Site icon ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ

বরেন্দ্র জাদুঘরে ‘অরক্ষিত’ প্রত্নসম্পদ


বিশেষ প্রতিবেদক :

কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাজশাহীর বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর। এটি বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্মারক। প্রাচীন স্থাপত্যশিল্পের সবচেয়ে বড় সম্ভার এ জাদুঘর। শুধু তাই নয়, এ জাদুঘর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রাচীন ইতিহাস, সংস্কৃতি আর প্রত্মতত্ত্ব নিয়ে গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহশালা। কিন্তু কালে কালে এর সংগ্রহ বাড়লেও কলেবর বাড়েনি। ফলে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে ‘প্রত্মসম্পদ’।

বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের মূল ভবন।

বরেন্দ্র অঞ্চলের রাজণ্যবর্গ, সমসাময়িক জ্ঞানী-গুণী এখানকার নিজস্ব ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও গবেষণার জন্য ১৯১০ সনে প্রতিষ্ঠা করেন এই জাদুঘরটি। বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রত্নসম্পদ অন্বেষণ এবং সমৃদ্ধ গবেষণায় ‘বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর’র রয়েছে অনবদ্য অবদান।

কিন্তু অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার অভাবে জাদুঘরের বারান্দায় ও আঙিনায় খোলা আকাশের নীচে বছরের পর বছর ধরে পড়ে আছে অসংখ্য মূল্যবান প্রত্নসম্পদ। ফলে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ও ধুলাবালিতে নষ্ট হচ্ছে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী প্রত্নসম্পদ। গ্যালারি কক্ষে প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণের জন্য বর্তমানে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। সংরক্ষণ ও নিরাপত্তার অভাবে এই প্রত্নসম্পদ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি রয়েছে খোয়া যাওয়ার ঝুঁকিও।

বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো এতে বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলিম শাসনামলের স্থাপত্যশিল্প ও চিত্রকর্মের বড় সম্ভার রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে খ্রিস্টের জন্মের আড়াই হাজার বছর আগের সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন, পারস্য ও বাংলার পা-ুলিপি, হাতে লেখা কোরআন শরীফ, সংস্কৃতি ও প্রকৃত পান্ডুলিপি, শিলালিপি, তাম্রলিপি, স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, তৈজসপত্র, মোগল চিত্রকর্ম, পাথর ও ব্রোঞ্জের নির্মিত অস্ত্র, বৌদ্ধ ও হিন্দু সভ্যতার প্রস্তর মূর্তি, শিব, গণেশ ও বিষ্ণুর নানা মূর্তি, গৌরী, উমা ও পার্বতীর মূর্তি, বৌদ্ধধর্মের প্রবক্তা ও তাদের সংস্কৃতির নানা উপকরণ। এসবের প্রায় সবই মহেঞ্জোদারো থেকে খ্রিস্টপূর্ব ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।

অরক্ষিত অবস্থায় বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের প্রত্নসম্পদ।

জাদুঘরের পরিচালক অধ্যাপক ড. আলী রেজা মুহম্মদ আব্দুল মজিদ জানান, জাদুঘরের সংগ্রহে বর্তমানে পান্ডুলিপিসহ ১১ হাজার ৩ শো ৩১টি প্রত্ননিদর্শন রয়েছে।গ্যালারি রয়েছে ১৪টি

প্রতিষ্ঠার পর থেকে জাদুঘর থেকে বিভিন্ন সময়ে হারিয়ে গেছে প্রায় তিন হাজার দুর্লভ প্রত্নসামগ্রী। ২০১০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত জাদুঘরের পূর্ণাঙ্গ ইনভেন্টরি প্রতিবেদনে জাদুঘরের প্রত্নসম্পদ হারানোর বিষয়টি উঠে আসে। জাদুঘরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সুলতান আহমদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি দল ওই ইনভেন্টরি তৈরি করে। এতে ১৯১০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত একশো বছরে সংগৃহীত ও হারানো প্রত্নসম্পদের তথ্য প্রকাশিত হয়।

ইনভেন্টরি প্রতিবেদনে জানা যায়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত হারিয়েছে ১৮৫টি প্রত্নসামগ্রীসহ প্রায় তিন হাজার দুর্লভ বস্তু। জাদুঘরে নিবন্ধিত নানা ধরনের প্রত্নসামগ্রীর ১৮৫টির কোনো হদিসই নেই। হারিয়ে যাওয়ায় প্রত্নসামগ্রীর মধ্যে রয়েছে দু’টি ব্রোঞ্জ, দু’টি কপার, দু’টি লিনেন, একটি ব্রাশ, দু’টি সিলভার, একটি ক্রিস্টাল, ৪৭টি বিভিন্ন ধরনের পাথর, ১০১টি টেরাকোটা, ১৩টি কাগজ এবং দুটি প্রাণীর চামড়া। এছাড়া পাঁচ হাজার ৯৭১টি নিবন্ধিত মুদ্রার মধ্যে ৩৩টি এবং ১৩ হাজার ৯৩৩টি গ্রন্থের মধ্যে ৮৫টি পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া যাচ্ছে না ১৩ হাজার ৫৭৬টি প্রকাশনার (পুস্তক, পুস্তিকা, গ্রন্থ, জার্নাল ইত্যাদি) মধ্যে তিন হাজার ৫২টি।

বরেন্দ্র জাদুঘরে দর্শনার্থীদের ভিড়।

সরেজমিনে দেখা যায়, জাদুঘরের গ্যালরিতে প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণের জন্য তিল ধারণের ঠাঁই নেই। পুরো জাদুঘর আঙিনা জুড়ে ছড়িয়ে আছে। বাইরের গ্রন্থাগার ভবনের নিচে পড়ে রয়েছে অনেক নিদর্শন। জাদুঘরের মাঝখানের উন্মুক্ত জায়গায় স্থাপিত গ্যালারিতে রাখা হয়েছে শতাধিক প্রস্তর মূর্তিসহ বিভিন্ন প্রত্নসম্পদ। এর মধ্যে নবম শতকের ‘দুর্গা সিংহবাহিনী’, ‘সূর্য’, দশম শতকের বিষ্ণু (ত্রিবিক্রম), ‘উপবিষ্ট গণেশ’, এগারো শতকের চৌকাঠের অংশ বিশেষ, বারো শতকের ‘উমা-মহেশ্বর’সহ অসংখ্য মূর্তি।জাদুঘরের আঙিনার ওপরে ছাদ না থাকায় পুরাকীর্তিগুলো খোয়া যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।

এ গ্যালারির ঠিক সামনে খোলা আকাশের নিচে পড়ে রয়েছে আরও কিছু প্রত্নসম্পদ। মূল কমপ্লেক্সের ভেতরে পাহারা থাকলেও উন্মুক্ত স্থানের পুরোটাই রয়েছে অরক্ষিত।জাদুঘরের ভেতরে ছবি তোলায় নিষেধাজ্ঞা থাকলে কর্তব্যরত নিরাপত্তা কর্মীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে দর্শনার্থীরা ছবি তুলছেন ঠিকই।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী কেএম সাকিব বলেন, ‘প্রত্নসম্পদগুলো দেশের হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী। এগুলো দেশের অমূল্য সম্পদ। এসব এভাবে অনাদরে-অবহেলায় ফেলে রাখা অত্যন্ত দুঃখজনক। রোদ-বৃষ্টিতে প্রত্নসম্পদগুলো সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা উচিত’।

বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের ভেতরে রাখা প্রত্নসম্পদ।

জাদুঘরের সংরক্ষণ কর্মকর্তা মো. আব্দুল কুদ্দুস বলেন, জাদুঘরের ভেতরে প্রত্নসম্পদ রাখার মতো পর্যাপ্ত জায়গা নেই। এখানে মাত্র ১৪টি গ্যালারি কক্ষ রয়েছে। যা জাদুঘরের ১১ হাজার প্রত্ননিদর্শন সংরক্ষণের জন্য অপর্যাপ্ত। এগুলোর জন্য আরও গ্যালারি প্রয়োজন। ফলে বাধ্য হয়ে প্রত্ননিদর্শনগুলো বারান্দায় এবং খোলা আকাশের নিচে রাখা হয়েছে।

বরেন্দ্র জাদুঘরের পরিচালক অধ্যাপক ড. আলী রেজা মুহম্মদ আব্দুল মজিদ বলেন, জাদুঘরের নতুন অবকাঠামো নির্মাণের জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। বিষয়টি এখন সিন্ডিকেট সভায় পাস হওয়ার অপেক্ষায় আছে। সিন্ডিকেটে পাস হলেই শিগগিরই নতুন অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু হবে বলেও জানান জাদুঘর পরিচালক।


Exit mobile version