Site icon ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ

পৃথিবীর প্রথম মাল্টিন্যাশনাল


১৯৯৩-এর নভেম্বরে বিলেতের একটি স্কুলে আমার গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক রিচার্ড কেভিন বুলার্ড জিজ্ঞেস করলেন, পৃথিবীর প্রথম এবং সম্ভবত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কিংবা সবচেয়ে নিকৃষ্ট মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি কোনটি?

আমি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি নিয়ে পড়াশোনা করতে যাইনি, আমার বিষয় ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা। আমি নিরুত্তর থাকায় তিনি একটি ক্লু ধরিয়ে দিলেন। বললেন, এ কোম্পানিই তোমার দেশের ভূমি ব্যবস্থাপনা কাঠামোর ভিত্তি তৈরি করেছে।

আমি জিজ্ঞেস করি, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি?

তিনি বললেন, এক্সাক্টলি। করপোরেট গ্রিড কথাটা তুমি শুনে থাকতে পারো, কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ‘লোভ’ বর্ণনা করার মতো শব্দ অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, কলিন্স কিংবা অন্য কোনো ইংরেজি অভিধানে নেই। হাতেগোনা কয়েকজন মানুষের একটি কোম্পানি তোমাদের ভারত সাম্রাজ্যকে গিলে ফেলল। তোমরা তখন নিশ্চয়ই আঙুল চুষছিলে।

আঙুল চোষার গালটা সহ্য করতেই হলো। আমাদের ইতিহাস চর্চার একটি দুর্বল দিক হচ্ছে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ওপর আস্থাশীল থাকা, রবার্ট ক্লাইভের লোকজন ষড়যন্ত্র করেছে, তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন মীরজাফর, রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ—অমনি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যাসহ সমগ্র ভারত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দখলে চলে গেল। মূল বিষয় আমাদের প্রশাসনিক ব্যর্থতাই কোম্পানিকে সে সময়কার পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী সাম্রাজ্যকে গলাধঃকরণের সুযোগ করে দিয়েছে। যারা সন্দিহান ভারতীয় শশী থারুর এবং ব্রিটিশ উইলিয়াম ড্যালরিম্পল পড়ে দেখতে পারেন।

একদিন রিচার্ড (বিলেতি কেতায় স্যার কিংবা অধ্যাপক না বললে সমস্যা নেই) হাতে চারতলা ভবনের একটি ছবি নিয়ে তার বাংলাদেশী শিক্ষার্থীকে পূর্ব লন্ডনের ১২ নম্বর লিডেনহল স্ট্রিটে নিয়ে এলেন। তার হাতের ছবির সঙ্গে ভবনটির কোনো মিল নেই। তার হাতের ছবির ভবনটি ১৮৬১ সালে (রবীন্দ্রনাথের জন্মবর্ষ) গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। এখানে এখন লয়েড’স বিল্ডিং। প্রকৃতপক্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেই চারতলা সদর দপ্তরই ছিল ভারতবর্ষে রাজধানী। কলকাতা থেকে ৪ হাজার ৯৪৭ মাইল কিংবা দিল্লি থেকে ৪ হাজার ৯৬৯ মাইল দূরের এ ভবনে বসে কোম্পানির বোর্ড ভারতে নিযুক্ত কোম্পানির কর্মচারীদের (শীর্ষ কর্মচারী গভর্নর জেনারেল) মাধ্যমে যথেষ্ট সাফল্যের সঙ্গে ভারত শাসন করেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন দ্বিতীয় কোনো নজির নেই। কোম্পানির সে জায়গায় নির্মিত লয়েড’স বিল্ডিংও যথেষ্ট পুরনো, ব্রিটিশ সরকারের লিস্টেড বিল্ডিংয়ের একটি।

রিচার্ডের অনুরোধে আমার দ্বিতীয় তত্ত্বাবধায়ক রবার্ট হোম স্কুলের একটি পুরনো গাড়িতে চড়িয়ে নিয়ে গেলেন ডকল্যান্ড। এ ডকইয়ার্ডেই এসে থামত কোম্পানির পণ্যের জাহাজ। ১৯৯৩ সালেও ডকইয়ার্ডের যথেষ্ট চিহ্ন ছিল, পাশেই তৈরি হয়েছে অসাধারণ স্থাপত্য শৈলীর ক্যানারি ওয়ার্ফ। পরে উন্নয়নে এখন আর ডকের চিহ্নও নেই। নীল আর মসলিন থেকে শুরু করে টেরাকোটা আর মূর্তি সবই এ ডকে অবতরণ করেছে। সেকালে পৃথিবীতে সমৃদ্ধি ও প্রবৃদ্ধিতে এগিয়ে থাকা ভারতবর্ষ কোম্পানির কাছে জিম্মি হয়ে একসময় আফ্রিকার উপনিবেশের মতো “হোয়াইট ম্যান’স বার্ডেন” বা সাদা মানুষের বোঝায় পরিণত হয়। আবার দ্বিতীয় তত্ত্বাবধায়ক রবার্ট হোম (তখন তিনি প্রফেসর হননি, এখনো বেঁচে আছেন, অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস প্রফেসর) বললেন, লুটপাট যাই করুক ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ওয়াজ এ ব্লেসিং ফর ইন্ডিয়া’—ভারতের জন্য কোম্পানি রাজত্ব ছিল আশীর্বাদের মতো। তা না হলে তিনি মনে করেন ভারতের সামনে একটি পথই খোলা ছিল, আর তা হচ্ছে লর্ড ক্লাইভের বদলে ফ্রাঁসোয়া ডুপ্লে দিল্লির গদি দখল করতেন এবং ভারত শেষ পর্যন্ত ফরাসি কলোনি হতো। চন্দননগরের পতনের পর ফরাসিদের ভারত ছেড়ে পালাতে হয়; কোম্পানির সৈন্যরা একদিকে দেশীয় শত্রু দমন করে, অন্যদিকে তাদের বিদেশী শত্রুদেরও সাফল্যের সঙ্গে তাড়িয়েছিল।

একবার ভাবুন চীনের জ্যাক মা তার আলীবাবা কোম্পানির লোকজনকে দিয়ে গোটা আমেরিকা দখল নিয়ে নিয়েছেন। পরের কয়েক বছরের সরকারে ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান কেউ নেই, আছে আলীবাবা সরকার। আলীবাবা কোম্পানির লাঠিয়াল আমেরিকা চালাচ্ছে এবং সম্পদ যা কিছু আছে চীনগামী জাহাজে তুলছে, পরের ২০০ বছর তাই চলবে, একসময় যখন দেখবে আমেরিকা শাসন চালিয়ে যেতে হলে চীন থেকে টাকা আনতে হয়, তখন তারা সরে আসবে।

স্বদেশ স্বদেশ করিস কারে

বাঙালি হোক কী ভারতবর্ষের অন্য কোনো অবাঙালি হোক তারা কার দেশ নিয়ে স্বদেশ স্বদেশ করে? এ দেশের মালিক তো কোম্পানি। গোবিন্দ চন্দ্র দাস ঠিকই লিখেছেন:

“স্বদেশ স্বদেশ কচ্ছ কারে, এদেশ তোমার নয়

 

এই যে জাহাজ, এই যে গাড়ী, এই যে পেলেস, এই যে বাড়ী

এই যে থানা, জেহেলখানা—এই বিচারালয়,

লাট, বড়লাট তারাই সবে, জজ ম্যাজিস্ট্রেট তারাই হবে,

চাবুক খাবার বাবু কেবল ভোমরা সমুদয়—

বাবুর্চি, খানসামা, আয়া, মেথর মহাশয়।”

কিন্তু কোম্পানি এল কেমন করে?

বিলেতি কজন বণিক একত্রে একটি বাণিজ্যিক কোম্পানি গঠন করে সমুদ্র বাণিজ্যে পূর্বাঞ্চলে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৬০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর রানী প্রথম এলিজাবেথের কাছ থেকে ‘দ্য গভর্নর অ্যান্ড কোম্পানি অব মার্চেন্টস অব লন্ডন ট্রেডিং ইনটু দি ইস্ট ইন্ডিজ’ নামে চার্টার গ্রহণ করে। রানীও আগ্রহী ছিলেন, কারণ ইন্দোনেশিয়া ও মালাক্কা প্রণালিতে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মসলা বাণিজ্যের একচেটিয়াত্বের অবসান ঘটাতে চাচ্ছিলেন। ভারতের সঙ্গে তখন পর্তুগিজ বাণিজ্য শুরু হয়ে গেছে, কিন্তু পর্তুগিজ দস্যুবৃত্তি ও অবাধ্যতা ভারত সরকারও অপছন্দ করেছে এবং তাদের একটি শক্তিশালী প্রতিপক্ষ সৃষ্টি হোক এটা সরকার চেয়েছে। পর্তুগিজরা ব্রিটিশ বাণিজ্য জাহাজ বন্দরে ভিড়তেই দেয়নি। ১৬০৮ সালে ক্যাপ্টেন উইলিয়াম হকিন্স সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবার পর্যন্ত পৌঁছেন। অনেক প্রচেষ্টার পর ১৬১২ সালে কোম্পানি সুরাট বন্দরে বাণিজ্যের অধিকার লাভ করে। ১৬১৫ সালে টমাস রো ব্রিটিশ রাজা প্রথম জেমসের দূত হিসেবে পর্যাপ্ত উপঢৌকনসহ রাজদরবারে হাজির হন এবং সম্রাটের সন্তুষ্টি অর্জন করে সুরাটে কুঠি নির্মাণের অনুমোদন লাভ করেন। ১৬৩৯ সালে নিজস্ব দুর্গ স্থাপনের অনুমতিও পেয়ে যায় কোম্পানি। বাংলায় কুঠি নির্মাণের অনুমতি দেয়া হয় ১৬৩৩ সালে, ১৬৬৮ সালে কুঠি স্থাপিত হয় ঢাকায়। গোবিন্দপুর, সুতানুটি ও কলকাতার পত্তন নিয়ে জব চার্নক শহরের গোড়াপত্তন করেন। শতাব্দীর শেষে ১৬৯৮ সালে এ কোম্পানি তাদেরই স্বদেশীয় একটি কোম্পানির প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হয়—সে কোম্পানির নাম ‘দি ইউনাইটেড কোম্পানি অব মার্চেন্টস অব ইংল্যান্ড ট্রেডিং টু দি ইস্ট ইন্ডিজ।’ দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে একটি ঐতিহাসিক ‘মার্জার’ বা একীভূত হওয়ার ঘটনা ঘটে ১৭০২ সালে। এটির বিশ্ববাণিজ্যের ইতিহাসে প্রথম দিককার একটি মার্জার। নতুন কোম্পানির নাম হয় ‘দি ইউনাইটেড কোম্পানি অব মার্চেন্টস অব ইংল্যান্ড ট্রেডিং টু দি ইস্ট ইন্ডিজ’—কালক্রমে এটিই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। ১৭১৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর জারি করা মোগল সম্রাট ফাররুখশিয়রের ফরমানই মূলত কোম্পানিকে অবাধ বাণিজ্যের সুযোগ দেয় এবং বাংলা সরকারের প্রতিপক্ষ করে তোলে।

১৬০০ : কোম্পানি প্রতিষ্ঠা

১৬০৮ : সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারে ক্যাপ্টেন হকিন্সের আগমন

১৬১২ : সুরাট বন্দরে বাণিজ্য করার এবং বাণিজ্য কুঠির স্থাপনের অনুমোদন লাভ

১৬১৩ : কোম্পানির প্রথম কুঠি স্থাপন

১৬১৬ : মুসলিপাট্টামে কোম্পানির শাখা স্থাপন

১৬৩৩ : হরিপুরের বালামোরে কুঠি স্থাপন

১৬৩৯ : মাদ্রাজের ইজারা লাভ, বাণিজ্যের অনুমতি গ্রহণ, দুর্গ নির্মাণের আবেদন অনুমোদিত

১৬৫১ : নির্ধারিত শুল্ক প্রদান করে বাংলায় বাণিজ্যের অনুমতি

১৬৫৮ : কাশিমবাজারে কুঠি স্থাপন

১৬৬২ : ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস পর্তুগিজ রাজকন্যাকে বিয়ে করে যৌতুক হিসেবে মাদ্রাজের অধিকার পান

১৬৬৭ : বাংলায় বাণিজ্যের জন্য সম্রাট আওরঙ্গজেবের ফরমান লাভ

১৬৬৮ : ঢাকায় কুঠি স্থাপন

১৬৮৭ : কোম্পানির সদর দপ্তর সুরাট থেকে বোম্বেতে আনয়ন

১৬৯১ : কোম্পানির বাংলা সরকারের দস্তক (শুল্কের বিনিময়ে অবাধ বাণিজ্য) লাভ

১৭০২ : একীভূত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সৃষ্টি

১৭৫৭ পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অবস্থান সংহত করে রাষ্ট্রীয় কাজে হস্তক্ষেপ করে, সরকারের অবাধ্য হয়, ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতি অবলম্বন করে। ২৩ জুন ১৭৫৭ পলাশীর যুদ্ধে সিরাজদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে কার্যত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কোম্পানির কাছে হস্তান্তরিত হতে শুরু করে ১৭৬৫-তে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি ও রাজস্ব অধিকার করে কোম্পানির অনাচার ও লুণ্ঠনের সংবাদ বিলেতে পৌঁছে। কোম্পানির অনাচার বহুসংখ্যক বিদ্রোহ ও আন্দোলনের সূচনা করা। ১৮৫৭-এর সিপাহি বিদ্রোহের পর ১৮৫৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘটানো হয় এবং সমুদয় রাষ্ট্রক্ষমতা ব্রিটেনের কাছে ন্যস্ত হয়। তার পরও ভারতবর্ষ আরো ৯০ বছর ব্রিটিশ উপনিবেশ হিসেবে রয়ে যায়। যদি কৃতিত্ব বা দোষ যেভাবেই দেখা হোক—অবশ্যই তা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। বণিকই হয়ে ওঠে ভারতবাসীর অধিশ্বর। তারাই রাজদণ্ড ধারণ করেছে।

মাল্টিন্যাশনাল প্রথম কোম্পানি

পৃথিবী বহুজাতিক কোম্পানির শাসনাধীন। সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জীবনের নিয়ন্ত্রণ এসব কোম্পানির হাতে। এ কালের বহুজাতিক বা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ—করপোরেট লোভ, শেয়ারমূল্যের বুদবুদ এবং পশ্চিমের সাম্রাজ্যবাদ—অষ্টাদশ শতাব্দীতে সব অভিযোগই উত্থাপিত হয়েছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে। ২০০৭ সালে পলাশীর ২৫০ বছর পূর্তির পর পলাশীর ঘটনাসহ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারত বিজয় ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা ইংরেজরাও করেছে। নিক রবিন্সের রচনা The world’s First Multinational থেকে খানিকটা অনুসৃত হচ্ছে:

আহমদনগর ফোর্ট কারাগারে থাকার সময় জওহরলাল নেহেরু যে ‘কারা ট্রিলজি’ রচনা করেছিলেন, ১৯৪৪ সালে লিখিত ট্রিলজির শেষটিতে এবং সম্ভবত শ্রেষ্ঠটিতে তিনি ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন সম্পর্কে রায় দিয়েছেন কোম্পানি শাসকদের শুরুর প্রজন্মের দুর্নীতি, লালসা, স্বজনপ্রীতি, সহিংসতা ও অর্থলোলুপতা কল্পনাকেও হার মানিয়ে দেয়; এমনকি সেই সময় একটি হিন্দুস্তানি শব্দ ‘লুট’ ইংরেজি ভাষার অংশ হিসেবে অভিধান ঠাঁই লাভ করে।

ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হওয়ার পরবর্তী ৬০ বছরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায়। লন্ডন শহরে যেখানে ২০০ বছরেরও অধিককাল ধরে কোম্পানির সদর দপ্তর অধিষ্ঠিত ছিল সেখান কোনো ফলক রাখা হয়নি। এটাকে গবেষক ও সাম্রাজ্যবাদী রোমান্টিকদের জন্য ইতিহাসের পাতায় চালান দেয়া হয়েছে। কিন্তু বিশ্বায়নের সূচনায় কম্পোনির প্রতি আগ্রহ পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠেছে। বিশ্ববাণিজ্যে কোম্পানি অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছে। অনারেবল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সুখ্যাতি জানাতে অনেকেই এগিয়ে এসেছেন। কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতাদের মাস্তান অভিযাত্রী হিসেবে অভিনন্দন জানানো হয়েছে, কারণ তাদের হাতেই আধুনিক ভোক্তাবাদের জন্ম আর কোম্পানির নির্বাহীরা চিহ্নিত হয়েছেন বহু সাংস্কৃতিক অভিধা ‘সাদা মোগল’ হিসেবে।

রোমান্টিকরা যা-ই মনে করুন না কেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমাদের জন্য রেখে গেছে গভীর ও বিচলিত করা কিছু শিক্ষা। বাজার শক্তির অপব্যবহার, করপোরেট লোভ, বিচারিক দণ্ডমুণ্ডতা, বাজার নিয়ে অযৌক্তিক উচ্ছ্বাস, ঐতিহ্যপ্রবণ অর্থব্যবস্থার বিনাশ— এর কোনোটাই নতুন নয়। বিশ ও একুশ শতকের শুরুর দিককার ধনবাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ, সেগুলো দুই শতাব্দী আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের কাছে ম্লান হয়ে যায়। ১৭৭৬ সালে প্রকাশিত দ্য ওয়েলথ অব নেশনস এ অ্যাডাম স্মিথ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে কেস স্টাডি হিসেবে ব্যবহার করে দেখিয়েছেন একচেটিয়া কারবার কেমন করে স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারকে ক্ষুণ্ন করে এবং শেয়ারহোল্ডার নিয়ন্ত্রিত করপোরেশনের কী পরিণতি ঘটে। এ কালের মুক্তবাজারের যারা প্রবক্তা, তাদের ভাষণে করপোরেশন নিয়ে অ্যাডাম স্মিথের সন্ধিগ্ধতা, একচেটিয়াবাদ প্রতিষ্ঠায় শেয়ারহোল্ডারদের প্রচেষ্টা এবং দোষযুক্ত শাসন ব্যবস্থার কোনো উল্লেখই পাওয়া যায় না।

স্মিথ যে অবাধ বাণিজ্যের চিত্র দেখাতে চেয়েছেন, তাতে করপোরেটের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা হয়েছে। অ্যাডাম স্মিথের সময় এবং তার পরবর্তীকালে এ সত্য প্রতিষ্ঠিত হযেছে যে নিয়ন্ত্রণহীন করপোরেট দানব হয়ে ওঠে। অর্থনৈতিক প্রগতি নিশ্চিত করতে হলে করপোরেটকে এতটাই নিয়ন্ত্রণ করা দরকার যেন জোগানদারকে শোষণ করতে না পারে এবং ভোক্তারও গলা টিপতে না পারে। তার রাজনৈতিক শক্তিও যতটা সম্ভব হ্রাস করতে হয়। নতুবা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো ইম্পেরিয়াল করপোরেট ‘ইম্পেরিয়াল ডিজাস্টার’ ডেকে আনে। উইলিয়াম ড্যালরিম্পল তার দি অ্যানার্কি: ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, করপোরেট ভায়োলেন্স, অ্যান্ড দ্য পিলেজ অব অ্যান এম্পায়ার বইয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৃষ্ট নৈরাজ্যের কথা তুলে ধরেছেন। তিনি মনে করেন ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে অনালোচিত অধ্যায় হচ্ছে কোম্পানি শাসনকাল।

তিনি মনে করেন একালের সফল বহুজাতিক কোম্পানি গুগল কিংবা ফেসবুককে তার বাণিজ্য রক্ষা ও সম্প্রসারণের জন্য সেনাবাহিনী লালন করতে হয় না। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দুর্গ বানাতে হয়েছে, সেনাবাহিনী গঠন করতে হয়েছে।

ড্যালরিম্পল বলেছেন, এ ধরনের বণিক কোম্পানি লুটতরাজ করারই কথা, এটা তাকে বিস্মিত করে না কিন্তু তিনি বিস্মিত হয়েছেন ১৭৭০-এর বাংলার মন্বন্তরে কেবল রাস্তার ওপর যখন এক লাখ অভুক্ত মানুষের লাশ, আকাশ ছেয়ে গেছে শকুনে, ঠিক তখনই কোম্পানি বোর্ড শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ ১০ থেকে সাড়ে ১২তে উত্তীর্ণ করেছে। কেরানি ক্লাইভ যেমন করে প্রধান সেনাপতি হয়েছেন, বিলতে গিয়ে লর্ড হয়ে এসেছেন—এ হচ্ছে ভিন্ন এক লর্ড—‘লর্ড ভালচার’—মহামহিম শকুন।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রায় সবাই কমবেশি ‘লর্ড ভালচার’। তাদের কীর্তির কারণেই ভারত ইংরেজি অভিধানে একটি শব্দ দান করতে পেরেছে, সেই শব্দটি হচ্ছে Loot। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতা দিয়ে উপসংহার টানি—

কোথা রৈলে মা বিক্টোরিযা মা গো মা

কাতরে কর করুণা

মা তোমার ভারতবর্ষে, সুখ আর নাহি স্পর্শে,

প্রজারা নহে হর্ষে, সবাই বিমর্ষে।

 

আন্দালিব রাশদী: কথাসাহিত্যিক


Exit mobile version