বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বিস্তারে রাজনৈতিক ভূমিকা


 


বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ উত্থান সম্পর্কে ঠিক ৭৫ পরবর্তীতেই অনেকেই কানাঘুষা করেছিল। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে প্রায় কেউই উঁচু গলায় তা বলতে পারে নাই। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এখন কিন্তু সেই কানাঘুষাই প্রায় বাস্তবে রূপ নিয়েছে।

হ্যাঁ, “স্যাকুলার বাংলাদেশে যে জঙ্গিবাদ বিস্তার হচ্ছে” কথাটা লজ্জাজনক শুনালেও বাস্তবে কিন্তু এটাই অকাট্য সত্য। এখন যতটুকুই চর্চা হচ্ছে না কেন, সামনে কিন্তু নিদারুণ কঠিন কিছু অপেক্ষা করছে; তা দিনের আলোর মত সত্যও বটে। ব্যাপারটা নিয়ে অনেকে হয়ত নিজের পিঠ বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন রকমের মনগড়া অজুহাত দাঁড় করাতে চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু দিন শেষে নিদারুণ সত্যটা কেউই অস্বীকার করতে পারবেন না।

জঙ্গিবাদের উত্থানের কাল-পাত্র নিয়ে বাজারে হরেক রকমের মুখরোচক গল্প প্রচলিত আছে। প্রসঙ্গক্রমে একটু পেছনে তাকালে দেখা যাবে – প্রথম সারির একটি দলের চেয়ারপার্সন প্রায়ই বর্তমান প্রধান প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলতেন, “ওনাদের প্রথম শাসনামলেই নাকি জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে”।

অবশ্য ঐ আমলেই মুফতি হান্নান নামের আফগান ফেরত এক জঙ্গি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় বাহাত্তর কেজি ওজনের একটি বিশালাকায় বোমা পুতে শোরগোল ফেলে দিয়েছিলো। তখন ঠিক সেই স্থানটি ছিল বর্তমান ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক দলটির জনসভাস্থল। ভাগ্য ভাল যে, ওইদিন সেই বোমা ফাটার আগেই উদ্ধার করা হয়েছিল (মুফতি হান্নান পরবর্তীতে গ্রেফতার হন)।

দুই জঙ্গি নেতা বাংলা ভাই ও শায়খ আব্দুর রহমানের আবির্ভাব ঘটার সময় কালে তৎকালীন সরকারদলীয়রা খুব গর্ব করেই বলতেন – “দেশে কোনো জঙ্গিবাদের অস্তিত্ব নেই, সব মিডিয়ার সৃষ্টি” । যা পরে খুব সমালোচিত হয়। কিন্তু নিয়তির ফের – শেষ পর্যন্ত সেই সরকারই এই দুই জঙ্গি নেতাকে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করতে বাধ্য হয়।

যদিও তারপরে কিছু দিন পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষ “জঙ্গিবাদ শব্দটি ” ভুলে থাকতে চেষ্টা করেছে; কিন্তু মুল বিপত্তিটা ঘটেছে গণজাগরণ মঞ্চ গঠনের পর ২০১৪ ও ২০১৫ সালের দিকে এসে। এই সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জঙ্গিদের আসল মনোভাব নিয়ে একটু বিশ্লেষন করলেই বুঝা যাবে, আসলে এইদেশে জঙ্গিদের আসল উদ্দেশ্য কি এবং কেন। এটা বুঝতে খুব বেশি মাথা খাটাতেও হয়না ।

অনেকেই হয়ত ভেবেছে তাদের ইনটেনশন নিশ্চয়ই দেশে নাস্তিক্যবাদের প্রচারকে বাধাগ্রস্ত করা। এমনও বলতে শুনেছি – নাস্তিক লেখক ও ব্লগারদের উপরে হামলাগুলোর কারন ছিল – তাদের নাস্তিকতা। প্রশ্ন হচ্ছে হঠাৎ করে দেশে কি এমন ঘটলো যে এই জঙ্গিবাদ, খুন, হত্যা ও হামলার সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যেতে লাগলো? নাস্তিকতাই কি এর মূল কারণ?

দেশের কত শতাংশ সাধারণ মানুষ এই তথাকথিত নাস্তিকতা নিয়ে জারপর নাই টেনশনে পড়ে গিয়েছিল? প্রশ্ন আরো আছে, বিদেশী দুইজন নাগরীককে যে হত্যা করা হলো, তারা কি এই আস্তিক নাস্তিক হিসেব নিকেশের অংশ হতে পারে? তবে কেন তাদের হত্যা করা হলো?

প্রকাশক দীপনের বাবা কিন্তু মৌলবাদীদের সমর্থন দেয়া দেশের বিশেষ এক দলের সমর্থক ছিলেন। দীপনের নিজের নাস্তিকদের পক্ষে কোনো ভাষ্যও পাওয়া যায় না। দেশের বড় বড় অবিশ্বাসীকে রেখে দীপনকে কেন টার্গেট করা হলো? রাজনীতি যদি এখানে যুক্তই না থাকে তবে, সরকার একটা ঘটনায়ও কেন হত্যাকারীকে ধরতে পারলো না ?

ব্লগার রাজীব, যিনি থাবা বাবা নামে লিখতেন, তার হত্যাকারী হিসেবে যাদের ধরা হলো, সেই ৫ জনের সাথে বড় কোনো জঙ্গি গ্রুপের মদদ অথবা তাদের পেছনের মূল চালিকা শক্তিকে আবিস্কারে কিন্তু সরকার ব্যর্থ হয়েছে। তখন বলা হয়েছিলো তারা অনেকটা নিজস্ব উদ্যোগে এই কাজটি করেছে।

যদি তাই হয়, তবে পরবর্তীতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো কি প্রমান করে? সেই ৫ জনের গ্রেফতারটি কি ভুল ছিল? যেহেতু বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ এই বিষয়গুলোকে সমর্থন করার প্রশ্নই আসে না, সেই দিক থেকে ঘটনাগুলির রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও সম্পৃক্ততা না থাকার আর কোন কারণই নাই।

বর্তমান সরকার দলীয় নেতা-নেত্রীদের বিভিন্ন সময়ের বক্তৃতা বিবৃতিগুলোর দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে – তাদের বামপন্থী নেতৃত্ব সহ প্রায় সবাই প্রকাশ্যেই যে ধারনাটি পোষন করে, তা হল – জামায়াতে ইসলামী এইসব ঘটনায় মদদ দিচ্ছে এবং এতে তাদের শতভাগ সম্পৃক্ততাও আছে।

সেই সাথে জামায়াতকে প্রত্যক্ষ ভাবে আশ্রয়দাতা আরেকটি বিশেষ দলের ডানপন্থী অংশটুকুও এতে জড়িত। সরকার দলীয় নেতা-নেত্রীদেরকে আবার এমনও বলতে শোনা গেছে – গত তিনবারের জাতীয় নির্বাচনে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা একতরফা সরকার গঠন করার কারণেই নাকি এই দলগুলো সব থেকে বেশি সংক্ষুব্ধ, তারা রাজনৈতিক স্পেস না পেয়ে এই ধরনের জঙ্গিবাদকে সমর্থন দিচ্ছে ।

যদি এই সম্ভাবনাকে বিবেচনা করি, তবে অনেকগুলো কথা সামনে চলে আসে। এই সরকারের আমলেওতো প্রায় একই ধরনের জঙ্গিদল ব্যাঙ্গের ছাতার মত গজিয়েছে, এবং তারা হুহু করে বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে মাঠে ময়দানেও এদের কার্যক্রম পরিচালনা করেছে অনেক বেশি গতিতে। এর দায় কে নেবে?

আরেকটু খোলাখুলি করে যদি বলি – “গন জাগরণ মঞ্চ” হওয়ার পর থেকে যে খুনের ঘটনাগুলো ঘটে আসছে; তা শুধু নির্বাচনী প্রতিহিংসা হিসাবে দেখা কতটুকু যৌক্তিক হবে? আবার বিদেশী নাগরীক হত্যা করে তারা কি বোঝাতে চেয়েছে?

দেশের রাজনীতিতে একেবারে উপরের দিকে অবস্থান করা দল দুইটার যে সাপে নেউলে সম্পর্ক তাতে কোন সন্দেহ থাকার কথা না। সেই হিসেবে বর্তমান সরকার অন্য আরেকটা দলকে জঙ্গি সম্পৃক্ত দল হিসাবে দীর্ঘদিন ধরেই দেখাতে চাইছে। আর তারাও (জামায়াতকে সরাসরি আশ্রয় দাতা) এই সব জেনে শুনেই সেই পথেই হেঁটে কথাটার যৌক্তিকতা প্রকাশ করছে কেন?

আরেকটা জটিল কথা এখানে উত্থাপন না করলেই না, বর্তমান সরকার পশ্চিমাদের কাছে তাদের ক্ষমতায় থাকার কারন হিসেবে দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছে যে, যেহেতু দেশে জঙ্গি তৎপরতা বেড়ে যাচ্ছে তাই তারা জঙ্গিবাদের উত্থান ঠেকানোর জন্য ক্ষমতায় আছে ।

এই পর্যন্ত বর্তমান সরকার সমূলে কয়টা জঙ্গি সংগঠনকে উৎখাত করেছে? জামায়াত ও তাদের আশ্রয়দাতাদের মদদে এই ধরনের হত্যাকান্ড ঘটেছে বলে নিশ্চিত হয়েও প্রশাসন কেন তাদের ধরছে না? অবশ্য জামায়াতের সম্পর্কে উল্লেখিত এমন অসংখ্য ঘটনা আছে, যার থেকে মাত্র অল্প কিছু বিবেচনায় আনলেই এই সরকার তাদেরকে সমূলে শাস্তি দিয়ে ক্রেডিট নেয়ার সুযোগ নিতে পারাত। কিন্তু নিচ্ছে না কেন?

আবার অন্যদলের নেতা-নেত্রীরা দাবী করছেন, সরকারী দলের মদদে এগুলো হচ্ছে। তাদের দাবী মতে – “বর্তমান সরকারী দল নাকি অনেক আগে থেকেই দেশে জঙ্গিবাদের ধোয়া তুলে পশ্চিমাদের দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করছে। আর সেটি এখন তারা নিজেরাই বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছে। ক্ষমতায় থাকার গ্রহনযোগ্যতা প্রমান করতে গিয়ে এই ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে!

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কথাগুলো খুব স্বাভাবিক হলেও এর সত্যতা নির্ণয় করা খুব কঠিন কিছু না। যেহেতু দোষারোপের রাজনীতিই হচ্ছে এখনকার ঐতিহ্য। অবশ্য সাধারণ জনগণ এসবের গভীরতা বুঝার কম-বেশী ক্ষমতা অবশ্যই রাখে।

বর্তমান ক্ষমতাসীনরা যদি দেখাতে চায় যে – তারা জঙ্গিবাদ প্রতিরোধকারী, তবে দিনের প্রায় একই রকমের হামলাগুলো কিন্তু তাদের জন্য সুনামের চাইতে দুর্নামই বয়ে আনছে বেশী। বরং মানুষ আরও বেশী বেশী করে বলবে – এরা জঙ্গিবাদের উত্থান ঠেকাতে সক্ষম হয়নি ।

কোন না কোন ভাবে বর্তমান সরকার যেহেতু নিজেদের ইমেজ ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে জঙ্গিবাদ ঠেকাতে ক্ষমতাসীনদের কয়েকজন মন্ত্রী মহোদয় যদি আবার বিষয়টির সাথে যুদ্ধাপরাধী ইস্যু কিংবা মৌলবাদী আশ্রয়দাতাদের জড়িয়ে বক্তব্য দেয়; তাহলে তা কিন্তু সাধারণ পাবলিকের কাছে এখন শুধু মাত্র হাস্যকর খোড়া যুক্তিই মনে হবে।

বেশিরভাগ জনগণই জানেন যে দেশে যা-ই ঘটুক, বিগত অনেকগুলো বছর এই একই ধরনের বক্তব্যই তারা দিয়ে আসছে। সুতরাং বর্তমান সরকার এই ইস্যু থেকে রাজনৈতিক বাড়তি কোন প্রকাশ্য সুবিধা এখন আর আদায় করতে পারবে বলে মনে হয় না।

এখন কেউ যদি বলে – বর্তমান সরকার নিজেই জঙ্গিদের উত্থান চাইছে! তাহলে বিপরীতে প্রশ্ন জাগবে – এতদিন পর এসে এখনইবা কেন তারা জঙ্গিবাদের উত্থান চাইবে? শুধুই কি জামায়াত জোটকে দোষারোপ করতে? এমন ভিত্তিহীন যুক্তি মানার মত নির্বোধ নিশ্চয়ই বাংলাদেশের মানুষ এখন আর নেই।

আবার এখানে সময়টিও কিন্তু বেশ গুরুত্বপূর্ন। এই সরকার এতদিন পরে এখনইবা কেন জঙ্গিবাদের উত্থান চাইবে? তাছাড়া বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের নামে দায় স্বীকার করেইবা কেন বিবৃতি দিবে? শুধু জামায়াতের উপরই দোষ চাপিয়ে দিলেইতো উদ্দেশ্য সফল হয়ে যেত।

প্রসঙ্গক্রমে বলতে হচ্ছে – বাংলাদেশে যদি নামকরা কোন জঙ্গি সংগঠন তাদের কর্মকান্ড শুরু করেও থাকে, সেটা প্রতিরোধ করার মত যথেষ্ট সক্ষমতা এই সরকারের আছে বলে মনে হয় না। কারণ, কেন জানি এখন আর তারা নিজেদের ভিত্তি, অস্তিত্ব এবং নিজেদের প্রকৃত কর্মীগণের উপর আস্থা রাখতে পারছে না।

তার উপর সরকারের মন্ত্রীরা এক একটা ঘটনার পর পরই যেভাবে প্রতিপক্ষকে দোষারোপ করে বক্তব্য দিতে ব্যস্ত হয়ে পরে তাতে করে প্রকৃত জঙ্গিদের পার পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বহুগুন বেড়ে যায়। নিহত দীপনের বাবাও বলেছেন – বিষয়টি রাজনৈতিক সংকট।

এই ধরনের সংকট অবশ্যই বড় ধরনের জাতীয় ইস্যু । আর এসব ইস্যু মোকাবেলা করতে হলে মূলত সরকারকেই আসল ভূমিকাটা পালন করতে হবে, এবং তা হতে হবে অবশ্যই আন্তরিকতার সংমিশ্রণে। এতে জনগণের সম্পৃক্ততারও দ্বিতীয় কোন বিকল্প নাই।

বিভিন্ন ধর্ম গোত্রের মানুষ শান্তিপূর্নভাবে বসবাস করার ঐতিহ্য কিন্তু বাংলাদেশে সেই হাজার বছরের ইতিহাস। দেশে এই কথাগুলো খুবই প্রচলিত যে আমাদের সাধারন জনগন ধর্মভীরু তবে ধর্মান্ধ নয়। ধর্মান্ধ আর ধর্মভীরু বিষয় দুটি আলাদা । বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ আপাদ মস্তক কখনই এই জঙ্গিবাদের সমর্থন করে নাই এমন কি করবেও না।

তারপরেও উগ্রবাদ বলতে একটা কথা আছে । আরবের জনগণ যত সহজে মানুষ খুন করবে , ততটা সহজে বাংলাদেশের জনগণ কখনই তা করতে পারবে না । বাংলাদেশের মানুষ সম্পর্কে বলতে গেলে শান্তিপ্রিয় জাতিরই প্রতিচ্ছবি মাত্র। সেই দেশের মানুষ হয়ে আমাদের দেখতে হচ্ছে আমাদের দেশে কিভাবে পৌনঃপুনিক হারে জঙ্গিবাদের আবাদ হচ্ছে।

বর্তমানের বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থায় জঙ্গিবাদ দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ন শব্দ হয়ে গেছে। যা দেশের সাধারন মানুষের ভাবনার বিপরীত। বাস্তবতা হচ্ছে – আমরা সাধারণ বাঙ্গালিরা কখনই উগ্র না, সত্য হচ্ছে – আমরা ক্ষমতালোভী।

লেখক: সাইদুল ইসলাম
সাউথ ওজন পার্ক
১১৪২০ – নিউ ইয়র্ক


শর্টলিংকঃ