- ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ - https://universal24news.com -

নবাবি শিল্পকলা ও স্থাপত্যশৈলীর শহর লক্ষ্ণৌ


লক্ষ্ণৌ এক আয়েশি মেজাজের শহর, যে শহরে পা দিলেই নাকি মন হেসে ওঠে। আসলে মনের কী দোষ, শহরটাই জাদু মাখানো এক অন্দরমহলের কাহিনী। লক্ষ্ণৌ বিখ্যাত তার আদবকায়দার লম্বা ইতিহাসের জন্য। বলা হয় যখন দুজন নবাবের ঘোড়ার গাড়ি মুখোমুখি একে অন্যকে পাশ কাটিয়ে যেত, তখন দুজনই থেমে অন্যজনকে আগে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করতেন আর বলতেন, ‘প্যাহলে আপ, প্যাহলে আপ’ (আপনি আগে যান)। এই প্যাহলে আপের চক্করে পড়ে কাজে দেরি হয়ে যেত।

আক্ষরিক অর্থে লক্ষ্ণৌ শহরকে রাজধানীর মর্যাদা দেন অওধ রাজ্যের চতুর্থ নবাব আসফউদ্দৌলা। এর আগে পিতা নবাব শুজাউদ্দৌলার রাজধানী ছিল ১৫০ কিলোমিটার দূরে ফয়জাবাদে। বেশ জাঁকজমকের সঙ্গেই রাজ্য শাসন করতেন নবাব শুজাউদ্দৌলা ও বেগম সাহিবা। নবাব শুজাউদ্দৌলার সময় থেকে ব্রিটিশ কোম্পানি অওধের রাজনীতি ও সেনাবাহিনীর ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা শুরু করে। পরবর্তী সময়ে তারা পুরো রাজ্যকেই গ্রাস করে নেয়।

পুরাণ বলে, অওধের একটি মনোহর জায়গার নাম ছিল লক্ষ্মণপুর। অযোধ্যাপতি রাজা দশরথের তৃতীয় পুত্র লক্ষ্মণের নামে। লঙ্কা বিজয়ের পর রাজাধিরাজ রামচন্দ্র সে এলাকা অনুজ লক্ষ্মণকে উপহার দিয়েছিলেন বনবাস থেকে ফিরেই। অনুজের প্রতি অগ্রজের ভালোবাসার উপহার, বিপদের দিনে ছায়ার মতো সঙ্গে থাকার পুরস্কার। তারপর থেকে এ এলাকার নাম হয় লক্ষ্মণপুর। সেখান থেকে লোকমুখে নাম হয় ‘লক্ষ্ণৌ’। প্রথম থেকেই লক্ষ্ণৌতে হিন্দু-মুসলমান জনগোষ্ঠী একসঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছিল, আজও তাই আসছে।

লক্ষ্ণৌ প্রায় সব নবাবই ছিলেন কবি। কবিতা, সংগীত অথবা শিল্প সাহিত্যের কদর করতেন দরাজ দিলে। কেউ কেউ নিজে তেমন লিখতে না পারলেও কবিদের নিজ দরবারে বিশেষভাবে সম্মানিত করতে কার্পণ্য করতেন না।

পিতার রাজধানী থেকে খানিক দূরে শৌখিন ও বিলাসী পুত্র নবাব আসফউদ্দৌলা মনের মতো করে গড়ে নেন নিজ রাজধানী লক্ষ্ণৌ ১৭৭৫ সাল থেকে। অবকাঠামো নির্মাণকাজের জন্য উদার হস্তে খরচ করেন আশরাফি।

নবাবের বিলাসিতার ফল লক্ষ্ণৌ বহিরঙ্গ সমৃদ্ধি। দরবারের জাঁকজমক এত বেড়ে গিয়েছিল যে অন্য রাজ্যের দরবার এর সামনে মলিন হয়ে রইল। বিলাস ও ভোগের এত সামগ্রীর মওজুদ অন্য কোথাও মেলা ভার। লক্ষ্ণৌ শহরের উন্নতি ও শৌকর্য এমনভাবে বাড়তে লাগল যে পুরো ভারতবর্ষে অন্য কোনো শহর এর সামনে দাঁড়াতে পারত না। যে অর্থ পূর্বপুরুষ খরচ করতেন সৈন্য ও যুদ্ধ প্রস্তুতিবাবদ, সেই অর্থ নবাব আসফউদ্দৌলা ব্যয় করতে লাগলেন বিলাসিতায়, শহর সাজানোয়। নবাবের বাসনা একটিই, হায়দরাবাদের নিজাম বা মহীশুরের টিপু সুলতান যিনিই হন না কেন, কারো দরবারের রোশনাই যেন তার দরবারকে ছাড়িয়ে না যায়।

নবাব আসফউদ্দৌলা গোমতি নদীর তীরে তৈরি করেছিলেন নিজ মহল ‘দওলতখানা’ ও ‘রুমি দরওয়াজা’। তার আমলে তৈরি সবচেয়ে অনুপম অত্যাশ্চর্য ভবন ‘ইমামবাড়া’, মহররমের দিনে শিয়া মতাবলম্বীদের তাজিয়া মিছিলের উৎসস্থল।

১৭৮৪ সালে অওধে আকাল দেখা দেয়। শহরের ধনবানরাও অনাহারে মারতে থাকেন। সেই নিদারুণ অবস্থায় প্রজাদের সাহায্যের জন্য তাদের ইমামবাড়া নির্মাণকাজে নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা মজদুরের কাজকে সম্মানহানির কাজ মনে করতেন। তাই ইমারত নির্মাণকাজ দিনের পর রাতেও চলত। শহরের রইস কিন্তু অভাবি লোক কাজ করতে আসতেন তখন রাতে। যে নিষ্ঠা, ভক্তি ও ধর্মোৎসাহের সঙ্গে নবাব এ ইমারত তৈরি করেছিলেন, ঠিক সেই নির্মল ও আন্তরিক উৎসাহ সহকারে জনসাধারণও এ কাজে প্রাণ ঢেলে দিয়েছিল। ফলে এ ইমামবাড়া ভারতের সর্ববৃহৎ, অতুলনীয় এবং এক শানদার কান্তি লাভ করেছিল।

ইমামবাড়ার নকশার জন্য সারা দেশ থেকে বিখ্যাত সব স্থপতি ও শিল্পীদের ডেকে পাঠানো হয়েছিল। প্রত্যেকের চেষ্টা ছিল নিজের নকশা যেন অন্যের প্রস্তাবিত নকশাকে ছাড়িয়ে যায়। অবশেষে যার নকশা পছন্দ হলো তিনি তখনকার অদ্বিতীয় শিল্পী কিফায়াত উল্লাহ। তাকে দিল্লি থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ১৬৭ ফুট লম্বা ও ৫৩ ফুট চওড়া ইমারত আগাগোড়া ইট ও খুব ভালো মানের চুন দিয়ে তৈরি। নিচ থেকে ছাদ অবধি কোথাও কাঠের নামগন্ধ নেই। লক্ষ্ণৌতে মর্মর পাথর প্রায় দুষ্প্রাপ্য বস্তু। মোগল বাদশাহদের পাথরের তৈরি অট্টালিকার প্রতিযোগিতা করতে তখন আসফউদ্দৌলা কাঠ, রড ছাড়াই নির্মাণ করলেন এক আশ্চর্য দৌলত। সৌন্দর্য ও আড়ম্বরের এক নতুন রূপ। খিলান দিয়ে তৈরি ইমামবাড়ার ভেতরের চন্দ্রাকৃতি গোলাকার ছাদ। এমন সুগঠিত বঙ্কিম ছাদ দুনিয়ার আর কোথাও নেই। এটি পৃথিবীর অন্যতম আশ্চর্যও বলা চলে।

বিশালাকার ভবনের দোতলা, তিনতলাজুড়ে ১ হাজার ২৪টি পথ। শুধু পথ নয়, এ হচ্ছে প্রবেশপথ, যা দিয়ে ঢোকা সহজ কিন্তু বের হওয়া মুশকিল, কারণ বের হওয়ার জন্য আছে মাত্র দুখানা পথ। এ দালানে দরজার সংখ্যা ৪৪৯। কোনোটা আসল, কোনোটা নকল, কোনোটা চিরতরে বন্ধ।

এ বিশাল ভবনে প্যাসেজের মতো দিক দিশাহীন পথকে বলা হয় ভুলভুলাইয়া, যা নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য ছিল থামহীন, ইস্পাতহীন ভবনের ভারসাম্য রক্ষা করা, যাতে খালি প্যাসেজের মতো জায়গা ঠিকমতো ইমারতকে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারে, এখনো আঁকড়ে আছে অবিচল।

কদম কদম সুরঙ্গসম পথ চলা শেষে রাস্তা মিলবে ইমামবাড়ার ছাদে যাওয়ার। ছাদ থেকে, লবঙ্গ আকারের মোটিফের মাঝখান দিয়ে দেখা যায় পাশের আসফি মসজিদ, রুমি দরওয়াজা, নবাবের প্রাসাদ ইত্যাদি। ইমামবাড়া বা বড় ইমামবাড়ার নিচতলায় নবাব আসফউদ্দৌলা সমাধি। বাইরে বিশাল আঙিনা, একে ঘিরে রয়েছে তোরণ ও প্রাচীর আর প্রাচীরের বাইরে আরেকটি বাগান এরপর আরেকটি তোরণের সঙ্গে মূল প্রবেশদ্বার। একসময় সাদা রঙ করা ছিল। তোরণে খাঁজ খাটা নকশা, ফুল-লতা-পাতার মোটিফ। দুপাশে ঝুল বারান্দা। এ নকশা অনুকরণ করা হয়েছে পিতা নবাব শুজাউদ্দৌলার রাজধানী ফয়জাবাদের স্থাপত্যশিল্প অনুসরণ করে। যার উত্কৃষ্ট উদাহরণ ফয়জাবাদে বহু বেগম সাহিবার সমাধিসৌধ। এসবই মোগল ইসলামিক স্থাপত্যশৈলী বা ইন্দো-সারাসেনিক স্থাপত্যকলা।

 

আসফউদ্দৌলা নিজ রাজ্যের অট্টালিকার ওপর ইউরোপীয় স্থাপত্যের বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে দেননি। সিপাহি বিদ্রোহের সময় ইংরেজরা বড় ইমামবাড়া ব্যবহার করে কেল্লা বা দুর্গ হিসেবে। আশপাশের বাড়িঘর ভেঙে ফেলা হয়েছিল। শ্বেতাঙ্গ সিপাহিরা এসে ওঠে ইমামবাড়ায়। মাঝখানের বড় কক্ষটি তখন অস্ত্রাগার হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছিল। মেঝের ওপর দিয়ে বড় বড় ভারী কামান যাওয়া-আসা করত। তবু মেঝেয় কোনো গর্ত হয়নি।

আজও ইমারতগুলো তেমনি মজবুত, উজ্জ্বল, স্থায়ী হয়ে নিজ নিজ স্থানে দাঁড়িয়ে আছে। এখন ইমামবাড়ায় মহররমের সময় তাজিয়া বের হয়, পাশে আসফি মসজিদে নামাজ পড়া হয় পাঁচ ওয়াক্ত।

আসফি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল লাহোরের বাদশাহী মসজিদের আদলে। আর আমাদের প্রিয় শায়ের মীর ত্বকী মীর এ মসজিদের কোনায় বসে রচনা করেছেন শায়েরী আর গজল আপন বেদনায় নুয়ে পড়ে।

একই সময়ের আরেকটি স্থাপনা ‘রুমি দরওয়াজা’। বড় ইমামবাড়া থেকে বের হয়ে সামনে এগোলে বড় রাস্তাজুড়ে কারুকার্যখচিত যে বিশাল তোরণ শোভা বাড়াচ্ছে তার নাম রুমি দরজা। স্থাপনাটিও নবাব আসফউদ্দৌলা বড় ইমামবাড়া নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে নির্মাণ করেন।

প্রায় ৬০ ফুট উচ্চতার রুমি দরজা তোরণ আকারের, যার প্রাচীরের কারুকার্য লক্ষ্ণৌ শহরের ঐতিহাসিক এমব্রয়ডারি চিকনকারীকে মনে করিয়ে দেয়। আরো বলা হয় তোরণটি নাকি দেখতে রানীর দামি নৌলাখা হার বা নয় লহরী হার সদৃশ। তোরণের সামনে থেকে দেখতে এক রকম আর পেছন থেকে আরেক রকম। দিনরাত গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, রিকশা চলছে রুমি দরজার নিচ দিয়ে।

আসফউদ্দৌলা থাকতেন ইমামবাড়ার পাশে আপন মহল ‘দওলতখানা’য়। এখন দওলতখানা দেখলে চেনা দায়। যে দৌলত আর শোহরতে তিনি বসবাস করতেন, এখন তা পরিচর্যার অভাবে মলিন বেশ ধারণ করেছে, প্রায় পরিত্যক্ত একটি ভবন। ভেতরের কক্ষগুলোর ভগ্নদশার মাঝে বাস করছে কয়েকটি ছিন্নমূল পরিবার।

অওধের ষষ্ঠ নবাব সাদাত আলী খান রাজ্য অভিষেকের প্রথমেই কিনে নিলেন ‘ফারহাত বখশ’ নামের এক মঞ্জিল একজন ফিরিঙ্গির কাছ থেকে। দরবার করলেন ‘লাল বারাহদরী’ নামের ভবনে, যা বর্তমানে লক্ষ্ণৌ ইউনিভার্সিটির গ্রন্থাগার। নদীর ওপারে নির্মাণ করলেন ‘দিল আরাম’ ও ‘দিলখুশা’। এ ভবনগুলো এরপর কিছুদিন ইংরেজ অফিসাররা ব্যবহার করেছিলেন। এখন সরকারি কর্মকর্তাদের বাসভবন, অফিস বা জনসাধারণের জন্য জাদুঘর হিসেবে খুলে দেয়া হয়েছে।

নবাব আসফউদ্দৌলার ইন্তেকালের পর লক্ষ্ণৌ এ উপমহাদেশের স্থাপত্যকলা অনুসরণ করে ভবন নির্মাণে ঘাটতি পড়ে। এরপর যে নবাবই ভবন নির্মাণ করেছেন, সবই ইউরোপীয় স্থাপত্যকলা অনুসরণ করে। রেসিডেন্সির সব ভবন ইউরোপীয় ধাঁচে নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে প্রতি ভবনের মাঝখানে খোলা জায়গা ও বিশাল বাগান করা ছিল। নবাব সাদাত আলী খান লক্ষ্ণৌ পশ্চিমে একটি বাজার নির্মাণ করেছিলেন ‘সাদাতগঞ্জ’।

নবাবের আরো একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপনা ‘মোতি মহল’। মহলে অনেক সাদা গম্বুজ ছিল, যা দূর থেকে দেখতে মুক্তোর মতোই টলটলে জলে ভাসমান মনে হতো। আজ অবশ্য এসব আর কিছুই নেই, মোতি মহল একটি সরকারি অফিস। মাঝেমধ্যে এর সামনের খোলা জায়গাটি ভাড়া দেয়া হয় বিয়েশাদির অনুষ্ঠানের জন্য এবং জলে টলমল মুক্তোর সৌন্দর্যের ছিটেফোঁটাও এখন আর অবশিষ্ট নেই।

১৮১৪ সালে নবাব সাদাত আলী খানের ইন্তেকালের পর পুত্র গাজীউদ্দীন হায়দার নিজ বাসভবন ছেড়ে দিয়ে সেই ভবনে গড়ে তোলেন প্রিয় পিতার সমাধিসৌধ। ভবনটি খানিকটা হলেও মোগল স্থাপত্যশৈলী ধরে রাখতে পেরেছে। পাশে একই প্রাঙ্গণে সাদাত আলী খানের দুই বিবি মুরশিজাদী ও খুরশিদজাদীর সমাধিসৌধ।

সপ্তম নবাব গাজীউদ্দীন হায়দার পিতার জমানো কোটি কোটি টাকা উড়াতেন মহল নির্মাণে, আরাম আয়েশে। গাজীউদ্দীন হায়দার ‘মুবারক মঞ্জিল’ ও ‘শাহ মঞ্জিল’ নির্মাণ করেন পিতার নির্মিত মোতি মহলের পাশে। এখন অবশ্য এ মঞ্জিলের নাম-নিশানা কোথাও নেই।

অওধের নবাবদের মধ্যে গাজীউদ্দীন হায়দারই উপমহাদেশে প্রথম জীবজন্তুর লড়াইয়ের খেলা শুরু করেন। শাহ মঞ্জিলের কোঠায় বসে তিনি হাতি, গণ্ডার ও অন্যান্য পশু-পাখির লড়াই উপভোগ করতেন। বাঘের লড়াইও হতো। পশু-পাখির জন্য তিনি মাইলকে মাইলজুড়ে মুক্তাঙ্গন তৈরি করেছিলেন শাহ মঞ্জিল ঘেঁষে।

গাজীউদ্দীন হায়দারের সময় প্রথম লক্ষ্ণৌতে ছাপাখানা খোলা হয়। মুদ্রণের কাজ প্রথমত শুরু হয়েছিল শখের বশে, ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে নয়। ছাপাখানার কালির জন্য শর্ষের তেলের হাজার হাজার প্রদীপ জ্বেলে উত্তম কাজল তৈরি হতো, অম্লত্বের জন্য আনা হতো কাগজি লেবু। ভালো কাগজে ভালো কাজই ছিল লক্ষ্য। নবাবি শাসনামলে লক্ষ্ণৌতে আরবি, ফারসি পাঠ্যপুস্তক ও ধর্মগ্রন্থ যেমন মুদ্রিত হতো, তেমনটি আর কোথাও হতো না। সে কারণেই পুস্তকগুলো এক ধরনের সম্পত্তি হয়ে রয়ে গেছে।

গোমতী নদীর তীরে মোতি মহলের পাশে নবাব নির্মাণ করেছিলেন ‘নজফে আশরাফ’ নামে একটি ইমামবাড়া। ১৮২৭ সালে নবাব গাজীউদ্দীন হায়দারের মৃত্যুর পর তাকে একই ভবনে সমাধিস্থ করা হয়। সঙ্গে একই ছাদের নিচে রয়েছেন তার তিন বিবির সমাধি। এদের মধ্যে একজন ছিলেন শ্বেতাঙ্গ।

অষ্টম নবাব নাসিরউদ্দীন হায়দারের জ্যোতিষ ও নক্ষত্র বিদ্যায় আসক্তি ছিল। তিনি লক্ষ্ণৌ শহরে একটি প্রথম শ্রেণীর মানমন্দির স্থাপন করেন। মানমন্দির স্থাপিত হওয়ার পর নাম হলো ‘তারেওয়ালী কোঠী’। বিদেশ থেকে বড় বড় দূরবীন ও জটিল সব যন্ত্রপাতি আনা হলো। এই আশ্চর্য লক্ষ্ণৌতে আগে কেউ দেখেনি। অবশ্য ১৮৩৭ সালে নাসিরউদ্দীন হায়দারের তিরোধানের পর এর কদর আর কেউ করেনি। সিপাহি বিদ্রোহের সময় ভবনটি দেশী বিদ্রোহী সৈন্যদের মিলনস্থল হিসেবে ব্যবহূত হয়েছিল। তখন কোথায় সব রাজা-বাদশাহ, কোথায় তাদের খেয়ালিপনা! এখন ভবনটি স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার জেনারেল ম্যানেজারের বাসভবন, সাধারণ মানুষের ভেতরে ঢোকা বারণ।

নবম নবাব মোহাম্মদ আলী শাহ সিংহাসন প্রাপ্তির দ্বিতীয় বছরে বিখ্যাত ইমামবাড়া ‘হাসনাবাদ’ ও একটি বিশাল মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু করেন। এ হাসনাবাদ ইমামবাড়াই পরে ছোটা ইমামবাড়া নামে পরিচিতি পায়। আগ্রার তাজমহলের আদলে নির্মিত হয়েছিল লক্ষ্ণৌ এই দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য ইমামবাড়া।

রুমী দরওয়াজার কাছে তিনি ‘সাতখান্ডা’ নামে গোলাকার সাততলা কেকের মতো একটি মহল তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু শেষ করে যেতে পারেননি। জামা মসজিদও শেষ করতে পারেননি। ১৮৪২ সালে তার মৃত্যুর পর বেগম মসজিদের কাজ শেষ করে গিয়েছিলেন। চওক বা পুরনো লক্ষ্ণৌ রাস্তার দুই পাশের মনোরম ভবন নির্মাণ করে শহরের শোভাবর্ধন করার কৃতিত্ব পুরোটাই নবাব মোহাম্মদ আলী শাহর। এখন পুরনো লক্ষ্ণৌ চওকের সুসজ্জিত বেশ আর নেই, ঘুপচি গলি আর গায়ে গা লাগানো নিচু ভবনের একটি সড়ক, যেখানে পায়ে চললেও লোকের সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

ইমারতের শখ ছিল ভীষণ অওধের একাদশ ও শেষ নবাব ওয়াজিদ আলী শাহর। সিংহাসনে বসেই নির্মাণকাজ শুরু করে দিলেন ‘ক্যায়সার বাগ’-এর। বহুদূর বিস্তৃত এলাকা তার মাঝে আশ্চর্য সুন্দর দোতলা বাড়ি পর পর, একটা দিক ছিল নদী ছোঁয়া। সিপাহি বিদ্রোহের সময় এ দিকের প্রায় সবই ধ্বংস হয়। বাকি তিনদিক এখনো আছে। ভারত সরকার এ আদেশ দিয়েছে যে ভবনগুলো যে অবস্থায় ছিল তেমনই রাখতে হবে।

ক্যায়সার বাগের অন্দর প্রাঙ্গণে গাছগাছালির ভিড় মাঝখানে পাথরের ‘বারহদরী’। ক্যায়সার বাগের পূর্ব তোরণ থেকে বাঁ দিকে ঘুরলেই ‘জলপরী ফটক’, প্রধানমন্ত্রীর বিশ্রামগৃহ। ফটকের অন্যদিকে হযরত বাগ। ভেতরে ডানদিকে ‘চাঁদীওয়ালী বারহদারী’, সাধারণ ইট-চুনের বাড়ি, ছাদ ছিল রুপোর পাতে মোড়া তাই এ রুপালি নাম। এরই লাগোয়া খাসমকাম। জাঁহাপনার আরামগৃহ। আগে এটি ছিল সাদাত আলী খানের ‘বাদশাহ মঞ্জিল’। পরে নাম হয় ‘ছত্তর মঞ্জিল’, গোমতী নদী যে ভবনের পেছনে এলিয়ে ছড়িয়ে বয়ে চলে। এখন এ মঞ্জিল সরকারি অফিস। স্থাপত্যকলায় ইউরোপীয় ছাপ প্রকট। ভবনের মাঝখানে ছাতার মতো গোলাকার গম্বুজ আছে বলে নাম ছত্তর মঞ্জিল।

নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ ছিলেন প্রকৃত সংস্কৃতিপ্রেমী। ধর্মকর্মের সঙ্গে সঙ্গে কবিতা লেখা, নাচ, গানে তার অগাধ আগ্রহ ছিল। তার সময়ে ভারতবর্ষে প্রথম মঞ্চে নাটক দেখার সৌভাগ্য অর্জন করে দেশবাসী। কত্থকনৃত্য ও ঠুমরী বিপুল প্রচলিত ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে নবাব ওয়াজিদ আলী শাহর কল্যাণেই। নবাব নিজেও বিভিন্ন সংগীত, নৃত্য ও অভিনয়ে অংশগ্রহণ করতেন।

লক্ষ্ণৌ শহরের পথে এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বড় বড় তোরণ আর ভবন, যেমন ইমামবাড়ার সামনে নওবতখানা, দেউড়ি ইত্যাদি। নওবতখানা সাধারণত ব্যবহার করা হতো নওবত নামক বাদ্যযন্ত্র বাজানোর জন্য। যখন নবাব নিজ ভবন থেকে বের হতেন বা যখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান হতো, তখন বেজে উঠত নওবত লক্ষ্ণৌ শহরে। পুরনো লক্ষ্ণৌতে অগুনতি ভবন চোখে পড়বে, যা নবাবি খুশমেজাজ হয়ে এখনো ইতিহাসের গল্প বলছে।

এখানকার মানুষের শিরায় শিরায় শের শায়েরী, গজল; কালে কালে কাব্যে এসেছে নতুন শৈলী, লক্ষ্ণৌ তখন উপহার দিয়েছে নবযুগের কবি। আজকের দিনেও উর্দু-ফারসি ভাষায় কাব্যচর্চার বড় একটা অংশের জোগান দেয় এই নবাবি শহর লক্ষ্ণৌ।

এই কাব্য, শিল্প, সাহিত্যের শহর; স্থাপত্যশিল্প, সংস্কৃতির বিশাল সম্ভার লক্ষ্ণৌ তাই এখনো পরিপূর্ণ করে চোখ ও মনের সৌন্দর্যের সব সুধাপাত্র।

 

ফাতিমা জাহান: পুরাকীর্তি ও প্রাচীন সভ্যতা অনুসন্ধানী লেখক