- ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ - https://universal24news.com -

বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রের আদ্যোপান্ত


হৃদয়ে ৭১ টিম:

দীর্ঘ ৯ মাস নয়, প্রায় দুই যুগের সংগ্রামের পর ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় ছিনিয়ে আনে বাংলার মানুষ। পরাজিত হয় পকিস্তান। কিন্ত, যুদ্ধ শেষ হলেও চক্রান্ত শেষ হয় না।

বাংলাদেশের জন্মের পরপরই শুরু হয়ে যায় সদ্যজাত এই দেশের বিরুদ্ধে পরাজিত পক্ষের ষড়যন্ত্র। স্বাধীনতার আগে থেকেই ছদ্মবেশী বিভীষণরা তো ছিলই, এবার সাথে যুক্ত হল যুদ্ধে পরাজিত পক্ষ। বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে যখন ওরা বাধ্য হল, তখনই বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ হয়ে দাঁড়াল সমার্থক। যতদিন বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন, বাংলাদেশকে ততদিন পথচ্যুত করা যাবে না, এই ভাবনা থেকেই ষড়যন্ত্রীদের প্রধান নিশানা হয়ে দাঁড়ান বঙ্গবন্ধু।

পাকিস্তান থেকে মুক্তি পেয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু। একটি যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ, খাবার নেই, কাপড় নেই, গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে পাকিস্তানিরা, কলকারখানা ধ্বংসপ্রাপ্ত, রাস্তাঘাট বিপর্যস্ত, ব্রীজগুলো সব ধ্বসে গেছে যুদ্ধে, ৩০ লক্ষ শহীদের পরিবার, অধিকাংশ পরিবারের উপার্জনক্ষম পুরুষেরা মৃত, প্রায় ৪ লক্ষ ধর্ষিতা মা-বোনের আহাজারি, আরো হাজারো সমস্যা সাথে নিয়ে শুরু হয় দেশ গড়ার কাজ। কিন্তু দেশী ও বিদেশী পরাজিত শক্তি ঠাণ্ডা মাথায় তাদের পরিকল্পনা চালিয়ে যেতে থাকে।

মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা সেনাদের দ্বন্দ্ব, রক্ষীবাহিনী-সেনাবাহিনীর দ্বন্দ্ব, মন্ত্রিসভার ভিতরের লোকদের শত্রুতা, পাকিস্তানপন্থীদের ষড়যন্ত্র, ক্ষমতার লোভ, ইত্যাদি চলতে থাকে পাশাপাশি। আওয়ামীলীগের নেতাদের সাথে সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্যর কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে কেউ কেউ ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু বিষয়টা মোটেও এতো সামান্য ছিল না।

ব্রিটিশ পত্রিকা সানডে টাইমসের সাংবাদিক এন্থনি মাস্কারেনহাসের নেওয়া ইন্টারভিউয়ে ফারুকের বিবৃতিতে জানা যায় সে ১৯৭৪ সালে বলেছিল যে মুজিবকে উৎখাত করতে চায়। অথচ তার আগেই ডালিম-ফারুক দুই ভায়রাকে মার্কিন দূতাবাসে দেখা যায়। তারও আগে ফারুক কে ‘৭২-এ মার্কিন দূতাবাসে দেখা যায়।

খুনী কর্নেল ফারুক ও কর্নেল রশীদের ইন্টারভিউ

ফারুক ১৯৭৩ সালে একটি অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। কুমিল্লা থেকে সেনাদল আসার কথা ছিল। কিন্তু ওরা না আসতে পারায় সেটি বানচাল হয়ে যায়। ফারুকের কাছে তখন ৩ টি ট্যাংক ছিল। সেগুলো দিয়েই সে অভ্যুত্থান করতে চেয়েছিল। কিন্তু অবাক ব্যাপার হল এসব জানাজানির পরেও তাকে সরানো হয় নি; বরং ‘৭৪-এ মিশর থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া ৩২ টি ঞ-৫৪ ট্যাংকের দায়িত্ব সেই ফারুকের হাতেই দেয়া হয়।

ভারতের সাবেক কূটনীতিক শশাংক ব্যানার্জি তার বইয়ে লিখেছিলেন জিয়া ১৯৭৩ সালে আমেরিকায় ৬ সপ্তাহের জন্য ট্রেনিং-এ গেলে সেখানে পাকিস্তানের পুরনো বন্ধুদের সাথে কথা হয় যাদের সাথে সে আগে ট্রেনিং করেছিল। পাকিস্তানের মিলিটারি এটাচি ও সিআইএ-এর সাথে জিয়ার আলোচনা হয়। যেহেতু সেসময় এটা প্রচারিত ছিল যে সিআইএ বা আইএসআই বঙ্গবন্ধুর জন্য ঝুঁকিপূর্ন সেহেতু জিয়ার সাথে তাদের দুজনের বৈঠক বিশেষ ইঙ্গিতবাহী। পরবর্তীতে ইন্দিরা গান্ধী সতর্ক করলে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন –

“ওরা আমার ছেলের মত।”

“দি বাংলাদেশ মিলিটারি ক্যু এন্ড সিআইএ লিংক” বইয়ে জানা যায় আমেরিকার সাথে ডালিম ভিন্ন ভিন্ন দুইটি তারিখে অভ্যুত্থানের টার্গেট করেছিল। একটি মার্চে অন্যটি আগস্টে। লজিস্টিক সাপোর্ট টেস্টিং ফেইল করায় মার্চের অপারেশনটি ব্যার্থ হয়। মার্কিন দূতাবাস থেকে ৮ পাতার একটি রিপোর্টে এই তথ্য পাওয়া যায়। সেখানে আরও বলা হয় দেরী করলে অভ্যুত্থান পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যেতে পারে এবং ভারতীয় ও সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা মুজিবকে জানিয়ে দিতে পারে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করা হয়। ভারতীয় গোয়েন্দা প্রধান ঢাকা এসে মুজিবকে এসব জানালেও তিনি গুরুত্ব দেননি। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, কোন বাঙালি তাঁর বুকে বুলেট মারতে পারেনা।

১৯৭৫ এর ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাসে অভ্যুত্থানের কথা চালাচালি করে আমেরিকা ও ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। ‘ফ্রিডম অব ইনফরমেশন অ্যাক্ট’-এর আওতায় ২০১০ সালে প্রকাশিত গোপন নথি থেকে জানা যায় ৭৫ এর ২০ মার্চ ঢাকা ও দিল্লির মার্কিন দূতাবাসে একটি বার্তা পাঠায় আমেরিকার পররাষ্ট্র দপ্তর। সেখানে বলা ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মার্চ ২১ থেকে এপ্রিল ১৮ তারিখের মধ্যে একটি অভ্যুত্থান করবে। এ ব্যাপারে দুই দূতাবাসের মূল্যায়ন জানতে চাওয়া হয়। কাকতালীয় হলেও সত্য এদিনই মুজিব হত্যার অন্যতম পরিকম্পনাকারি কর্নেল ফারুক অভ্যুত্থানের ব্যাপারে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ জিয়ার সাথে দেখা করে। জিয়াকে তারা জানায় তাদের পরিকল্পনার কথা। চায় তার সমর্থন এবং নেতৃত্ব। জিয়া খুনীদের পক্ষে মত দিয়ে জানিয়ে দেয় তাঁর সমর্থনের কথা এই বলে-

“সিনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে আমি এই ধরণের কর্মকান্ডে জড়িত হতে পারি না। তোমরা জুনিয়র অফিসাররা এটা করতে চাইলে এগিয়ে যাও।”

ফারুক রহমান সিআইডি কে দেয়া জবানবন্দিতে জানায় জিয়া ১৫ আগস্টের আগে ফারুকের বাসায় গিয়ে তাদের পরিকল্পনার বিষয়ে খবর নেয়। পরে দেখা যায় হত্যার খবর শাফায়াত জামিল জিয়াকে জানালে খবর শুনে জিয়া নির্লিপ্তভাবে বলেছিলেন

“সো হোয়াট, প্রেসিডেন্ট ইজ ডেড? ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ দেয়ার। গেট ইয়োর ট্রুপস রেডি। আপহোল্ড দ্য কনস্টিটিউশন।”

‘৭৬-এর জুলাইতে সানডে টাইমসের সাংবাদিক এন্থনি মাস্কারেনহাস বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে জিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। জিয়া তখন এই সাংবাদিক যাতে বাংলাদেশে আর না আসতে পারে সেই ব্যাবস্থা করে।

বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়াউর রহমানের জড়িত থাকার প্রমাণ

উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের তারবার্তা-এর বদৌলতে আরো জানা যায় বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনার কথা মার্কিন দুতাবাস আগে থেকেই জানত। শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর কয়েকজন সৈন্যই নয় শুরু থেকেই খন্দকার মোশতাক ছিল মুল পরিকল্পনাকারীর একজন। কর্নেল রশিদের সাক্ষাতকার থেকে জানা যায়, সে আগস্টের প্রথম সপ্তাহেই খন্দকার মোশতাকের সাথে দেখা করে তাদের পরিকল্পনার কথায় জানায়। এরপর আগস্টের ১৩ এবং ১৪ তারিখেও তাদের বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠক হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে খন্দকার মোশতাকের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকার আর পাকিস্তানের মাঝে একটা সমঝোতার পরিকল্পনা করেছিল, যেটা হলে বাংলাদেশ আর স্বাধীন হত না, এমন তথ্যও এই ডকুমেন্টে প্রকাশ পেয়েছে। সবচাইতে ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে এটি যে, বঙ্গবন্ধু খুনের সাথে মার্কিন মুল্লুকের হয়তো সরাসরি হাতই ছিল। কারণ, উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া মার্কিন দুতাবাসের এই গোপন নথি হতে জানা যায় নভেম্বর ১৯৭৪ – জানুয়ারি ১৯৭৫ এর মাঝে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সাথে মার্কিন দুতাবাসের কর্মকর্তাদের বেশ কয়েকদফা মিটিংও হয়।

পরিকল্পনামত আগাতে থাকে কাজ। কে ছিল না বঙ্গবন্ধুর এই হত্যার সাথে জড়িত? যাদের হাতে বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার দায়িত্ব ন্যাস্ত ছিল, তাদের ভিতরের অনেকেই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল এই হত্যাকান্ডের সাথে। মুল প্রতিরোধ আসতে পারে রক্ষীবাহিনীর পক্ষ থেকে, তাই রক্ষীবাহিনীর ডিজি’কে ট্রেনিং-এর নামে লন্ডন পাঠিয়ে দেয়া হয় আগেই। আবার, এরই মাঝে উএঋও ক্যান্টনমেন্ট থেকে সন্দেহের ভিত্তিতে একজনকে আটক করে, যার কাছে হত্যাকাণ্ডের পুরো পরিকল্পনা জানা যায়। এই রিপোর্টটি উএঋও প্রধান আব্দুর রউফ বঙ্গবন্ধুর কাছে দেন। কিন্তু ভয়ংকর ব্যাপার এটা যে, এই টপ সিক্রেট চিঠির সারাংশ ডালিমের বাসায় ফোন করে জানায় প্রেসিডেন্সিয়াল সেক্রেটারিয়েটের কেউ না কেউ। সর্ষের মাঝে ভুত, নাকি পুরোটাই ভুতের আড্ডাখানা ছিল, সেটি বোঝা বড় দায়।

যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়ায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের নিউজ কাভারেজ

বলা হয় মুজিব ৩২ নম্বরের বাড়ি ছেড়ে বঙ্গভবন যেতে রাজি ছিলেন না। বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষের মত জীবনযাপন করতে পছন্দ করতেন, তাই তিনি বঙ্গভবনের আলিশান রীতিনীতিতে যেতে পছন্দ না-ও করতে পারেন। কিন্তু, প্রশ্ন হল যেহেতু তিনি ৩২ নাম্বারেই থাকতেন, সেই ৩২ নাম্বারের বাড়িটিকে নিরাপদ করার যথেষ্ট ব্যাবস্থা কি নেয়া হয়েছিল? দায়িত্বের গাফিলতি কিংবা ষড়যন্ত্রের অংশীদারিত্ব ঢাকতে তারা দোষারোপ করেছেন একে অপরকে। শাফায়াত জামিল বলেন ৩২ নাম্বারের নিরাপত্তার জন্য কুমিল্লা থেকে আসা একটি সেনাদল ঢাকার স্টেশন কমান্ডার লে: ক: হামিদের দায়িত্বে ছিল। আর কে এম শফিউল্লাহ দাবী করেন ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিলকে ব্যবস্থা নিতে বলার পরেও তিনি ব্যাবস্থা নেননি। অপরদিকে শাফায়াত জামিল তা অস্বীকার করেন।

বহুমুখী এই ষড়যন্ত্র সফল হতে পেরেছে শুধুই এই কারনে যে বঙ্গবন্ধু তার দেশের জনগণকে অতিরিক্ত পরিমাণ বিশ্বাস করতেন, তিনি বিশ্বাস করতেন তার লোকেরা, বিশেষত মুক্তিযুদ্ধ করা সেনাবাহিনী তাঁর বুকে গুলি চালাতে পারবে না। সে কারনেই তাকে বিভিন্নভাবে সরাসরিভাবে সতর্ক করা সত্বেও তিনি এই ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি। তার এই কুলাঙ্গারদের উপর বিশ্বাস রাখার মূল্য তিনি দিয়ে গেছেন নিজের সহ পরিবারের অধিকাংশ মানুষের জীবনের বিনিময়ে।

ডেভিড ফ্রস্টের নেওয়া বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাতকার

এই হত্যাকাণ্ডের সাথে যে বাংলাদেশের উল্টো পথচলা শুরু হয়েছিল, হয়তো সেই পথে না গেলে আমাদের সোনার বাংলা এখনকার চেয়েও অনেক সমৃদ্ধ থাকত অর্থনৈতিক ভাবে, সামাজিক ভাবেও হয়তো আমরা আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে এগিয়ে থাকতাম। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে তিনি দেশটাকে কোথায় নিয়ে যেতে পারতেন সেটা আমরা এখন কেবল কল্পনাই করতে পারি, এর বেশি নয়।

ঘাতকেরা ভেবেছিল কিছু বুলেট দিয়েই হয়তো পিতার নামটি মুছে দেয়া যায়। কিন্তু ওরা জানত না ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ একটি চেতনার নাম- যার মৃত্যু নেই। প্রতিটি দেশপ্রেমিক বাঙ্গালীর হৃদস্পন্দনে – বাংলার প্রতিটি অর্জনে – মিশে আছেন বঙ্গবন্ধু – মিশে আছে তাঁর আদর্শ, প্রেরণা, ভালোবাসা। এই স্বাধীন বাংলার নাম যতবার উচ্চারিত হবে, ধ্বনিত হবে পিতার নাম।

জয় বাংলা – জয় বঙ্গবন্ধু।