পুঁজিবাদ কেড়ে নিয়েছে মানুষের স্বয়ংসম্পূর্ণতা



১. নোভেল করোনা ভাইরাস (২০১৯-এনসিওভি) চীনের উহান শহরে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরে প্রথম একটি প্রজাতির সংক্রমণ দেখা দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ওয়ার্লওমিটারের ২০২০ সালের ৯ এপ্রিল দুপুর ১টা পর্যন্ত তথ্যানুযায়ী  ২০৯টি দেশ ও অধীনস্থ অঞ্চলের  ১৫ লক্ষ ১৯ হাজার ৫ শত ১৫ জন মানুষ আক্রান্ত হয়েছে।

৮৮ হাজার,৫ শত ৪৯ জন মানুষের মৃত্যু ঘটেছে এবং  ৩ লক্ষ ৩০ হাজার,৯ শত ১৬ জন বেশী রোগী সুস্থ্য হয়েছেন। দিনে দিনে, ঘন্টায় ঘন্টায় এখন পর্যন্ত এই পরিসংখ্যান বাড়তেই আছে। করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে বিশ্বের সকল রাষ্ট্র কাজ করছে। সংগত কারনে বিশ্ব এখন করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় পুরোটা সময় ব্যায় করছে। যা কিছু হচ্ছে সবকিছু করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করেই বিশ্বের চাঁকা ঘুরছে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও করোনা ভাইরাসের রোগী সনাক্ত হয়েছে। ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়।

মহামারি আকারে ছড়িয়ে পরা করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বাংলাদেশও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে প্রথম এবং অন্যতম নিয়ম হিসেবে লকডাউন, সামজিক দুরুত্বের দিকগুলো বেশী গুরুত্ব দিচ্ছে সকল দেশ। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দেখা যায় করোনাভাইরাস যেখানে শুরু হয়েছে সেসকল দেশে কোথাও সংকট কাটিয়ে উঠেনি। করোনা ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীন দেশ গতকাল ৭৭ দিন পর লকডাউন পুরোপুরি তুলে নিলেও তাঁরা বলছে করোনাভাইরাস আবরো হানা দিতে পারে । তার মানে এখনো সংকট কাটেনি। দুই মাসের বেশী সময় পার করে চীন লকডাউন তুলেছে। বাংলাদেশ কোনমতে তা বিচ্ছিন্নভাবে শুরু করেছে।

তবে ঢিলে ঢালা লকডাউন আর জনগণের আচরণ সবমিলে প্রত্যাশার লকডাউন নেই বললেই চলে বাংলাদেশে। অনেকে নিজের এলাকা, গ্রামে নিজেদের মতো করে লকডাউন নিয়ম চালু করেছে। তবে আশার কথা জনগণও ধীরে ধীরে সচেতন হচ্ছে। লকডাউনে সকল করখানা, প্রায় সব অফিস আদালত বন্ধ হয়েছে। খেটে খাওয়া মানুষের কর্ম বন্ধ হয়েছে। বেশীরভাগ খেটে খাওয়া মানুষের যেটুকু সম্বল ছিলো তা শেষ হয়েছে। খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে।

২. বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে লকডাউন কতোটা টিকে থাকবে তাও এখন ভাবার বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। কারন একটাই। এদেশে খেটে খাওয়া গরীব মানুষ। মাটির সাথে উৎপাদনে মিশে থাকা সোনার মানুষ। যারা দিনে এনে দিনে খায়। রাষ্ট্র বলি আর আমাদের প্রচলিত রীতিনীত বলি বাংলাদেশে এই মানুষগুলোর সংখ্যাই অনেক বেশী। কেউ হয়তো ছোট খাটো চাকরি করে, মাসে এনে দিনে খায়। তফাত খুব বেশী নেই।

দরিদ্র-গরীব থাকা বিষয়ে নৃবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানীরা যেমন দারিদ্রের সংস্কৃতির দিকটিকেও গুরুত্ব দেন তেমনি এই মানুষগুলোকে দারিদ্রের মধ্যে আটকে রাখাও রাষ্ট্রের এবং পুঁজিবাদী সূত্রের অন্যতম একটি কৌশলও বটে। সমাজ, প্রেক্ষাট এবং তাঁর আশপাশের পরিবেশ দরিদ্র মানুষগুলোকে দরিদ্রের ভেতর থেকে বের হতে দেয়না। নানা কৌশলে আটকে পড়ে থাকে গরীব মানুষগুলো। বংশ পরস্পরায় তার শাখা প্রশাখা বাড়তেই থাকে। কোনভাবেই স্বয়ংস্মূর্ণতা অর্জন করতে পারেনা। দুর্যোগ মোকাবেলায় মানুষের স্বয়ংসম্পূর্ণতা দিকটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আর এই স্বংস্মপূর্ণতার সাথে স্থানীয় সামাজিক এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু বন্ঠনের দিকটিও অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

দিনে দিনে সেই দিকগুলোকে আমরা সংকট থেকে মহাসংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছি আর মহাধুমধামে জাহির করেছি আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন যেন আটকে গেছে গোটা কয়েক মানুষ আর প্রতিষ্ঠানের হাতে। এটাকে কখনো কল্যাণময় স্বয়ংসম্পূর্ণতা বলা যায়না। এটা সংকট সৃষ্টির পথকে আরো বেগবান করতে সহায়তা করবে। মানুষ স্বয়ং সম্পূর্ণ তখনই হয়, যখন মানুষ নিজেই তার সংকটকালিন সময়কে মোকাবেলা করতে পারে। বর্তমান মহামারি করোনাভাইরাস সংকটকালিন সময়ে বেশ ভালোভাবেই টের পাচ্ছি আমরা ।

আসলে কতোটা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। ৭ দিনেই আমাদের ত্রাহী ত্রাহী অবস্থা শুরু হয়ে গেছে। মালিক পক্ষ যখন কারখানা বন্ধ করে দিলো কোটি কোটি মানুষ আর চলতে পাচ্ছেনা। প্রায় গোটা জাতিকে এই কলকারখানার ধনী মানুষগুলো তাঁদের কৌশলী পুঁজিবাদী শৃঙ্খলে আটকে রেখেছেন। সময় সংকটে এই ধনীরাই আবার সব থেকে বেশী সুবিধা আদায় করে নেয়, সব থেকে বেশী সুবিধা পায় তাঁরাই। রাষ্ট্রও উঠে পড়ে লাগে এই গোষ্ঠীকে রক্ষার জন্য, সবিধা দেবার জন্য। কারন বিশ্বের বেশীরভাগ রাষ্ট্রগুলো নিজেও একটা পুঁবাদীতন্ত্রের মধ্যে রোলপ্লে করে চলে।

রাষ্ট্রের প্রায় সব সেক্টরেই এই পুঁজিবাদীরা দখল করে রেখেছে। তাই রাষ্ট্রের যখন নিয়ম কানুন, আইন তৈরী হয় সেটা পুঁজিবাদকে সুবিধা দেবার জন্যেই হয়। বাস্তবচিত্রও তাই। আমরা যতোই বলি সাম্যের কথা। আসলে সেটা দরিদ্র এবং গরীব মানুষগুলোকে আরো বেশী ঠকানোর একটি কৌশল মাত্র। কলকারখানার মালিকরা বছরের পর বছর যখন আয় ইনকাম করে নেয় এই শ্রমিকদের দ্বারা, একটু সংকটে-বিপদে কেন তারা নিবেনা এই শ্রমিকদের দায়িত্ব? নিবেনা, নিলে তাঁদের টাকার অংকটা কমে যাবে।

রবং সেটো পুঁজি করে রাখাই শ্রেয়। আবার শ্রমিকের এই সংকটও তাঁদের জন্য এক ধরনের পুঁজি হয়ে উঠে। শ্রমিককে সামনে রেখে, শ্রমিকের সমস্যার কথা বলে হাতিয়ে নেয় নতুন নতুন সুবিধা। মালিক শ্রমিকের এই দৃশ্য এবং প্রেক্ষাপট কখনো পরিবর্তন হতে দেখা যায়না। মনে হয় হবেওনা। তাই প্রয়োজন অধিকার আদায়। অধিকার আদায়ে যখন মাঠে শ্রমিক জনতা, তখন আবার রাষ্ট্রীয় লাঠিয়াল বাহিনীর তান্ডব আর পুঁজিবাদী আইনকানুন দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দেয় সেই অধিকার আদায়ের শক্তিকে। মেহনতি মানুষের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের, অধিকার আদায়ের প্রতিটি পথ এভাবেই সংকোচিত করে রেখেছে পুঁজিবাদী ধাচের রাষ্ট্র নামের প্রতিষ্ঠান।

৩. প্রান্তিক কৃষক নানা ঘাত প্রতিঘাত আর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যখন ফসল ফলায়, সেই ফসলের পুরোটা লাভ তুলে নেয় ব্যবসায়ীরা। এখানেও নিয়ম আর ব্যবস্থাপনা সবসময় কৃষকের পক্ষে নয়। সব নিয়ম, সব সুবিধা যেন ব্যবসায়ীদের জন্য। লকডাউনে সেটাও টের পাচ্ছে প্রান্তিক মানুষগুলো। মূল্যের থেকেও অধিক মুল্যে হাতিয়ে নিচ্ছে পণ্যের মূল্য। কৃষি যখন লাভখাতে চলে যায়, সে জায়গায় তখন দখল করে পুঁজিপতি-মালিকপক্ষ।

প্রান্তিক কৃষক তার জমাজমি হারিয়ে এখন পরনির্ভরশীল বর্গাচাষীতে পরিণত হয়েছে। আবার গ্রামে বর্গাচাষীরা দিনে দিনে নিস্ব হয়ে ঋণের জালে আটকে পড়ছেন। যাদের টাকা বেশী তাঁরা লীজ বা কন্টাক্ট নিয়ে জমিতে বাণিজ্যিক আকারে ফসল ফলাচ্ছেন। প্রান্তিক কৃষক নিজের জমি হারিয়ে সেই জমিতে এখন দিনমজুরে পরিনত হয়েছেন। তাই করোনা সংকটের এই মহাদুর্যোগে গ্রামের প্রান্তিক কৃষক-শ্রমিকও পড়েছেন মহাবিপদের মধ্যে। কাজ না করলে টাকা নেই। টাকা নেইতো ভাত নেই। শহর গ্রামে সবখানে যেন খামচা দিয়ে ধরে রেখেছে মহাজন, পুঁজিপতি-মালিক পক্ষরা।

প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, বরেন্দ্র অঞ্চলের দিনে দিনে উদ্যান ফসলের চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে। পেয়ারা, আম, বড়ই, কমলা লেবু ইত্যাদির চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে। শহরের ধনীক শ্রেণীরা জমি লিজ বা কনটাক্ট নিয়ে পুকুর খনন করে মাছ চাষ করছেন। এ ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে শ্রমিকের কাজের অভাব। একটা জমিতে যখন বৈচিত্রময় ফসল ফলানো হয়, তখন বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজন পড়ে শ্রমিকের। কিন্তু একমূখী চাষের ফলে এতে শ্রমিক কম লাগে। কিছু এলাকায় দিনে দিনে শ্রমিকরা তাঁদের কাজ হারিয়েছে। বেকার হয়েছে। অনেকে কাজের সন্ধানে বা কাজ করতে শহরমূখী হয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের এই সংকটে শহরে চলছে লকডাউন। এ সময়ে তাঁরাও খাদ্য সংকটে পড়েছেন। শহর গ্রামের সার্বিক দিকগুলোর স্বয়ংসম্পূর্ণতা যেন কেড়ে নিয়েছে পুঁজিপতিরা।

৪. এই দুর্যোগকালিন সময়েও সমাজের তথা কথিত নেতৃত্বদানকীর কিছু নেতারাও পেয়েছেন অগাধ আয় ইনকামের সুযোগ। ত্রাণের তহবিল, ত্রাণের চাউল সবকিছুর মধ্যে তাঁদের শুরু হয়েছে এই সময়ের করোনামৌসুমী অবৈধ আয়ের উৎস। গরীবের জন্য প্রদেয় ত্রাণসামগ্রী তাঁরা সঠিক মানুষের কাছে পৌঁছে না দিয়ে নিজেরা আত্নসাত করছেন। এরাও একধনের গ্রাম্য পুঁজিবাদ চরিত্র। রাজনীতির নামে , নেতৃত্ব দেবার নামে এরা গ্রামে পুঁজিপতির লাইনে চলাফেরা করেন। এরা রাষ্ট্রের বড় বড় পুঁজিপতিদের লাইনম্যান হিসেবে ভূমিকা পালন করে থাকেন।

এদের কারনেও গ্রামের মানুষ তাঁদের স্বয়ংসম্পূর্ণতা এবং স্বাধীনতা হারিয়েছে। তাই এই সংকটকালিন সময়ে ত্রাণ নিতে এসেও একজন নারী-শিশুও ধর্ষণ হয়। স্বয়ংসর্ম্পূর্ণতা একটা স্ব-শক্তি। এই শক্তি মানুষকে দুর্যোগে নিজেকে মোকাবেলা করতে সহায়তা করে। মানুষকে নিজের স্বাধীনতাকে সুরক্ষা করতে সহায়তা করে। নিজের সম্ভ্রমকে রক্ষা করতে সহায়তা করে। দিনে দিনে সেই দিকগুলোও যে নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আরো বেশী প্রবাহমান হয়েছে তা করোনাভাইরাস সংকটকালিন সময়ে স্পষ্ট হয়েছে।

লেখক: উন্নয়নকর্মী ও গবেষক, বারসিক


শর্টলিংকঃ