারের কাছে পড়ার পর আবার কেন প্রাইভেট পড়তে হবে এটা ছিল আমার বোধের অগম্য।

আমি যে শেষ পর্যন্ত পরিসংখ্যান বিষয় হিসেবে পড়েছি তাতে নিঃসন্দেহে লতিফ স্যারের পরোক্ষ প্রভাব আছে। তবে পরিসংখ্যানকে তখন কেউ গুরুত্বের সাথে নিত না। প্রায় সবারই এটা ছিল চতুর্থ পত্র, অল্প পরিশ্রমে অনেক নম্বর পাওয়া যায়, মূলত এই ভাবনা থেকেই সবাই পরিসংখ্যান পড়ত। আমি এটা মূল বিষয় হিসেবে নিয়েছিলাম দেখে লতিফ স্যার খুব খুশি ছিলেন আমার ওপর। তিনি আবার কলেজ জীবনে বাবার সরাসরি ছাত্রও ছিলেন। আমার চতুর্থ পত্র ছিল যুক্তিবিদ্যা।

পেয়েছিলাম কিংবদন্তির শিক্ষক মল্লিক স্যারকে। অকৃতদার এই মানুষটি থাকতেন ফুলার হোস্টেলের পাশেই। তাঁর বাসায় ছেলেমেয়েদের ভিড় লেগেই থাকত। তিনি সবসময়ই প্রাইভেট পড়াতেন তবে কারো কাছ থেকেই পয়সা নিতেন না। আমি স্যারের কাছে কখনো পড়তে যাই নি, তবে গিয়েছি বাবার জন্য ওষুধ আনতে। তিনি শখের হোমিওপ্যাথ ডাক্তার ছিলেন এবং তাঁর ওষুধে বাবার অনেক অসুখ সেরেও গিয়েছিল। বাসায় গেলেই দেখতাম যে দল বেঁধে ছেলে মেয়েরা আছে। মেয়েরা রান্না করছে, স্যারকে খাওয়াচ্ছে, নিজেরা খাচ্ছে- যেন নিজেদের বাড়ি। বাবার কাছে তাঁর নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকদের যেসব গল্প শুনেছি সম্ভবত তার শেষ সংস্করণ ছিলেন আমাদের মল্লিক স্যার।

আমি স্কুলে থাকতেই রাজনীতিতে সক্রিয়। রাজশাহী কলেজে এসে আমি রীতিমত ছাড়া পাওয়া গরু। আমাকে আর পায় কে? আর সময়টাও তখন উত্তাল। ক্ষমতায় সদ্য চেপে বসেছে স্বৈরাচার। যতটা অথর্বই হোক না কেন, গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত একটি সরকারকে অস্ত্রের মুখে সরিয়ে একজন সেনাপতির ক্ষমতা দখলকে ছাত্রসমাজ কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনি। যখন আমার বন্ধুরা ক্লাসে লেখাপড়ায় ব্যস্ত, তখন আমি ব্যস্ত রাস্তায় রাস্তায় স্লোগান দিয়ে বেড়ানোয় বা গাছতলায় গলা ফাটিয়ে বক্তৃতা দেওয়ায়। অনেক সময় এমন হয়েছে যে কোন স্যার হয়তো ক্লাসে যাচ্ছেন বা ক্লাস থেকে ফিরছেন আর আমি গলা ফাটিয়ে বক্তৃতা করছি, উনি একটু শুনলেন দাঁড়িয়ে, তারপর যথারীতি আমাকে ক্লাসে পেলে রাম একটা ঝাড়ি দিয়ে দিলেন। আমার রাজনীতির গুরু ছিলেন সদ্য প্রয়াত জগলু ভাই (জগলুল আহমেদ)। কোন রাজনীতিক যে তার কর্মীদের অমনভাবে বুকে আগলে রাখতে পারেন জগলু ভাইকে না দেখলে তা বিশ্বাস করা যেত না।

উনি আমাকে মিছিল মিটিং এ সবসময় নিরুৎসাহিত করতেন। বলতেন তোর কাজ হল তোর মেধাকে কাজে লাগিয়ে উৎকর্ষতার শীর্ষে পৌঁছানো। আর এভাবেই দল তোর কাছ থেকে উপকৃত হবে। কিন্তু রাজনীতি তো একরকম নেশার মত, একবার পেয়ে বসলে আর ছাড়ানো যায় না। আর কী স্বাধীন জীবন তখন। যে আমি বাসায় কোন দিন এক কাপ চা খাই নি, সে আমি তখন কলেজ ক্যান্টিনে চায়ের কাপে ঝড় তুলছি। দিন রাত ছুটে বেড়াচ্ছি শহরের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। জগলু ভাই, বিশ্বদা, জাহাঙ্গীর গুরু এদের কাছ থেকে তো অনেক কিছুই শিখেছি। আমাদের সংগঠনের সভাপতি ছিলেন ডিগ্রির ছাত্র কুষ্টিয়ার আতিয়ার ভাই। এমন ভদ্র সাধাসিদা ভালো মানুষ হয়তো সেই সময় বলেই রাজনীতিতে আসতে পেরেছিলেন, শীর্ষ পদে গিয়েছিলেন। আজকের দিনে তাঁর মত মানুষ নিঃসন্দেহে রাজনীতিতে অপাংক্তেয়।

বন্ধু এমি কবি হলেও ছিল রাজনীতির ময়দানে লড়াকু যোদ্ধা। অসুস্থ শরীর নিয়ে ও যেভাবে রাজনীতির মাঠ দাপিয়ে বেড়াত তাতে অনুপ্রাণিত হয়েছি বারবার। রাজনীতির ময়দানেই বন্ধুত্ব হয়েছে ইকবাল, সেল্টু, হাসান, সাথী এদের সাথে- বড্ড নির্ভেজাল সেই বন্ধুত্ব যা আজও অমলিন। মাঝে মাঝে ফারুক লাইব্রেরীতে জম্পেশ আড্ডায় বসে যেতাম আবদুল্লাহিল কাইয়ুম ভাই আর মিজানুর রহমান মিনু ভাই এর সাথে। আমরা তিন জন তিন মতের মানুষ- কিন্তু কী সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কই না ছিল আমাদের মাঝে।

বন্ধু ইকবাল (বর্তমানে দিনাজপুরের এমপি ইকবালুর রহিম) ছিল আমার খুবই শুভার্থী। তার মত ভদ্র, মেধাবী ও সুদর্শন ছেলে আমি খুব কম দেখেছি। সে নিজেও রাজনৈতিক পরিবারের ছেলে। খুব তাড়াতাড়িই তার সাথে গভীর বন্ধুত্ব হয়ে গেল। কলেজ কমিটি গঠন নিয়ে বাধল বিপত্তি। সাধারণ সম্পাদক পদে ওর বিপরীতে প্রার্থী হল আমার স্কুলের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু রাফিজ। নির্বাচনে ইকবাল সামান্য ব্যবধানে হেরে গেল। ফলাফল ঘোষণার পর দুজন দুজনকে আলিঙ্গন করলাম। ইকবাল হাসিভরা মুখে বলল তুমি যদি নিউট্রালও থাকতে তাহলেও কিন্তু আমি জিতে যেতাম।

আমি বললাম, ইকবাল আমাদের রাজনীতির গন্ডি হয়তো এখানেই শেষ। কিন্তু রাজনীতি তোমার রক্তে, আর সব রকমের যোগ্যতাই তোমার আছে। তুমি অনেক দূর যাবে, আর সেইদিন আমার থেকে বেশি খুশি আর কেউ হবেনা। আমি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদ লাভ করেছিলাম। এই ঘটনার পর পুরো একটা বছর ইকবাল দুপুরে কলেজ হোস্টেলে আমার জন্য মিলের অর্ডার দিয়ে রেখেছে, কিন্তু কোনভাবেই পয়সা নেবে না। আমার বিকেলে প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাস হত বলে বাসায় যেতে পারতাম না। রাজশাহী কলেজ হোস্টেলের খাবারের মান বেশ ভাল ছিল তখন, অন্তত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বা ক্যাফের খাবারের মানের সাথে তুলনা করলে। এরপর সে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক হয়েছে, দিনাজপুর থেকে একাদিক্রমে তিনবার এমপি হয়েছে। অথচ রাজশাহী এলেই ও আমার সাথে দেখা করে গেছে।

৮৩ তে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠল যে স্বৈরাচার আমাদের ওপর জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসেছে। রাজনীতিবিদ বিশেষ করে ছাত্রনেতাদের ওপর দমন, পীড়ন, নির্যাতনের খড়গ নেমে এসেছিল। কিছুদিন থেকেই শোনা যাচ্ছিল যে এরশাদ পাকিস্তান আমলের আদলে একটি গণবিরোধী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে চান। ৬২ তে কুখ্যাত হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের যে রিপোর্ট ছাত্র জনতা বুকের রক্ত দিয়ে প্রতিহত করেছিল, ঠিক তার আদলেই একটি রিপোর্ট প্রণয়ন করছেন মজিদ খান। এই কমিশনের রিপোর্টের সারবস্তু প্রকাশ হয়ে যাবার সাথে সাথেই ছাত্ররা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা এর প্রতিবাদে মিছিল করার সময় পুলিশের গুলিতে শহীদ হন জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দীপালী সাহা সহ নাম না জানা আমাদের আরও ক’জন সহযোদ্ধা। উত্তাল আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ে সারা দেশে। তখন সব ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ। কিন্তু ১৫ ই ফেব্রুয়ারী সব নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে আমরা রাজশাহী কলেজ শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে সমবেত হলাম। সব দল, সব মতের এমনকি সাধারণ ছাত্ররাও। একজন ছাত্রে গায়ে গুলি লাগা মানে আমার গায়েই গুলি লাগা, এই ছিল আমাদের চেতনা। শুধু কলেজ নয়, গোটা রাজশাহী শহর আমাদের পদভারে প্রকম্পিত হল।

আন্দোলনের শিখা চারিদিক ছড়িয়ে পড়তেই সরকার পিছু হটতে বাধ্য হল- মজিদ খানের রিপোর্ট আর আলোর মুখ দেখল না। তবে সেই ঘটনা আমাদের মনে স্থায়ীভাবে রেখাপাত করল। ১৯৮৪ তে আমাদের এইচ এস সি পরীক্ষা। জানুয়ারীর দিকেই ঘোষণা এল যে সেই বছর থেকে এস এস সি আর এইচ এস সি তে মেধা তালিকায় শীর্ষস্থান অধিকারকারীদের জেনারেল এরশাদ স্বহস্তে ‘চ্যান্সেলর পুরষ্কার’ প্রদান করবেন। খবরটি শুনেই মন বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। যে হাতে আমার ছাত্রবন্ধুদের রক্তের দাগ লেগে আছে সেই হাত থেকে পুরষ্কার নেবে মেধাবী ছাত্র ছাত্রীরা। না কখনোই তা হতে দেয়া যাবে না। ১৯৮৪ তে শহীদদের আত্মত্যাগের প্রথম বার্ষিকী স্মরণে যে ছাত্রসভা হল তাতে বক্তব্য রাখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। এইচ এস সি তে আমার কী ফলাফল হবে তা আমার জানার কথা নয়, কিন্তু রাজশাহী কলেজ মেধাবীদের সূতিকাগার।

আমি অন্তত এটা জানতাম যে এই কলেজের অনেক ছাত্র মেধা তালিকায় স্থান পাবে। তাই অন্তত তারাও যদি এই পুরষ্কার বর্জন করে তবে খুনি স্বৈরাচারকে একটা উচিত জবাব দেওয়া হবে। আমার বক্তৃতায় আমি সব মেধাবী ছাত্রদের এই পুরষ্কার বর্জনের জন্য উদাত্ত আহ্বান জানালাম। অনেক মেধাবী ছাত্র সেদিনের সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন, সবাই আমার প্রস্তাবে সমর্থন জানালেন। নেতারাও সবাই আমাকে সাধুবাদ জানিয়েছিলেন। জুনের মাঝামাঝি শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একটি চিঠি পেলাম। আমি চ্যান্সেলর পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হয়েছি। এটা যে আমি বর্জন করব সেটা তো বলাই বাহুল্য, কিন্তু নীরবে কাজটি করতে মন সায় দিল না। আমি কেন এই পুরষ্কার বর্জন করছি তার কারণ উল্লেখ করে চ্যান্সেলর বরাবর দুই পাতার একটি চিঠি লিখলাম। তার কপি এখনো আমার ফাইলে আছে। মলিন, জীর্ণ একটি চিঠি। কাঁচা হাতের লেখা, যুক্তি কম, আবেগ বেশি।

এখনো মাঝে মাঝে সেই চিঠি বের করে দেখি। কী অসম্ভব ধারালো বক্তব্য। এখন আর এমন লিখতে পারিনা। বয়স বাড়লে মানুষ যে ভোঁতা হয়ে যায় এটা তারই প্রমাণ। আমি নিশ্চিত সেই চিঠি জেনারেল এরশাদের দরবার পৌঁছে নি। কিন্তু এর তিনটি অনুলিপি আমি শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা সচিব আর রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষের কাছে পাঠিয়েছিলাম। কলেজ থেকে ডাক পড়ল। প্রিন্সিপাল স্যার ভীত সন্তস্ত্র। উনাকেও মারব, আমিও মরব। কলেজে খবরটি চাউর হয়ে গেল। সব দলের বড় বড় সব নেতা আমায় এসে অভিনন্দন জানালেন। বিপদের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে অমন একটি দুঃসাহসিকতাপূর্ণ কাজ করা অনেকের কাছেই ছিল অচিন্ত্যনীয়। ঢাকা থেকে উচ্চপদস্থ বাবার এক প্রাক্তন ছাত্র ফোন করে সতর্ক করলেন ভবিষ্যতে চাকরি অথবা বিদেশে বৃত্তি নিয়ে পড়তে যাবার ক্ষেত্রে আমার অসুবিধা হতে পারে। কিন্তু ততদিনে আমি লোভ আর ভয়কে জয় করা শিখে গেছি। যদিও শেষ পর্যন্ত এই উদ্যোগ তেমন সফলতার মুখ দেখেনি। পুরষ্কারের লোভ সামলানো খুব কঠিন। আমি ছাড়া সবাই এটা নিয়ে এল- কিন্তু তাতে কী? আমি তো আমার বিবেকের কাছে দায়মুক্ত রইলাম।

মানুষের জীবনে আনন্দের উলটো পিঠেই থাকে দুঃখ, হাসির ভেতরেই লুকানো থাকে কান্না- এভাবেই হাসি আনন্দ দুঃখ বেদনা দ্রোহ ভালোবাসার ভেতর দিয়েই কেটে গেছে আমার দুই বছরের রাজশাহী কলেজ জীবন। আনন্দের স্মৃতিগুলো সতত সুখের আর কালের পরিক্রমায় দুঃখ বেদনাগুলোও ক্রমশ হয়ে উঠছে সুখস্মৃতি। এই জীবনে কিছু হারিয়েছি সত্য, কিন্তু প্রাপ্তি তার থেকে অনেক বেশি। জীবনকে যদি বলি এক মহাকাব্য তবে তার উজ্জ্বল একটি খন্ড আমার রাজশাহী কলেজ জীবন যার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে এই সব স্মৃতি। যুগ যুগ জিও আমার প্রিয় রাজশাহী কলেজ- এভাবেই আলোকবর্তিকা হয়ে পথ দেখাও তরুণ প্রজন্মকে অনন্তকাল।

লেখক : প্রফেসর ড. রহমতউল্লাহ ইমন , বল স্টেট ইউনিভার্সিটি, ইন্ডিয়ানা, যুক্তরাষ্ট্র


শর্টলিংকঃ