ফকির-সন্ন্যাসীর স্ববিরোধী জঙ্গনামা


আঠার শতকের শেষার্ধে কোম্পানির আগমনে বিচলিত-পরিবর্তিত বঙ্গদেশে বয়ে যাওয়া ফকির-সন্ন্যাসীর বিদ্রোহের দমকা হাওয়া বাঙালি সমাজে দীর্ঘকাল ধরেই গুরুতর ছাপ ফেলে গেছে। ১৭৬০ সালে বিচ্ছিন্ন বিদ্রোহের সলতে পাকানো শুরু হলো, আর তা দানা বাঁধল তিন বছর পর ১৭৬৩ সালে। মূলত এর পর থেকেই বাংলার ইতিহাস চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ হিসেবে যেমন, তেমনি তত্পরবর্তীকালে বিবিধ সাহিত্যকর্মেও এক অনিবার্য উপাদান হিসেবে উপস্থিত থেকেছে ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন।

বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান কুশীলব মাদারিয়া তরিকার সুফিসাধক থেকে যোদ্ধা বনে যাওয়া ফকির মজনু শাহ স্বভাবতই বাংলার জনমানসে এক স্থায়ী আসন নিয়েছেন, তা ‘ফোক হিরো’ বা হঠকারী বিদ্রোহী যে হিসেবেই হোক না কেন। ফলে তাকে নিয়ে আঠারো-উনিশ শতকের বাংলায় পুঁথি বা গাথাকাব্য লেখাও হয়েছে একাধিক। পুঁথি-গবেষক অণিমা মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ১৮১৩ সালে জনৈক পঞ্চানন দাসের লেখা ‘মজনুর কবিতা’ শীর্ষক একটি গাথায় কীভাবে মজনু শাহর যোদ্ধা চরিত্রের বিষয়টি কবুল করা হলেও শেষমেশ প্রধান উপজীব্য হয়ে উঠেছিল তার নেতৃত্বে সংগঠিত বিদ্রোহের ‘কালাপাহাড়ি’ চরিত্রের কথা। কবিতাটির কয়েকটি লাইন এ রকম: ‘শুন সবে একভাবে নৌতুন রচনা।/ বাঙ্গলা নাশের হেতু মজনু বারনা\/ কালান্তক যম বেটা কে বলে ফকির।/ যার ভয়ে রাজা কাঁপে প্রজা নহে স্থির\’ এখানে ‘কালান্তক যম বেটা কে বলে ফকির’ পঙিক্তটি লক্ষণীয়। অর্থাৎ ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ‘পিক আওয়ার’ অতিবাহিত হওয়ার পর এ অপরিচিত কবির মনে মজনু শাহর ফকিরি চালচলন আর মুখ্য থাকছে না। তার চেয়ে বরং তার রুদ্রমূর্তিই তাকে অধিক তাড়িয়ে ফিরছে। অবশ্য এ কবিতায় মজনু শাহর প্রশংসাও লভ্য এমতরূপে: ‘সাহেব সুভার মত চলন সুঠাম। আগে চলে ঝাণ্ডা বাণ ঝাউল নিশান\/ উট ঘোড়া হাতী কত বোগদা সঙ্গতি।/ জোগান তেলেঙ্গা সাজ দেখিতে ভয় অতি\/ চৌদিকে ঘোড়ার সাজ তীর বরকন্দাজি।/ মজনু তাজির পর যেন মরদ গাজি\/ দলবদল সব দেখিয়া আক্কেল হৈল গুম।/ থাকিতে এক রোজের পথ পড়্যা গেল ধূম\/’ উপর্যুক্ত বয়ানে অবশ্য দেখা যায় কবি মজনু শাহর রণদক্ষতা ও বীরত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তিনি যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে এক আকাঙ্ক্ষিত পৌরুষের প্রতীকও, তা-ও যেন প্রচ্ছন্ন ‘মজনু তাজির পর যেন মরদ গাজি’ লাইনে।

কিন্তু মজনুর বাহুবল কবুল করে নিলেও পঞ্চানন দাস শেষমেশ ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহকে নিঃশর্ত সমর্থন দিতে পারেন না। কেন? তার জবাব পেতে নজর দেয়া যাক কবিতাটির পরবর্তী কয়েকটি লাইনে: ‘বড়ই দুঃখিত হৈল পলাইব কোথা।/ মন দিয়া শুন সবে লোকের অবস্থা\/ যেদিন যেখানে যায়্যা করেন আখড়া।/ একেবারে শতাধিক বন্দুকের দেহড়া\/ সহজে বাঙ্গালী লোক অবশ্য ভাগুয়া।/ আসামী ধরিতে ফকির যায় পাড়া পাড়া\’ বোঝা যায়, নবাবি শাসনের পতনের পর ইংরেজ কোম্পানির স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ফকির-সন্ন্যাসীদেরও কোম্পানির সমান অত্যাচার-লুটপাটের প্রবণতায় নিজেদের ভাসিয়ে দেয়ার ঘটনাগুলো জনমানসে খুব একটা ভালো চোখে স্বভাবতই দেখা হচ্ছিল না। পঞ্চানন দাস কবিতায় আরো লিখেছেন—ফকির-সন্ন্যাসীরা গ্রামে এসেছে শুনলেই ‘পাছুয়া ব্যাপারী পলায় গাছে ছাড়্যা গুড়’, নারীরা ‘সর্বস্ব ঘরে থুয়্যা পাথারে দেয় নড়…পলায় ছাড়ি কোলের ছাওয়াল’, কৃষক ‘ছাড়িয়া পলায় লাঙ্গল জোয়াল’ আর ধনীরা ‘পলায় সঙ্গে লয়্যা দাসী’। সাধারণ মানুষের এ পলায়নপর্বের মধ্যেই ফকির-সন্ন্যাসীরা জটার মধ্যে লুট ধনসম্পদ বা দামি বস্তু নিয়ে প্রস্থান করে। এটুকু লিখেও অবশ্য পঞ্চানন দাস ক্ষ্যান্ত হননি। বিদ্রোহীরা কীভাবে গ্রাম লুট করত তার বর্ণনাও দিয়েছেন: ‘থাল লোটা লইল না পাইল উদ্দিশ।/ টাকার নালছে চিরে শিওরের বালিশ\/ আলদা মাটী দেখি ফকির করে পোচপোচ।/ টাকার লাগি যে মারে বাস্কর খোট\/ মহাজনের সিন্দুক কাড়ি টাকা লইল ঝাড়া।/ আগে লুটে বাড়িঘর পাছে আড়াপাড়া\’ বালিশ চিরে, মেঝের মাটি খুঁড়ে অর্থলুটের এ বর্ণনা পড়লে একে ঠিক ফকির-সন্ন্যাসীদের কাজ বলে মালুম হওয়া মুশকিল। তবে পঞ্চানন দাস এ কবিতার শেষে খেদ করেছেন এ বলে, ‘প্রকৃত ফকিররা’ মজনু শাহর এসব কর্মকাণ্ডের সমর্থক নন। তারা এসব কাণ্ডের কথা শুনে কানে হাত দিয়ে নিন্দা জানিয়ে বলেন ‘ফকির হইয়া কর ছাগলের কাজ।/ পরিণামে দুঃখ পাবা ঈশ্বর সমাঝ\’ আর মজনু শাহর অধীন নকল ফকিররা এসব না শুনে ‘হাত বাড়ায় যৌবনে’ অর্থাৎ নারীদের নিপীড়নের পথ বেছে নেয়। তা দেখে ওই ‘সুজন ফকির’গণ ‘ধর্ম্ম সাক্ষী করি তারা মজনুকে শাপে…তারা বলে ঈশ্বর এহি করুক।/ মজনু গোলামের বেটা শীঘ্র মরুক\/ কোন দেশ থেকে হইতে আইলো অধম।/ ইহাকে ভারতে থুয়্যা পাশরিছে যম\’

সমালোচকরা কেউ কেউ বলতে পারেন, পঞ্চানন দাশের কবিতা আদতে ‘হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদে’ দুষ্ট—বিশেষ করে মজনু শাহর প্রতি তার ক্ষোভ ও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিবৃত ‘ফকিরদের সমালোচনা’ অনেকটাই অতিরঞ্জিত বা কষ্টকল্পিত। কিন্তু এ কথা এড়িয়ে গেলে সত্যের অপলাপ হবে যে ফকির-সন্ন্যাসীদের নানাবিধ নেতিবাচক তত্পরতার সমালোচনা কেবল বাঙালি হিন্দু সমাজে সীমাবদ্ধ ছিল না। সাধারণ ছাপোষা-নিরীহ বাঙালি মুসলমানরাও এদের হঠকারী কর্মকাণ্ডের কারণে জানমালের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। ফকির-সন্ন্যাসীদের লুটপাটের কারণে বাংলার সব শ্রেণী ও ধর্মের সাধারণ মানুষই কমবেশি যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তা ইতিহাসবিদ আনন্দ ভট্টাচার্যের গবেষণায় সুস্পষ্টরূপে উঠে এসেছে। ফকিরি ঘরানার লোকজন লুটতরাজ করতে নেমে সাধারণ মুসলিমদেরও রেহাই দেয়নি। অন্যপবেক্ষ, ক্ষ্যাপা সন্ন্যাসীদের দ্বারা সাধারণ হিন্দু পুণ্যার্থীদের বিপদে পড়ার বর্ণনা দিয়েছেন বগুড়ার নারুলি গ্রামের অধিবাসী কবি দ্বিজ গৌরীকান্ত। সেকালে করতোয়া নদীর তীরে বিশেষ তিথিতে ‘পৌষ নারায়ণী স্নান’-এর আয়োজন করা হতো। কিন্তু এক বছর সেখানে হানা দেয় সশস্ত্র সন্ন্যাসীর দল। পুণ্যার্থীরা পালিয়ে বাঁচেন। ১৮১৪ সালে প্রকাশ পাওয়া ‘মহাস্থানগড়ের ছড়া’ শিরোনামের এক পদ্যে তিনি সেই বিরূপ পরিস্থিতির বর্ণনা এভাবে জানান: ‘পৌষমাসের সোমবার অমাবস্যার ভোগ।/ মূলা নক্ষত্রেতে পাইল নারায়ণী যোগ\/…মঙ্গলবারের দিন আইল ছয় শত সন্ন্যাসী\…তারা কাশীবাসী, মহাঋষি, ঊর্ধ্ববাহুর ঘটা।/ সন্ন্যাসী আইল বল্যা লোকের পড়্যা গেল শঙ্কা।…/ হাজারে হাজারে বেটারা লুট করিতে আইসে।…/ বেটাদের অস্ত্র আছে, রাখে কাছে, বন্দুক সাঙ্গি তীর।/ তরার চিমীঠা, খাপে ঢালে ঢাকা শির\’ এক্ষেত্রে দেখা যায়, স্বধর্মী হলেও বা ‘মহাঋষি’ বলে আখ্যায়িত করলেও সন্ন্যাসী দলের হাঙ্গামার নিন্দা করতে দ্বিজ গৌরীকান্ত একবিন্দুও পিছপা হননি।

এর পাশাপাশি সমকালে মজনু শাহর অবিমিশ্র প্রশংসা করে লেখা একটি খণ্ডিত পুঁথিও নজরে আসে। ১৮১৩ সালে রচিত এ কাব্যের লেখক জমিরুদ্দীন দফাদার, তিনি ছিলেন বীরভূম জেলার অধিবাসী। কবিতার নাম ‘মজনু শাহের হাকিকত’। উল্লেখযোগ্য আকারে এটি তার সমকালে ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন প্রসঙ্গে লেখা পূর্বোক্ত অন্য দুই কবিতার থেকে আগাপাশতলা আলাদা—এ মন্তব্য আনন্দ ভট্টাচার্যের। এ কবিতার পূর্বাংশ বস্তুত এক আধ্যাত্মিক বয়ান। যেখানে মজনু শাহ দুই পীর কুতুব ও বাহরামের কাছ থেকে আশীর্বাদ লাভের আশায় তাদের খানকায় যান এবং পরে ‘ইনছানের সেবায়’ নামার সংকল্প করেন: ‘খানকার খাদিম ছিল এক বুড়া পির।/ তেনারে সালাম দিল মজনু ফকির\/খাদিম মজনুর দেহে বুলাইল হাত।/ পুহঁছ করিলেন কিছু পুশিদাই বাত\/ কহিলেন, থাক বেটা খুশি যত দিন।/ ইনছানের সেবা কর নিজে হইয়া হীন\’ কীভাবে ‘ইনছানের সেবা’ করতে নামলেন মজনু? বাংলা মুুলুকে কোম্পানি ও জমিদারের অনাচারের কথা শুনে ‘শুনিয়া কাঁদিল পির হইয়া বেহাল’—তাই তিনি তত্ক্ষণাৎ মজনুকে নির্দেশ দিলেন: ‘দল বাঁধো নাগাদের সাথে।/ তলওয়ার লহ বেটা জনে জনে হাতে\/ হানা দাও গঞ্জে গঞ্জে আনো চাল ধান।/ ভুখাদের খেদমতে সঁপে দাও প্রাণ\’ পীরের পরামর্শে মজনু শাহ মাঠে নামলেন এবং ‘জুটিল মজনুর সঙ্গে হাজার ফকির।/ দেখিতে দেখিতে হইল ফকিরের ভিড়\/ সন্ন্যাসী ও নাগা সাথে গাঁও আদমিজন।/ কাছারিতে হানা দেয় খাদ্যের কারণ\/ তেনাদের সাথী হইল খারিজি লস্কর।/ লুটিল তাহারা কত জমিদার ঘর\’ মজনু শাহ ও তার বাহিনীর তত্পরতা শুরুর পর যে ইংরেজ ও ফিরিঙ্গি বণিকরা বিপদে পড়েছিল এমন তথ্যও দেন দফাদার: ‘কোম্পানির কত কুঠি লুঠ হইয়া গেল।/ রাজার সিপাহি বহু গায়েব হইল\/ মজনুর হুংকারে কাঁপে ত্রিভুবন\…/ তরাসে ফেরঙ্গগণ চুন করে মুখ।/ রাইয়ত হিম্মত পায়, ভাবে যাবে দুখ\/ ধন্য ধন্য করে সব মজনুর নামে।/ জমিদার লোক সব প্রাণভয়ে ঘামে\/ দেশে দেশে রটে গেল মজনুর যশ।/ যেই পথে যায় সব প্রজা হয় বশ\/ কামারের মূল হাসি পাইল সুদিন।/ তৈরি হয় কর্মশালে অস্ত্র রাতদিন\’

আগেই বলেছি, পঞ্চানন দাস ও দ্বিজ গৌরীকান্তের বয়ানের সঙ্গে জমিরুদ্দীন দফাদারের কবিতার পার্থক্য চোখে পড়ার মতো। এখানে মজনু শাহ যেন এক ‘রবিনহুড’ বা ‘সুপারম্যান’-এর সমতূল্য। ব্যক্তিত্বের সম্মোহনী আকর্ষণে দলে দলে লোকে তার সঙ্গে জুটে যায়, তিনি অত্যাচারী বড়লোকের ধন লুঠ করে গরিবকে বিলিয়ে দেন, মানুষের জন্য অন্নের ব্যবস্থা করেন, তার ভয়ে ইংরেজ কাঁপে, বণিক-জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য তার অনুসারীরা দিনরাত কামারশালায় অস্ত্র বানায়—এমন সব বর্ণনা মজনুর ‘বীরবীর্য্যে বলীয়ান’ ভাবমূর্তিকেই প্রতিষ্ঠিত করতে চায়।

মুশকিল হলো ইতিহাসে সরল সত্যের দিশা পাওয়া মুশকিল। মজনু শাহ ও ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের বীরত্বগাথার সাফল্য যতই নানাভাবে প্রচারিত হোক—তা সাধারণ জনতার বিদ্রোহ বা আরো নির্দিষ্ট অর্থে বাঙালির গণ-আন্দোলনের অংশ কী কৃষক বিদ্রোহ ছিল—এমনটা কখনই নয়। আবার ফকির-সন্ন্যাসীদের নিছক গুণ্ডাপাণ্ডাও বলা যায় না। বরং একে বিদ্রোহ, ধর্মোন্মাদনা ও অরাজকতার এক হঠকারী ‘ককটেল’ বলা যেতে পারে, যার সঙ্গে কিনা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলার সাধারণ মানুষের কোনো সংযোগ ছিল না। কিন্তু সাহিত্য-প্রণেতারা ইতিহাসের এ জটিলতার দিকে চোখ না ফিরিয়ে একতরফা বয়ানই হাজির করেছেন। হয় তা ফকির-সন্ন্যাসীদের প্রতি আবেগে থরোথরো, নয়তো ভয়ে জড়সড়। পঞ্চানন দাস, দ্বিজ গৌরিকান্ত ও জমিরুদ্দীন দফাদার প্রণীত এ তিন খণ্ড কবিতার ক্ষেত্রেও কথাটা প্রযোজ্য। এসব কবিতা রচিত হওয়ার বহু পর প্রকাশিত ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ নিয়ে লেখা দুই কালের দুই আলোচিত উপন্যাস—বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’ এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ও এ সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। এও এক নির্মম বাস্তবতা।

 

মুহিত হাসান: নন-ফিকশন লেখক


শর্টলিংকঃ