Site icon ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ

প্রকাশ্যেই চলে ট্রেনের তেল চুরি


নিজস্ব প্রতিবেদক, চাঁপাইনবাবগঞ্জ :

চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমনুরা জংশন ও বাইপাশ স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় প্রকাশ্যে ট্রেনের ইঞ্জিন থেকে প্রতিদিন শত-শত লিটার তেল চুরি হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। দীর্ঘদিন ধরে সংঘবদ্ধ একাধিক সিন্ডিকেট সুকৌশলে তেল চুরি করে আসলেও ব্যবস্থা নিচ্ছে না রেল বিভাগ। অভিযোগ উঠেছে সরকারের লাখ লাখ টাকার তেল চুরির সঙ্গে জড়িত খোদ ট্রেনের চালক ও নিরাপত্তাকর্মীসহ রেলবিভাগের অনেকেই।

অনুসন্ধানে জানাগেছে, স্টেশনে প্রবেশের আগেই চলন্ত ট্রেন থেকে লাইনের ধারে ফেলে দেয়া হয় তেলভর্তি পলিথিনের বস্তা। প্রতিটি বস্তায় থাকে অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ লিটার তেল। আগে থেকে ঘাপটি মেরে থাকা তেল চোর চক্রের সদস্যরা সবার সামনে দিয়েই সেই তেলের বস্তা মোটরচালিত ভ্যান বা ভুটভুটিতে নিয়ে যায়। এদিকে প্রকাশ্যে রেলের তেল চুরি হলেও কিছুই বলে না জিআরপি পুলিশ ও ফাঁড়ি পুলিশ।

তেল চোরদের ধরতে কোন ভূমিকাই নেই রেলের নিরাপত্তা বাহিনী, জিআরপি পুলিশ ও আমনুরা পুলিশ ফাঁড়ির। তাদের ম্যানেজ করেই সংঘবদ্ধ তেলচোর চক্র প্রতিদিনই তেল চুরি করছে। অভিযোগ রয়েছে, রেলের অনেক ঊর্ধ্বতন কর্তার পকেটে যায় চুরি করে বিক্রি করা এই তেল টাকার ভাগ।

ট্রেনের ইঞ্জিন থেকে তেল চুরি হচ্ছে এটি স্বীকার করছেন রেল কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়রা। স্থানীয়দের তথ্যমতে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমনুরা রেল জংশন ও বাইপাস স্টেশনে একাধিক সংঘবদ্ধ চক্র প্রতিদিনই ট্রেনের ইঞ্জিন থেকে তেল চুরি করছে। ট্রেনের ইঞ্জিন থেকে চুরি হওয়া তেল বিক্রি হচ্ছে পার্শ্ববর্তী ঝিলিম বাজারের বেশ কয়েকেটি দোকানে। অত্র এলাকায় তেল চুরির ঘটনা এখন ওপেন সিক্রেট।

ঝিলিম বাজারে তেল বিক্রেতা সাহিনের জানান, প্রায় দেড় মাস আগে ট্রেনের ইঞ্জিন থেকে চুরি হওয়া তেল বিক্রি করতেন তিনি। তিনি কয়েকজন চুরি হওয়া তেল বিক্রেতার তথ্য দিয়ে জানান, এরা প্রত্যেকেই স্থানীয় তেল চোর চক্রের কাছ থেকে তেল নিয়ে খোলা বাজারে তা বিক্রি করে।

প্রায় দুই বছর আগে র‌্যাব-৫ রাজশাহীর একটি অভিযানিক দল কয়েকশ লিটার তেলসহ তেলচোর চক্রের বেশ কয়েকজনকে আটক করে। আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে এসে চক্রটি আবারো জড়িয়ে পড়েছে তেল চুরির কাজে।

তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে তেল চুরি করছে স্থানীয় ৩০জন চোর

সংঘবদ্ধ এই তেল চোর চক্রটির নেতৃত্বে রয়েছেন সোহেল নামে এক স্থানীয় ব্যক্তি। এর নেতৃত্বে আমনুরার মালেক, বাবু, আজিজুল, হারুন, রবিউল, কামাল, ফারুকসহ প্রায় ৩০ জন চোর তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে রেলের তেল চুরি করছেন। এদের মধ্যে মালেক, বাবু ও রবিউল একেকটি গ্রুপের লিডার। তেল চোরের সর্দার সোহেল রেলের নিরাপত্তাবাহিনী, জিআরপি পুলিশ, ফাঁড়ির পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থাকে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা চাঁদা নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র বলছে, বেশির ভাগ ট্রেনচালকই এই চোর চক্রের সঙ্গে জড়িত। ট্রেনের ইঞ্জিন থেকে চুরি হওয়া তেল ঝিলিম বাজারের সাহিন, মনিরুল ও মোক্তারের দোকানে বিক্রি হয়।

আমনুরা রুটে যে ট্রেনগুলো থেকে তেল চুরি যায়

আমনুরা রেল জংশনের একটি সূত্র জানায়, দুটি কমিউটর ট্রেন এই রুটে চলাচল করে। কমিউটর ৫৭ নং ট্রেন সকাল ১০ট ২৫ মিনিটে এসে রহনপুর অভিমুখে ছেড়ে যায়, ৫৮ নং হয়ে রাজশাহী অভিমুখে দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে ছেড়ে যায়। কমিউটর ৭৭ নং ট্রেন বিকেল ৪টা ৪ মিনিটে এসে রহনপুর অভিমুখে ছেড়ে যায়, ৭৮ নং হয়ে রাজশাহী অভিমুখে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ছেড়ে যায়। ৫৬৩ নং ট্রেন সকাল ৭টা ১৭ মিনিটে এসে ৭টা ২১ মিনিটে রহনপুর অভিমুখে ছেড়ে যায়।

৫৮২ নং ট্রেন সকাল ৯টা ৬ মিনিটে এসে ৯টা ১১ মিনিটে চাঁপাইনবাবগঞ্জ অভিমুখে ছেড়ে যায়। ৫৮১ নং ট্রেন বিকেল ৫টা ৩২ মিনিটে এসে ৫টা ৩৫ মিনিটে রহনপুর অভিমুখে ছেড়ে যায়। ৫৬৪ নং ট্রেন সন্ধ্যা ৭টা ৫৭ মিনিটে এসে ৮টা ২ মিনিটে ঈশ্বরদী রুটে ছেড়ে যায়। অন্যদিকে সাটল ট্রেন রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ যাত্রা করে। এটি আমনুরা বাইপাশ স্টেশনে এসে পৌঁছায় ৫টা ৪৫ মিনিটে। রাজশাহী মেইল ৬ নং পাওয়ারকার সকাল সাড়ে ৮টায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। আর এসব ট্রেনের ইঞ্জিন থেকে সংঘবদ্ধ তেলচোর চক্র তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে তেল চুরি করে থাকে।

অভিযোগের পক্ষে বিপক্ষে বক্তব্য

আমনুরা রেল জংশনের স্টেশন মাস্টার খাইরুল আলম জানান, ট্রেনের ইঞ্জিন থেকে তেল চুরির খবর তিনি শুনেছেন। তবে স্টেশন এলাকায় নয়, স্টেশন এলাকার বাইরে। স্টেশন এলাকার বাইরে তেল চুরি হওয়ায় তারা কোন ব্যবস্থা নিতে পারছেন না বলেও জানান তিনি।

ট্রেনের ইঞ্জিন থেকে তেল চুরি হচ্ছে স্বীকার করে আমনুরা বাইপাশ রেল স্টেশন মাস্টার শহিদুল আলম বলেন, এটি নিরাপত্তা বাহিনী ও প্রশাসনের বিষয়। আমি পরিবহন বিভাগে কর্মরত এ স্টেশনে আসা ট্রেন গ্রহণ করবো এবং যথাসময়ে ছাড়বো এটিই আমার কাজ। তেল চুরির ঘটনা সরাসরি দেখলেও আমাদের কিছুই করার নেই। নিরাপত্তা বাহিনী, জিআরপি পুলিশ কোনটিই আমাদের নিয়ন্ত্রণে নয় বলে জানান তিনি।

আমনুরা রেল জংশনের জিআরপি পুলিশের উপ-পরিদর্শক শফিক আল রাজী তাদের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমরা প্লাটফরমভিত্তিক ডিউটি করে থাকি। স্টেশন প্লøাটফরমের মধ্যে তেল চুরির ঘটনা ঘটে না। স্টেশনে তেল চুরির ঘটনা ঘটলে অবশ্যই তাদের আটক করা হবে।

আমনুরা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক জাহাঙ্গীর জানান, রেলের বিষয়টি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তাদের আলাদা নিরাপত্তা বাহিনী রয়েছে। ট্রেনের ইঞ্জিন থেকে চুরি হওয়া তেল আমনুরা পুলিশ ফাঁড়ি সংলগ্ন বাজারে প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে বিষয়টি জানেন কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রেলের চুরি হওয়া তেল বাজারে বিক্রির খবরটি আমার জানা নেই।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলের এক কর্মকর্তা বলেন, রেলের প্রায় সব ধরনের উন্নয়ন ও অর্থ ব্যয়ে তদারকি থাকলেও জ্বালানি তেল ব্যবহারের ক্ষেত্রে তদারকি নেই। তেল চুরির সিন্ডিকেটটি শক্তিশালী হওয়ায় বিভিন্ন সময় তদন্ত কমিটি করেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। ইঞ্জিন ব্যবহারের দক্ষতা ও তদারকি বাড়ানোর মাধ্যমে জ্বালানি তেলের ব্যবহার ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনা গেলে প্রতি বছর রেলের প্রায় শতকোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব।


Exit mobile version