বাবার শেষ স্মৃতির সেই বায়োস্কোপটি


এম এ আমিন রিংকু, কলকাতা থেকে:

প্রবাদ আছে ‘স্বপ্নের শুধু একজনই দর্শক থাকে যার কারণে স্বপ্নের মধ্যে মানুষ বড় একা’। প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে কলকাতার রাস্তায় সেলুলয়েডের ফিল্মে স্বপ্ন দেখানো মোহাম্মদ সেলিম এর ক্ষেত্রে এই প্রবাদ যেন ধ্রুবসত্য হয়ে ধরা দিয়েছে। যতটা না বয়সের ভার তার চেয়ে বেশি বিষাদে একসময়ে প্রাণোচ্ছল হয়ে চালানো বায়োস্কোপটা যেন তার কাছে ভারী হয়ে উঠেছে।

প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান বিকাশে স্মার্টফোনই এখন মানুষের বিনোদনের সবচেয়ে বড় সঙ্গী। স্মার্টফোন আর মাল্টিপ্লেক্স সিনেমা হলগুলো বায়োস্কোপকে বের করে দিয়েছে বিনোদনের গন্ডির একদম বাইরে। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই স্বেচ্ছা অবসরে যেতে হচ্ছে ভারতের শেষ বায়োস্কোপওয়ালা মোহাম্মদ সেলিমকে।

বাবা ছিলেন সেই সময়ের জনপ্রিয় বায়োস্কোপওয়ালা। মূলত বাবার কর্মের প্রতি মানুষের সম্মানবোধ দেখেই কিশোর বয়সে বাবার পেশাতে এসেছিলেন সেলিম। বাবার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে শোনাচ্ছিলেন বায়োস্কোপের সেই সোনালী দিনের গল্প ‘ছোটবেলায় অবাক হয়ে দেখতাম বাবা যখন বায়স্কোপ নিয়ে বেরিয়ে কোথাও শো শুরু করতেন মানুষ যেন পিঁপড়ের ঝাঁকের মতো ছুটে এসে বাবাকে ঘিরে ধরতেন, বেশিরভাগ সময় লম্বা লাইন হয়ে যেত। শো দেখে একটা অবাক করা হাসিমুখ নিয়ে মানুষ ঘরে ফিরতো আর বায়োস্কোপের প্রতি আমার দুর্বার টানটা আরো মজবুত হয়ে যেত ‘।

সেসময় বায়োস্কোপের শোগুলো ৫ মিনিট দৈর্ঘ্যের হত। বাবার সঙ্গে মুরগিহাটা থেকে কেজি দরে সেলুলয়েডের পুরনো ফিল্ম কিনে নিয়ে আসতেন। তারপর সেগুলোকে কেটে ছেঁটে তৈরি করতেন‌ ৫ মিনিট দৈর্ঘ্যের দৃশ্য। যেগুলোর অধিকাংশই থাকতো কোন সিনেমার ট্রেইলার অথবা হিরোদের বিখ্যাত কোন ডায়লগ। আর কাটছাঁট করা সেই দৃশ্য গুলোই যে এতটা মায়াবী হয়ে উঠতো সেটা আজ অবাক করে মোহাম্মদ সেলিমকে।

বাবার মৃত্যুর পরে বাইস্কোপের পুরো হালটা ধরতে হয়েছিল সেলিমকে। তিনিও বেশ শক্ত ভাবে ধরেছিলেন হাল এবং জীবনের পড়ন্ত বেলাগুলোর আগ পর্যন্ত পেয়েছেন আকাশচুম্বী সফলতা যার ফলশ্রুতিতে এখন তাকে মানুষ চিনে ভারতের শেষ বায়োস্কোপওয়ালা হিসাবে। আমেরিকান চলচিত্র নির্মাতা টিম স্টার্নবার্গ ২০০৮ সালে সেলিমকে নিয়ে ১৪ মিনিটের স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচিত্র নির্মাণ করেছিলেন যেটা অস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল। এছাড়াও ২০১৫ সালে ২১ তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে রাজ্য সরকার তাকে ‘ভারতের শেষ বায়োস্কোপওয়ালা’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

জানতে চেয়েছিলাম বায়োস্কোপের বর্তমান নিয়ে হতাশার সুরে তিনি বলছিলেন, ‘মানুষের ভেতরে আগ্রহের জায়গাটা ঠিকমত কাজ না করলে কাজের ভেতরে মায়াটা আনা যায় না’। মোহাম্মদ সেলিমের বায়োস্কপটি কিনতে আগ্রহ দেখিয়েছেন বিদেশী অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান, অভাবনীয় দামও হেকেছিলেন তারা। কিন্তু তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন বাবার স্মৃতিচিহ্নটিকে বুকে ধরেই শেষ নিঃশ্বাস নিতে চান তিনি।

আরও পড়তে পারেন শান্তিনিকেতনের মহামায়া হোটেলের মায়াবী স্বাদ


শর্টলিংকঃ