Site icon ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ

পুলিশের সহযোগিতায় দখলদারিত্বে অপ্রতিরোধ্য নবাবপুরের আবেদ-জাবেদ


স্থানীয় পুলিশের সহযোগিতায় গত দুই যুগের বেশি সময় ধরে একের পর এক অর্পিত সম্পত্তি দখল করেছে ঢাকার নবাবপুরের দুই ভাই জাবেদ উদ্দিন ও আবেদ উদ্দিন। সর্বশেষ একটি শহীদ পরিবারের জন্য বরাদ্দ জমি-বাড়ি দখলের পর পুলিশের মহাপরিদর্শক জাবেদ পাটোয়ারীর হস্তক্ষেপে পুলিশের উপ-কমিশনার ইব্রাহীম খানকে সাময়িক বরখাস্ত হয়। এটা ছিল এই দখলদার চক্রের ষষ্ঠ দখল।

ভুক্তভোগী পরিবারটির অভিযোগ, উপ-কমিশনার ইব্রাহীম খান ও বংশাল থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাহিদুর রহমানকে জাবেদ ও আবেদ ৩ কোটি টাকা দিয়ে ‘ম্যানেজ’ করেছে। এছাড়া বাড়ি থেকে তাদের বের করে দেওয়ার সময় ৫ কোটি টাকার মালামাল লুট করেছে জাবেদ-আবেদের সন্ত্রাসী বাহিনী।

আইজিপির কাছে করা অভিযোগে লুটের বিষয়টি উল্লেখ করেছে শহীদ পরিবারটি। অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে পুলিশি তদন্তেও অবৈধ দখলদারদের সহযোগিতা ও দায়িত্ব অবহেলার চিত্র পাওয়া গেছে। আইজিপির কাছে ভুক্তভোগী পরিবারটি অভিযোগ না দিলে লালবাগ বিভাগের পুলিশের সহযোগিতায় আবেদ-জাবেদ দখলদারিত্ব প্রকাশ্যে আসতো না।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৯৪ সাল থেকে জাবেদ ও আবেদ অর্পিত সম্পত্তির জাল কাগজপত্র করে দখল করা শুরু করে। ধীরে ধীরে তাদের দখলদারিত্বের পরিসরও বাড়ে। পুলিশের শরণাপন্ন হয়েও প্রতিকার পাননি ভুক্তভোগীরা। উল্টো পুলিশ ভুক্তভোগীদের বিরুদ্ধে মামলা নিয়েছে।গত সোমবার (২৬ আগস্ট) ইব্রাহীম খানকে বরখাস্ত করে পুলিশ সদর দফতরে সংযুক্ত করা হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নবাবপুরের ২১৯ নম্বর বাড়িতে বাবা জমির উদ্দিনের সঙ্গে থাকতো আবেদ ও জাবেদ। তাদের আরও তিন ভাই ও দুই বোন রয়েছে। জায়গাটি জমির উদ্দিন তার বোনের কাছ থেকে পেয়েছিলেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। ইলেক্ট্রিশিয়ান জমির উদ্দিনের আর্থিক অবস্থা একসময় খুবই খারাপ ছিল। তবে তার ছেলেরা বড় হওয়ার পর অভাব কেটে যায়। জাল-জালিয়াতি করে অর্পিত সম্পত্তি দখল করে বহুতল ভবন তৈরি করে। মার্কেট বানিয়ে দোকান বরাদ্দ দিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নেয়।

নবাবপুর দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন মীম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আবেদ ও জাবেদকে আমরা এই এলাকায় খুব ছোট দেখেছি। তাদের ২১৯ নম্বর বাড়িতে আমি ছাত্রজীবনে ভাড়া ছিলাম। তার বাবা জমির উদ্দিন ইলেক্ট্রিশিয়ান ছিলেন। আবেদ-জাবেদ বড় হওয়ার পর তারা ২২০ নম্বর প্লটটি নিয়ে নেয়। একজন সাবেক জজের সঙ্গে শেয়ারে তারা দুই প্লট মিলিয়ে বহুতল ভবন করে। তবে জজ সাহেব চলে গেছেন। এখন পুরো বাড়ি আবেদ ও জাবেদ তাদের পরিবার নিয়ে থাকে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূলত বিএনপির শাসনামলে জাবেদ ও আবেদ রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ক্ষমতা দেখানো শুরু করে। ১৯৯৪ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি থেকে ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচন করে আবেদ। এরপর তারা দুই ভাই মেয়র সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে রাজনীতিতে যুক্ত হয়। কখনও ছাত্রদল, কখনও যুবদল করেছে তারা। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে দুই ভাই তাদের বাড়ির পাশের ২২০ নম্বর প্লট দখল করে। ১৯৯৪ সালে নিজেদের একতলা বাড়ি ভেঙে বহুতল ‘গাউছিয়া প্লাজা’ নির্মাণ করে।

নবাবপুর দোকান মালিক সমিতির অফিস সেক্রেটারি দেলোয়ার হোসেন খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২২০ নম্বর প্লটটি অর্পিত সম্পত্তি ছিল। এনামুল হক সাদি নামে এক ব্যবসায়ীর লিজ নেওয়া ছিল। চায়না মেশিন টুলস নামে একটি দোকান ছিল তার। তাকে জোর-জবরদস্তিতে বের করে দেওয়া হয়। এরপর জায়গা দখল নেয় আবেদ ও জাবেদ। রাতারাতি তারা সেখানে ভবন করে ফেলে। ওই ব্যবসায়ীকে আর এ এলাকায় দেখিনি।’

কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, নবাবপুরের ২২০ নম্বর প্লটের পাশেই ২২১ নম্বর প্লটটি। এটি তপন কুমার বসাক নামে এক হিন্দু ব্যক্তির ছিল। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবারসহ ভারতে চলে যান। এরপর আর ফেরেননি। পরে সরকার জমিটি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। এই বাড়িটি ১৯৭৪ সালে কুমিল্লার সাবেক জেলা প্রশাসক শহীদ শামসুল হকের মা মাসুদা খানমের নামে তৎকালীন সরকার বরাদ্দ দেন।

এই জমি বরাদ্দ পাওয়ার পর থেকে প্রতিবছর নির্ধারিত ফি দিয়ে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তারা এই বাড়িতে ছিলেন। মাসুদা খানম মারা যাওয়ার পর শামসুল হক খানের দুই ছেলে ফজলুল হক খান ও আজাহারুল হক খানের নামে ঢাকা জেলা প্রশাসক থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০১৮ সাল পর্যন্ত জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে লিজের টাকা জমা দেওয়ার আবেদন রয়েছে তাদের। কিন্তু ২০১৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে শহীদ বুদ্ধিজীবী এই পরিবারটিকে পুলিশের সহায়তায় উচ্ছেদ করা হয়।

শহীদ বুদ্ধিজীবী শামসুল হক খানের ভাতিজা শামসুল হাসান খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রাতের মধ্যে পুলিশের সহায়তায় আমাদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হলো। তিনতলা একটি বাড়ি ভেঙে ফেলা হলো। পুলিশ অপরাধীদের পক্ষ নিয়ে কাজ করলো। দখলের আগে বাড়ির সামনে আনসার মোতায়েন করেছিল।

এরপর রাতে পুলিশ। এভাবেই আমাদের উচ্ছেদ করা হয়। আমরা সবাইকে বিষয়টি জানাই। কিন্তু কোনও প্রতিকার পাইনি। সর্বশেষ আমরা আইজিপি’র কাছে লিখিত অভিযোগ করেছি। এরপর ডিসি ইব্রাহীম খানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো। কিন্তু এখনও ওসির বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।’ এ জন্য তারা ভয়ে আছেন বলে জানান।

এই শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারটিকে উচ্ছেদের আগে নবাবপুরের ২২২ নম্বর বাড়িটি দখল করে জাবেদ ও আবেদ। এই প্লটটিও (৮ কাঠা জমি) অর্পিত সম্পত্তি। মো. নুরুল হক নুরু নামে এক ব্যক্তির নামে এটি বরাদ্দ ছিল। তিনি পরিবার নিয়ে এখানেই থাকতেন। ২০১৪ সালে এই বাড়িটি দখল করে আবেদ ও জাবেদ। বর্তমানে বাড়িটির সামনে দুটি দোকান রয়েছে। পেছনে খালি জায়গা।

নুরুল হক নুরু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পুলিশের পাহারায় আমাকে উচ্ছেদ করা হয় ২০১৪ সালে। আমার নামে লিজ জমি তারা দখল করে নিয়েছে। জাল কাগজপত্র করে তারা এসব করে। আমারটা নেওয়ার পর এই শহীদ পরিবারের বাড়ি দখল করে। তারা দুই প্লট মিলিয়ে মার্কেট করবে বলে সাইনবোর্ড টানিয়ে দোকান বরাদ্দও দিয়েছে।

আমরা কিছু ভয়ে বলতে পারিনি। উল্টো আমার নামে মামলা দিয়েছে।’ পরে মামলা থেকে তিনি অব্যাহতি পেয়েছেন বলে জানান।তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ি ছাড়াও অনেক বাড়ি দখল করেছে তারা। এসব জায়গায় তারা বহুতল ভবন তৈরি করেছে।’

নবাবপুর রোডের ৩০ শতাংশ জমিই অর্পিত সম্পত্তি বলে জানিয়েছেন নবাবপুর দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন খান। তিনি বলেন, “এই অর্পিত সম্পত্তি দখল করে আবেদ ও জাবেদ একের পর এক বহুতল ভবন বানিয়েছে। ‘গাউছিয়া প্লাজা’ তাদের প্রথম বহুতল ভবন। এরপর তারা নবাবপুর রোডের ২৩৪, ২৩৫ ও ২৩৫সি প্লট দখল দিয়ে ৮ বছর আগে তৈরি করে ‘জাবিন টাওয়ার’।

গত বছর তারা নবাবপুর রোডে ৫৭ নম্বর প্লটে তৈরি করে ‘জমির উদ্দিন বয়লার মার্কেট’। এটিও অর্পিত সম্পত্তি। ২০১৮ সালে তারা ৫০ নম্বর নবাবপুর রোডে তৈরি করে বহুতল ‘জান্নাত প্লাজা’। এটিও অর্পিত সম্পত্তি ছিল। বরাদ্দ ছিল একজন মুক্তিযোদ্ধার নামে। তাকে বিতাড়িত করা হয়। এছাড়াও ৯৫৩ নবাবপুর রোডে রয়েছে তাদের ‘রহিমা প্লাজা’।”

আওলাদ হোসেন বলেন, ‘ তারা অর্পিত সম্পত্তিতে মার্কেট তৈরি করে দোকান বিক্রি করে দেয়। তারা টাকা তুলে নেয়। মার্কেট বানানোর আগেই দোকান বরাদ্দ নিয়ে টাকা তুলে নেয়। তাদের কোনও লোকসান নাই।’

আবেদ ও জাবেদের বিরুদ্ধে এরকম আরও অনেক অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয়দের কেউ তাদের পরিবারটিকে ভালো বলছে না। এ বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য ‘গাউছিয়া প্লাজা’য় গেলে এই প্রতিবেদককে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তাদের দুই ভাইয়ের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিয়েও বন্ধ পাওয়া গেছে।

আব্দুর রহিম নামে একজন ব্যবসায়ী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জমির উদ্দিন ছিলেন বিহারি। তারা পাকিস্তানি। পাকিস্তানি পরিবার হিসেবেই এলাকায় সবাই তাদের জানতো। তবে আবেদ ও জাবেদের জন্ম এখানেই, তারা এখানেই বেড়ে উঠেছে।’

আবেদ ও জাবেদ ১৯৯৪ সাল থেকে একটির পর একটি অর্পিত সম্পত্তির বাড়ি দখল করলেও পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। আদালতের অজুহাত দেখিয়ে পুলিশ ফৌজদারি অপরাধ এড়িয়ে গেছে।

অভিযোগকারী শামসুল হাসান খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা অভিযোগ করেছি সব জায়গায়, কোনও কাজ হয়নি। আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পাঁচ কোটি টাকার জিনিসপত্র নিয়ে যায় তারা। কিন্তু পুলিশ বলে চুরি হয়েছে। চুরির মামলা নেয় তারা। মামলা করার পর আবার পরের দিন তারা জামিন পেলো। দ্রুত বহুতল ভবনের কাজও শুরু করে তারা। পুলিশ টাকা খেয়ে এসব করেছে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা বংশাল থানার ওসি সাহিদুর রহমানকে জানিয়েছি, তৎকালীন ডিসি ইব্রাহীম খানকে জানিয়েছি। তারা আমাদের সহযোগিতা করেনি। উচ্ছেদের পর আমরা সবাইকে জানিয়েছি। কেউ পাশে আসেনি। পুলিশ যেখানে অপরাধীদের পাশে থাকে সেখানে অন্যরা আগাতেও সাহস পায় না।’

শহীদ পরিবারটি আইজিপি’র বরাবর প্রতিকার চেয়ে আবেদন করার পর ডিএমপির গঠিত কমিটি দখলের সত্যতা পায়। কমিটির প্রতিবেদন দাখিলের পর ডিসি ইব্রাহীম খানকে সামরিক বরখাস্ত করা হয়। তবে ওসি এখনও বহাল তবিয়তে আছেন। তিনি এখন ডিএমপির কোতোয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ। এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য তাদের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তারা কেউ কল রিসিভ করেননি। কৃতজ্ঞতা- বাংলা ট্রিবিউন


Exit mobile version