প্রতুল মুখোপাধ্যায় : খালি গলার গানের জাদুকর


এম এ আমিন রিংকু:

প্রতুল মুখোপাধ্যায়, সর্বজন নন্দিত ভারতীয় গায়ক; সংগীত যাত্রা শুরু করেন প্রায় চার দশক আগে। একটি লক্ষ নিয়ে তিনি আজও তাঁর যাত্রা অব্যাহত রেখেছেন তা হল ‘সমস্ত আলোচনা এবং যুক্তি শেষ হওয়ার পরে সংগীত মানবতার পক্ষে দাঁড়াবে’। মানবতাবাদী এ শিল্পী খালি গলায় কোন বাদ্যযন্ত্র  ছাড়াই গান গেয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন জাদুকরের মত। 

প্রতুল মুখোপাধ্যায় : খালি গলার গানের জাদুকর

জন্ম ১৯৪২ সালে অবিভক্ত বাংলার বরিশালে। বাবা প্রভাতচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন সরকারি স্কুলের শিক্ষক ও মা বাণী মুখোপাধ্যায় ছিলেন গৃহিণী। দেশবিভাগের সময়  পরিবারের সাথে চলে যান ভারতে। সেখানে শৈশব কেটেছে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার চুচুড়ায়। ছোটবেলা থেকেই নিজের লেখা ও সুরে গান গাইতেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে কবি মঙ্গলচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘আমি ধান কাটার গান গাই’ কবিতায় প্রথম সুরারোপ করেন। নিজের লেখা গানের পাশাপাশি ছড়া, কবিতায়ও তিনি বিভিন্ন সময় সুরারোপ করেছেন। গাইতে গাইতে শিখেছেন, গুরু মেনেছেন ‘সবাইকে’, অভাবের কখনো ‘অভাব হয়নি’। বাজনাহীন সেই অভাবের দুনিয়ায় পথ খুঁজতে খুঁজতে গায়কীর যে কায়দা রপ্ত করেছেন, তাতেই তিনি হয়ে উঠেছেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়।

প্রতুল মুখোপাধ্যায় খালি গলার গানের জাদুকর

বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের কাছে প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের সবচেয়ে পরিচিত গান সম্ভবত ‘আমি বাংলায় গান গাই’। তবে এপার-ওপারের লোকগান আর গণসংগীতের সুর যাদের কানে গেছে, তাদের অনেকেই প্রতুলের কণ্ঠের ‘লং মার্চ’ শুনে পৌঁছে গেছেন বিপ্লবের চীনে। ‘ছোকড়া চাঁদের’ সঙ্গে আফ্রিকার খনি শ্রমিকের রাতভর কী কথা- সে গল্প প্রতুল তাদের শুনিয়েছেন। ‘ছোট্ট দুটি পায়ে’ চার্লি চ্যাপলিনের সঙ্গে তিনি শ্রোতাকে দুনিয়া ঘুরিয়েছেন; ‘স্লোগান’ গানে বুঝতে শিখিয়েছেন, কে ভাই, আর কে দুশমন। এক সময়ের নকশাল আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী, নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন কলেজের প্রাক্তন শিক্ষক, ইউনাইটেড ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার স্ট্যাটিসটিকস অ্যান্ড লং রেঞ্জ প্ল্যানিং বিভাগের সাবেক প্রধান ব‌্যবস্থাপক প্রতুল গানকেই করেছেন সমাজ বদলের হাতিয়ার। আটাত্তরে পা রাখা এই গানের কবির ভাষায়, গান তিনি গান না, বলেন।

প্রতুল মুখোপাধ্যায় : খালি গলার গানের জাদুকর

তাঁর ‘আমি বাংলায় গান গাই’ ছাড়াও ‘আলু বেচো, ছোলা বেচো’, ‘ডিঙা ভাসাও সাগরে’, ইত্যাদি অসংখ্য গান বাঙালীর মনে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। তিনি বাংলা চলচ্চিত্র গোঁসাইবাগানের ভুত-এর প্লেব্যাকে কন্ঠ দিয়েছেন। তাঁর গানে, সুরে মানুষের বিভিন্ন সময়, নানান পরিস্থিতির যে আবেগের সমন্বয় ঘটেছে তা প্রতুল মুখােপাধ্যায়কে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগীতকারের আসন গড়ে দিয়েছে। ৬০ এর দশকে প্রতুল কমিউনিস্ট আন্দোলনে শরীক হন এবং নিজের গানকে পরিণত করেন প্রতিবাদ, আন্দোলন আর জাগরণের শক্তিতে। কোনরকম বাদ্যযন্ত্র ছাড়া গান গেয়ে লক্ষ মানুষকে উন্মাতাল করে দেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়।

নিজের গান সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি কখনো গান শিখিনি, মানে কোনো ওস্তাদ ধরে গান শেখা হয়নি। যখন গণসংগীত লিখেছি বা সুর করেছি, তার মূল উৎস্য ছিল আমার শোনা গান। সারা জীবন যত গান শুনেছি, তা দিয়েই আমার গান। কাব্যগীতি, হিন্দি ফিল্মের গান, বাংলা আধুনিক গান, জাপানিসহ বিভিন্ন ভাষার গান থেকে আমি উপাদান গ্রহণ করেছি। আমার বাড়িতে দশ বছরের ছোট্ট যে সহায়িকা ছিল, সেও তো আমার গুরু। ছোটবেলায় সংস্কৃত পড়তাম। তার একটা অদ্ভুত গাম্ভীর্য ছিল, আমি তাকে নিয়েছি। সেতার শুনেছি, সেতারের গৎ গলায় তুলেছি। যখন যা অনুভব করেছি, তখন ওই উপাদানগুলো নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। এর সবকিছু মিলেছে আমার গানে।’

প্রতুল মুখোপাধ্যায় : খালি গলার গানের জাদুকর

বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার না করার পেছনেও প্রতুল মুখোপাধ্যায় এর কিছু যুক্তি রয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যন্ত্র মানুষকে গান শুনতে বাধ্য করে। আমি চাই আমার গান মানুষ তার ইচ্ছা আর আগ্রহ নিয়ে শুনুক। চাপিয়ে দেয়া কোনো কিছুর ফল কখনো ভালো হয় না। তাই আমি আমার শ্রোতাদের সব সময় উন্মুক্ত রাখতে চাই।’

প্রতুল মুখোপাধ্যায় জীবনে, কর্মে, সাধনায় অন্যান্য গণসংগীতশিল্পীদের চেয়ে একটু ভিন্ন বৈকি। তিনি অত্যন্ত সাদাসিধে জীবন যাপন করেন। প্রযুক্তির এই যুগেও তিনি মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না। তাকে কেউ কখনো কোনো জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পড়তে দেখেননি। খদ্দরের পাজামা আর সুতি পাঞ্জাবি- এই হলো তার সব সময়ের পোশাক। গণমানুষের এই শিল্পী কোনো পুরস্কার পাননি। তবে তিনি পেয়েছেন অজস্র সংগীতপ্রেমী মানুষের ভালোবাসা। এই তার সবচেয়ে বড় পুরস্কার।

 

প্রতুল মুখোপাধ্যায় এর গাওয়া আমি বাংলায় গান গায় শুনুন এখানে

 

আরও পড়তে পারেন  জহির আশফাকের কবিতা ‘আমি ঈশ্বরের কথা শুনিনি’

 


শর্টলিংকঃ