বগুড়ায় কিশোর গ্যাং: স্কুলব্যাগে বইয়ের সঙ্গে থাকে মাদক ও ছুরি


বগুড়ায় সেভাবে গ্যাং কালচার গড়ে না ওঠলেও অভিভাবকদের অবহেলা-প্রশ্রয়ে কিশোর অপরাধ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। উঠতি ধনী পরিবারের অনেক কিশোর সমাজের বোঝা হয়ে উঠেছে।

রেজিস্ট্রেশন ও লুকিং গ্লাসবিহীন বিকট শব্দের সাইলেন্সার লাগানো মোটরসাইকেলে চেপে চোখে সানগ্লাস, মুখে হালকা ফার্স্ট দাড়ি, গলায় চেইন, টি-শার্ট ও থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরা কিশোররা শহরের গার্লস স্কুল-কলেজ ও কোচিং সেন্টারসংলগ্ন এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।

এদের বিরুদ্ধে খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, মাদক ব্যবসাসহ ভয়ানক অপরাধের অভিযোগ। ৩১ জুলাই পর্যন্ত গত ৬ মাসে আদালতের নির্দেশে জেলা কারাগার থেকে ৩০ জনকে যশোরের পুলেরহাটে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে।

এদের কেউ কেউ স্কুল ব্যাগ ব্যবহার করলেও ভেতরে বই-খাতার সঙ্গে থাকে মাদক ও চাকু। এরা শিক্ষিকা, অভিভাবক, পথচারী, কর্মজীবী নারী ও গৃহবধূদেরও উত্ত্যক্ত করে থাকে।

এদের একজন আবির আহমেদ বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে এখন ঢাকায় কোচিং করছে। বাবা তৌহিদুল ইসলাম এনএসআই কর্মকর্তা ও চাচা পুলিশের এসপি।

প্রায় ১৬ মাস আগে শহরের জলেশ্বরীতলার ব্যবসায়ী হাসানুল মাশরেক রুমনের ছোট মেয়ে অসুস্থ হয়। প্রতিবেশী এ আবির আহমেদ তাকে রক্ত দেয়ায় দুই পরিবারের মাঝে সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

এ সুযোগে রুমনের বড় মেয়ে দ৬শম শ্রেণীর ছাত্রী মায়িশা ফাহমিদা সেমন্তীর (১৫) সঙ্গে আবিরের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেমন্তীর দুর্বলতার মুহূর্তে আবির তার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলে।

বিশেষ মুহূর্তের ছবি ভিডিও করে বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ারও করে। এসব ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টায় সেমন্তী তার মায়ের কাছ থেকে মাঝে মাঝেই মোটা অংকের টাকা নিত। কিন্তু আবির এসব ছবি একপর্যায়ে ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়। লজ্জা-ক্ষোভে ১৭ জুন সেমন্তী আত্মহত্যা করে।

সেমন্তীর বাবা রুমন এজন্য আবিরকে দায়ী করে সদর থানায় দুটি অভিযোগ করেন। প্রমাণ হিসেবে তিনি পুলিশের কাছে মেয়ের মোবাইল ফোন, সিম ও মেমোরি কার্ড তুলে দেন। আবিরের বাবা তার ছেলের মোবাইল ফোন, সিম ও মেমোরি কার্ড পুলিশের কাছে দেননি।

রুমনের অভিযোগ, পর্যাপ্ত প্রমাণ দেয়ার পরও আবির পুলিশ পরিবারের সদস্য হওয়ায় কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। তবে তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সুমন জানান, সেমন্তীর মোবাইল ফোন, সিম ও মেমোরি কার্ড ঢাকার সিআইডি কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট আসেনি।

ময়নাতদন্ত রিপোর্টও পাওয়া যায়নি। সেমন্তীর বাবা কারও নাম উল্লেখ করেননি। তাই কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হচ্ছে না।

তবে আবিরের বাবা তৌহিদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেছেন, আবির কোনোভাবেই এ ঘটনায় দায়ী নয়। তবে আবিরের মোবাইল ফোন, সিম ও মেমোরি কার্ড শিগগির তদন্তের স্বার্থে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করব।

বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর শাহজাহান আলী এ প্রসঙ্গে জানান, কিশোর অপরাধ ও ইভটিজিং বৃদ্ধির মূল কারণ অভিভাবকদের সচেতনতার অভাব। ঠিকভাবে নজরদারি হচ্ছে না। এর জন্য শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষও দায়ী।

সামাজিক এ অবক্ষয় থেকে রেহাই পেতে সবাইকে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হবে। নচেৎ অপরাধ বাড়বে। বগুড়া সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) সনাতন চক্রবর্তী জানান, এ জেলায় নির্দিষ্ট কোনো কিশোর গ্যাং নেই।

তবে কিছু দুষ্ট কিশোর মাঝে মধ্যে নিজেদের নানা অপরাধে জড়িয়ে ফেলছে। কিশোর গ্যাং যাতে গড়ে উঠতে না পারে সে ব্যাপারে বগুড়ার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যাপক তৎপর ও সজাগ রয়েছে।

বগুড়ার সারিয়াকান্দির পূর্ব টেংরাকুড়া গ্রামের ১৫-১৬ বছর বয়সী তিন বন্ধু আবদুর রহিম, আলী মিয়া ও রাসেল মিয়ার নজর পড়ে প্রতিবেশী এক কিশোরীর ওপর। প্রস্তাব দিয়ে ব্যর্থ হয়। ১২ জুন দুপুর ২টার দিকে ওই কিশোরী গ্রামের দোকান থেকে খাবার কিনে বাড়ি ফিরছিল।

পথে তিন কিশোর তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুখ চেপে পাটক্ষেতে নিয়ে যায়। আবদুর রহিম ধর্ষণ করে ও অন্য দু’জন সহযোগিতা করে। লোকজন চলে আসায় তারা পালিয়ে যায়। এ ব্যাপারে তার মা থানায় মামলা করলে পুলিশ তিন কিশোরকে গ্রেফতার করে।

সারিয়াকান্দি থানার ওসি আল-আমিন জানান, ধর্ষণের সত্যতা পাওয়া গেছে। পরে আদালতের নির্দেশে তাদের যশোরের পুলেরহাটে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে।

বগুড়া শহরের ফুলবাড়িতে মোজাম্মেল হকের ছেলে ইসমাইল হোসেন আশিক নবম শ্রেণীতে পড়ার সময়ই অপরাধে জড়ায়। প্রতিপক্ষকে দমনে পারদর্শী হয়ে ওঠায় সে পরিচিতও পায়। এরই জেরে ২০০৭ সালের ১৭ জুন শহরের শিববাটিতে বন্ধু রাহিদ ও সুজনকে কুপিয়ে হত্যা করে আশিক।

পুলিশ তাকে গ্রেফতারও করে। ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দিলেও কিশোর হওয়ায় তাকে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। কয়েক বছর পর ৫ জনের সঙ্গে আশিকও পাইপ বেয়ে পালিয়ে যায়। গত দু’বছরে মাদক মামলায় সে ৩ বার গ্রেফতার হয়।

ফুলবাড়ি পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইন্সপেক্টর শফিকুল ইসলাম পলাশ বলেন, জোড়া খুন, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে আশিক এখন ভয়ংকর অপরাধী।

শাজাহানপুর উপজেলার খোট্টাপাড়া ইউনিয়নের নারিল্যা গ্রামের মতিউর রহমান মাস্টারের ছেলে নাজিউর রহমান নাহিদ (১৮) এ বছর বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। কলেজ ও কোচিং সেন্টারে যাতায়াতের সুবিধার্থে ছেলের আবদারে বাবা কষ্ট করে মোটরসাইকেল কিনে দেন।

এরপর কয়েকজন বখাটের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। সহপাঠীর সঙ্গে প্রেমেও জড়িয়ে পড়ে। প্রেম নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে তার দূরত্ব সৃষ্টি হয়। বন্ধু রিয়াদ হুমকি দিচ্ছিল নাহিদকে। এ নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদে সালিশও হয়।

নাহিদ ১৯ এপ্রিল দুপুরে শাজাহানপুরের কমর উদ্দিন ইসলামিয়া কলেজ কেন্দ্রে পরীক্ষা দিয়ে মোটরসাইকেলে সহপাঠী বন্ধু জাহিদকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিল।

পথে অপর মোটরসাইকেলে আসা ৩ বন্ধু নাহিদকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। মামলার পর রিয়াদ, রবিউল, নীরব ও সুমন নামে ৪ বখাটেকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

বগুড়ার প্রথম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পিপি অ্যাডভোকেট নরেশ মুখার্জি জানান, অভিভাবকদের অসচেতনতা, অবহেলা ও প্রশ্রয়ের কারণে কিশোর অপরাধ বাড়ছে। তাদের জেলে আটকে রেখে বিচার করা যায় না, জামিনের বিধান আছে।

পুলিশের বিশেষ কিছু করার থাকে না। সন্তানদের প্রতি অভিভাবকদের খেয়াল নেই। কিশোর অপরাধ কমাতে বাবা-মা ও অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে।

বগুড়ার গাবতলী উপজেলার গোলাবাড়ি গ্রামের জুয়েলারি ব্যবসায়ী ইন্তেজার রহমানের ছেলে নাইম ইসলাম (১৮) বেসরকারি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে টেক্সটাইলের ছাত্র ছিলেন। কোচিংও করছিলেন। যাতায়াতের সুবিধার্থে বাবা অ্যাপাচি মোটরসাইকেল কিনে দেন।

এ মোটরসাইকেল হাতিয়ে নিতে বন্ধুরা নাইমকে খুনের পরিকল্পনা করে। গত বছর ১৫ নভেম্বর সারিয়াকান্দিতে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে ডেকে নিয়ে নাইমকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে আলামত লুকাতে লাশে আগুন ধরিয়ে দেয়।

লাশটি উদ্ধার করে গ্রেফতার করা হয় মনিরুজ্জামান, অনন্ত, বিশু, শ্রাবণ ও আতিককে। এদের মধ্যে দু’জন ছাত্র।

বগুড়ার নিশিন্দারা উপশহরে বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর আগমন ঘটে এ পল্লীতে। সুবিল ও ফুলবাড়ি এলাকাতেও সরকারি আজিজুল হক কলেজ, সরকারি মুজিবুর রহমান মহিলা কলেজ, ভাণ্ডারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ছাড়াও কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।

এছাড়া শহরের অভিজাত আবাসিক এলাকা ও শপিংমলে ভরা জলেশ্বরীতলা এলাকাতে শতাধিক কোচিং সেন্টার এবং ইয়াকুবিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়সহ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। বিভিন্ন উপজেলা থেকেও শত শত শিক্ষার্থী পড়তে আসে।

ছুটি হওয়া পর্যন্ত এখানে টি-শার্ট, সানগ্লাস পরে কিশোররা দামি মোটরসাইকেলের লুকিংগ্লাস খুলে রেখে উচ্চ শব্দের সাইলেন্সার লাগিয়ে বীরদর্পে ঘোরাফেরা করে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, কিশোরের অনেকের পিঠে ব্যাগের ভেতর বইয়ের সঙ্গে ধারালো অস্ত্র ও মাদক থাকে।

এরা ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করে। শিক্ষিকা, নারী অভিভাবক ও অফিসগামী নারীরাও রেহাই পান না। ১২ এপ্রিল সজীব নামে এক যুবক প্রতিবাদ করলে তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে রক্তাক্ত করে এরা। সূত্রঃ যুগান্তর


শর্টলিংকঃ