নবীজির স্মৃতিময় পুণ্যভূমি তায়েফ


আদিল মাহমুদ :

তায়েফ নগরীর দৃশ্য।

মক্কা নগরী থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর স্মৃতিবিজড়িত শহর তায়েফ। এ শহর ‘ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি।’ চমৎকার সাজানো গোছানো শহর। শহরজুড়ে রয়েছে প্রাচীন দুর্গ ও নানা রকম ভাস্কর্য। মক্কা থেকে তায়েফের রাস্তাগুলো পাহাড়ের বুক চিরে তৈরি করা। এক পাশে উঁচু পাহাড় অন্য পাশে শরীর হিম করা গভীর খাদ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যসমৃদ্ধ এ শহরের জনপ্রিয়তা কেবল তার প্রাচীন প্রকৃতির জন্য নয়, বরং অনেক নতুনত্বের জন্যও।

এ পাহাড়ে আছে একটি শহর। অথচ সেটা দেখে বোঝার উপায় নেই। মনে হবে সমতলেই গড়ে উঠেছে শহরটি। তায়েফের ঝকঝকে নীল আকাশ, আছে একরাশ মুগ্ধতার ছোঁয়া। আকাশ কতটা নীল হতে পারে কিংবা আকাশের আসল রূপ কোনটি তা আমার জানা নেই। খুব বেশি দেশ ভ্রমণেরও অভিজ্ঞতা নেই। তারপরও আমার মনে হল, ‘সত্যিকারের নীল দেখতে হলে তায়েফের আকাশ দেখতে হবে। এখানের নয়নহারা দৃশ্য বারবার দেখেও ফের দেখার সাধ জাগবে।’

ঐতিহাসিক যুগের সাক্ষী তায়েফের প্রাচীন দুর্গগুলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। ইসলাম ও মুসলিম সভ্যতার বিস্ময়কর উদাহরণ হয়ে স্থাপত্যশিল্পের প্রাচীন দুর্গগুলো আজও টিকে আছে। এ দুর্গগুলোর নকশা দেখে যে কেউ অবাক হবে। বিস্ময়দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে। দুর্গগুলোর নকশা এমনভাবে সাজানো রয়েছে, যার ওপর তলাতে রয়েছে পর্যবেক্ষণ চেম্বার। ফলে যুদ্ধের সময় এ দুর্গগুলো বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধের পাশাপাশি যে কোনো সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে প্রতিরক্ষার জন্য পর্যবেক্ষণ টাওয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। যুদ্ধের ব্যবহার ছাড়াও আবাসিক ভবন হিসেবে এর কৌশলগত গুরুত্বও রয়েছে।

সাধারণত দু’ধরনের দুর্গ দেখা যায়- স্থায়ী ও অস্থায়ী। দুর্গগুলো শহর, সীমান্ত চৌকি, সমুদ্র কিংবা নদীর উপকূলবর্তী অঞ্চল ও বাণিজ্য কেন্দ্রগুলোকে রক্ষা করার জন্যই নির্মিত হয়েছিল। স্থায়ী দুর্গগুলো দেয়ালে বেষ্টিত। এর মধ্যে সৈন্যরা বসবাস করত। অস্থায়ী দুর্গগুলো যুদ্ধকালীন নির্মাণ করা হয়। পরিখা খনন আত্মরক্ষার্থে খোঁড়া গর্ত, যুদ্ধাস্ত্র স্থাপনের মঞ্চ, মাইন পাতা স্থান, তাৎক্ষণিকভাবে তৈরি মাটির প্রাচীরাদি প্রভৃতি এবং কাঁটাতারের বেড়া এর অন্তর্ভুক্ত।

আধুনিক ইতিহাসের শিক্ষক সাদ আল-যুদি বলেছেন, ‘তায়েফের অন্যতম সৌন্দর্য তার প্রাচীন দুর্গগুলো। তায়েফের দক্ষিণের দুর্গগুলো শহরের বাসিন্দাদের সৌন্দর্য কিংবা আবাসের জন্যই শুধু নয়, বরং যে কোনো অভ্যন্তরীণ বা বহিরাগত আক্রমণ থেকে শহরবাসীকে রক্ষার জন্য একদল দক্ষ কন্সট্রাক্টরদের দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল। তায়েফের অধিবাসীরা চারপাশ ঘেরা পাহাড় থেকে পাথর সংগ্রহ করে এই ভিন্ন আকৃতির দুর্গগুলো নির্মাণ করেছিল।

দুর্গের নিচে প্রথমে ভারী পাথর এবং তার ওপরে কিছু হালকা পাথর দিয়ে দুর্গগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল। যার ফলে শত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধে একটি শক্তিশালী এবং স্থিতিশীল প্রতিরক্ষামূলক বেস তৈরি হয়েছিল। দুর্গের অভ্যন্তরে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। তীব্র শীত বা গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমে দুর্গের ভারী পাথরের আড়ালে তাপমাত্রার তীব্রতা অনুভব করা যেত না। এ ছাড়া মরুঝড় থেকেও দুর্গগুলো অধিবাসীদের রক্ষা করত।

তায়েফের ঐতিহাসিক দুর্গগুলো সম্পর্কে ইতিহাসবিষয়ক স্কলার মোনা উসাইরি বলেছেন, ‘তায়েফের এ পাথুরে স্থাপত্যগুলোর ভেতরে ও বাইরের রঙিন নকশাগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পুরুষরা যখন দুর্গের নির্মাণ কাজে ব্যস্ত থাকত, নারীরা দুর্গের ভেতরে ও বাইরে তখন নকশার কাজগুলো করত। দুর্গগুলোর দেয়ালে বিভিন্ন রঙিন নকশা তাদের কারুকর্মেরই প্রতিচ্ছবি। তায়েফের এ দুর্গগুলো আমার মন শীতল করেছে। ইতিহাসপ্রেমী যে কোনো পর্যটকের জন্যই তায়েফের এ ঐতিহাসিক প্রাচীন দুর্গগুলো দর্শন করা উচিত বলে আমি মনে করছি।

রাসূলুল্লাহ্ (সা.) স্মৃতিবিজড়িত শহর তায়েফের সৌন্দর্য এবং প্রাচীন দুর্গগুলো নিয়ে শুধু সাদ আল-যুদি ও মোনা উসাইরি কিছু বলেছেন, লিখেছেন এমন নয় বরং অনেক বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ, কলামিস্ট এবং পর্যটকরা পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখেছেন। সিরাতের বইয়েও তায়েফের দুর্গগুলোর সুন্দর বিবরণ পাওয়া যায়।

সূত্র: উর্দু ডেইলি পত্রিকা আগ অবলম্বনে।


শর্টলিংকঃ