কদিন ধরে প্রচণ্ড গরমে মানবজীবন অতিষ্ট,তবে এ তাপ শুধু গ্রীষ্মের নয় পাকা ধান পুড়ছে মাঠে আর তারই তাপে আকাশ বাতাস গরম হয়ে উঠছে।ন্যায্য দাম না পেয়ে মাঠে কৃষকদের নিজ ধানে আগুন লাগানো নিয়ে বিভিন্ন মহলের নানান বিশ্লেষণ,তর্ক বিতর্ক,অভিযোগ অনুযোগ শুনছি গত কয়েকদিন ধরেই।
কেউ বলছেন এটা সরকার বিরোধীদের চক্রান্ত,কেউ বলছেন বাম দলগুলোর সস্তা স্টান্টবাজি,কেউ বলছেন সরকারকে চাপে ফেলে ধানের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা ইত্যাদি ইত্যাদি। সুশীলসমাজ,বুদ্ধিজীবী,রাজনীতিক সবাই চুপ…না রাজনীতিকরা ঠিক চুপ না তারা প্রতিবারের মতই ব্লেম গেমের পরসা সাজিয়ে মাঠে নেমেছেন।
উনার আমলে সারের দাম বেশি ছিল,কৃষক সার কিনতে না পেরে ধান ফলাতে পারেনি,কৃষক আÍহত্যা করেছে দামের অভাবে-তেনার আমলে গোডাউনে অবৈধ চাল মজুত করেছে দলের নেতারা,ন্যায্যমূল্যে ধান কেনার নামে কৃষকদের ঠকিয়েছেন,কৃষক পাকা ধানে আগুন দিয়েছে এই টাইপ বক্তব্য আরকি।আর আমাদের মন্ত্রী সন্ত্রীরাতো কম যান না টিভি মিডিয়া এবং সাংবাদিক দেখলে এনাদের মাথা ঠিক থাকেনা।
উল্টা পাল্টা বক্তব্য দিয়ে পরিবেশ আরো খারাপ করাই যেন এদের অর্পিত দায়িত্ব।খাদ্যমন্ত্রী মিডিয়ায় দেওয়া বিভিন্ন বক্তব্যে বলেছেন-“এবার ধান উৎপাদন বেশি হয়েছে,এজন্যই ধানের ন্যায্য দাম পাচ্ছেনা কৃষকরা”,“ধানের বাম্পার ফলন দেখেই বোঝা যায় দেশের উন্নয়ন হচ্ছে” আর করছেন তো তারাই… “ধানের দামের ব্যাপারে সরকারের কিছু করনীয় নাই” এমন আরো অনেক বক্তব্য।
এসব মন্ত্রীদের প্রধানমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রীসভায় কিভাবে যায়গা দেন আমি বুঝিনা,এসব মন্ত্রীদের মনগড়া হটকারি বক্তব্যে বির্তকিত হন প্রধানমন্ত্রী বির্তকিত হয় সরকার।শুধু তাই নয় এতে আক্রান্ত ক্ষতিগ্রস্থদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে প্রচন্ড ক্ষোভ বিদ্বেষ। বিগতদিনেও মন্ত্রী সন্ত্রীদের মনগড়া হটকারি বক্তব্যে অবস্থা বেগতিক হয়ে যেতে আমরা
অনেকবারই দেখেছি।
একজন মন্ত্রীর কথায় কাজে অবশ্যই দায়িত্বশীল হওয়া উচিৎ,একটি সভ্য দেশে একজন মন্ত্রীর কাছ থেকে দায়িত্বশীল আচরণ আমরা নিশ্চয় আশা করতে পারি।কিন্তু আমাদের সে আশায় বারবার গুঁড়ে বালি দিয়েছেন আমাদের মন্ত্রীরা।আমরা সাধারণ নাগরিকরা আমাদের নেতা বা মন্ত্রীদের কাছে তেমন কিছু চাইনা চাই নিজের মনের কষ্টের কথাটা বলতে এবং কিছু আশার কথা নেতা বা মন্ত্রীর কাছ থেকে শুনতে।
কিন্তু সে নেতা বা মন্ত্রীই যখন হতাশার দায়িত্বহীনতার কথা শোনান তখন মানুষের হতাশা আর নাগরিক কষ্ট বিক্ষোভে পরিণত হয়।
আসুন পাঠকবৃন্দ মন্ত্রীর দেওয়া উপোরুক্ত বক্তব্যগুলোর বিশ্লেষণ করা যাক।প্রথম বক্তব্য-“এবার ধান উৎপাদন বেশি হয়েছে,এজন্যই ধানের ন্যায্য দাম পাচ্ছেনা কৃষকরা”।বিশ্লেষণ-উৎপাদন বেশি হলে দ্রব্যের দাম কম হবে আর উৎপাদন কম হলে দাম দেশি এই সহজ সমীকরণটি আমার বিশ্বাস পঞ্চম শ্রেণী পড়া ছাত্রদেরও অজানা নয় এতে নতুন কিচ্ছুনেই মন্ত্রী সাহেব।
এর পরের কথা হল কৃষক বেশি ফসল উৎপাদন করেছে এটা আর অপরাধ নয় বরং এটা রাষ্ট্রের সম্পদ।এই সম্পদ এবং সম্পদ উৎপাদনের সাথে জড়িত জনগোষ্ঠীর দায়িত্ব অবশ্যই আপনাদের অর্থাৎ রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্র পরিচালনার সাথে সংযুক্ত প্রতিটি ব্যাক্তির।
কৃষক যদি একবছর ধান না উৎপাদন করে ভাবুনতো খাবেন কি ?…অবশ্য তাঁদের খুব একটা অসুবিধা হবে বলে মনে হয়না কারণ তারা কেউ চালের ভাত খান না বোধয়। তবে রাষ্ট্রে চালের অভাব হলে ভেতো বাঙ্গালিকে সামলানো কিন্তু মুশকিল হবে।
সে যাহোক কৃষকের উৎপাদিত ফসল ন্যায্য দামে সংগ্রহ করে নিজের দেশের প্রয়োজন মিটিয়ে দেশের বাইরে রপ্তানি করার দায়িত্ব কার জনাব মন্ত্রী সাহেব আপনাদের নাকি কৃষকের এ প্রশ্নের উত্তরটা আপনি নিজ দায়িত্বে খুজে নেবেন,আমরা উত্তরটা জানি।
এতো বিপুল পরিমাণ ধান উৎপাদনের পরেও কোটি কোটি টাকা খরচ করে কার স্বার্থে প্রতিবছর বিদেশ থেকে চাল আমদানি করা হচ্ছে এটা আজও আমারা বুঝে উঠতে পারছিনা।
মানলাম মুনাফালোভী সিণ্ডিকেট এর জালে সরকার আষ্টেপিষ্টে আছে কিন্তু সেই সিণ্ডিকেট থেকে সরকারকে মুক্ত করার কতটুকু দায়িত্ব নিয়েছেন আপনারা নাকি সেই সিন্ডিকেটেরই মুনাফা নিজের পকেটে পুরে সরকার এবং রাষ্ট্র প্রধানদের আরো বিপর্যয় এর মধ্যে ফেলেছেন।দ্বিতীয় বক্তব্য-“ধানের বা¤পার ফলন দেখেই বোঝা যায় দেশের উন্নয়ন হচ্ছে”।
বিশ্লেষণ-এই বক্তব্য মন্ত্রী বলতে চেয়েছেন তার সরকার দেশের হেব্বি উন্নয়ন করেছে যার ফলে জমিতে বা¤পার ফলন হয়েছে।বেশ খুবই ভালো কথা তো কৃষক যে বাম্পার ফলন করেছে এবং দেশে যে বিপুল পরিমাণ ধান আছে এটা নিয়ে বসে থাকলে কি উন্নয়ন টা হবে।
ধানের ন্যায্য দাম যদি কৃষক না পায় এবং ধান রপ্তানি করে যদি দেশের কিছু পয়সা ইনকাম নাই হয় সেটা কি মাপের উন্নয়ন আপনারাই বুঝুন।তৃতীয় বক্তব্য-“ধানের দামের ব্যাপারে সরকারের কিছু করনীয় নাই”।বিশ্লেষণ-ধানের ন্যায্য দাম কৃষক পাবে কিনা এবং উৎপাদিত ধান দেশের কাজে লাগবে কিনা সে বিষয়ে নাকি সরকারের কোন কিছুই করার নেই তাহলে করবে কে আলাদিনের জিন!!!।
আপনাদের ভোট দিয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব কি শুধু প্রোটকল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করবার জন্য দেয়া হয়েছে নাকি জনগণের হিতকর কাজ করার জন্য দেয়া হয়েছে।যদি ভোট দিয়ে আপনাদের দেশ পরিচালনার দ্বায়ভার দেয়া আমাদের অপরাধ হয়ে থাকে তবে সে অপরাধের জন্য আমরা ভীষণ লজ্জিত এবং আমরা নিজেরাই নিজেদের কঠোর শাস্তি দাবি করছি।
আবার গতকাল সংবাদ মাধ্যমের খবরে দেখলাম মন্ত্রী সাহেব ধানে আগুন লাগানোর তদন্ত কমিটি গঠন করে দোষীদের শাস্তির হুমকি ধামকি দিয়ে বেড়াচ্ছেন।কৃষক যদি ধানের ন্যায্য দাম না পায় তবে ধানে আগুন দিবে নাতো কি গোলায় সাজিয়ে রাখবে। আমার জিনিস আমি আগুনে পোড়াবো নাকি পানিতে ভাসাবো সেতো আমার ব্যাপার,এতে কি অপরাধ আর কি বা এর শাস্তি তা আমার মোটেও বোধগম্য হচ্ছে না।
আর তা যদি অপরাধ হয় তাহলে ধানে আগুন দেয়া কৃষদের ধরে ধরে জেলে পুরুন এবং শাস্তি দিন।জেলে থাকলে অন্তত দুমুঠো ভাততো পাবে,নিজে ধান ফলিয়ে দাম না পেয়ে কয়েকগুণ দামে চাল কিনতে না পারার কষ্ট জেলের কষ্টের চেয়ে হাজার হাজার গুণ বেশী।
মন্ত্রী সাহেবদের কাছে আকুল আবেদন শুধু কৃষকদের নয় ওদের গোটা পরিবার শুদ্ধু জেলে পুরুন।দেশের জন্য ফসল ফলিয়ে না হোক অন্তত জেলের দুবেলা দুমুঠো ভাত খেয়ে ওরা বাঁচুক।আবার দেখলাম সরকারের লোকজন কৃষকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধান কিনছেন,এটা হাস্যকর পাবলিক স্ট্যান্ডবাজি নয় কি।
কৃষকের বাসায় বাসায় না গিয়ে প্রতিটি উপজেলায় সরকারি সষ্য বাজার স্থাপন করে ধান ক্রয় কেন্দ্রের মাধ্যমে ন্যায্য দামে ধান কিনতে পারলে সেটা নিশ্চয় এর চেয়ে বেশী কার্যকর এবং কৃষকবান্ধব সিদ্ধান্ত হত।
শেষ করবো আমার ছাত্র ভাইবোনদের ধান কাটা আন্দোলন নিয়ে দুএকটা কথা বলে। এবার দেখলাম আমার ছাত্র ভাইবোনরা কৃষকদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন তাঁদের ধান কেটে দিচ্ছেন।প্রগতিশীল ঘরানার ছাত্র সংগঠন থেকে শুরু করে ছাত্রলীগের কর্মীরা মাঠে কৃষকের সাথে ধান কাটছেন কেউবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন পোষ্ট দিয়ে তাঁদের সমর্থন করছেন এবং উৎসাহিত করছেন।
আপনাদের কাজ নিশ্চয় প্রশংসা পাবার দাবীদার এবং এ কাজের জন্য আপনাদের হৃদয়ের গভীর থেকে জানাই কৃতজ্ঞতা এবং শ্রদ্ধা। তবে ধান কেটেই কি কৃষকের মুখে হাসি ফোটানো যাবে বন্ধুরা? না যাবেনা।
ধান কাটার আন্দোলনের সাথে সাথে কাটা ধানের ন্যায্য মূল্য কৃষকদের আদায় করে দেবার আন্দোলনটাও আমাদেরই করতে হবে।ধানের দাম নূন্যতম ১১০০ টাকা মন করা গেলে কৃষকরা ধানের ন্যায্য দাম কিছুটা হলেও পাবে। আর তা তখনি সম্ভব হবে যখন অসাধু মুনাফালোভী সিন্ডিকেটের হাত থেকে দেশের কৃষি এবং কৃষক মুক্ত হবে।
দেশের গুদামে ধান চাল মজুত রেখে কোটি কোটি টাকা খরচ করে চাল আমদানি করে যারা নিজেদের আখের গুছাচ্ছেন তারা অবশ্যই দেশ এবং জাতির শত্র“।দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে এদের বিরুদ্ধে লড়াই করে সরকার এবং রাষ্ট্রকে রক্ষা করা আমাদের সবারই দায়িত্ব।মনে রাখতে হবে কৃষি এবং কৃষক বাঁচলেই বাঁচবে দেশ।
…তাই প্রধানমন্ত্রী সহ সকল দেশপ্রেমিক নাগরিকদের কাছে অনুরোধ,আসুন বাংলাদেশের কৃষি,কৃষক এবং সর্বপরি দেশ বাঁচানোর লড়াইয়ে কৃষকের সাথে একাত্ব হই,কৃষকের পাশে দাঁড়ায়।