বাবুর্চি থেকে জঙ্গি নেতা হয়ে ফাঁসির মঞ্চে রাজীব গান্ধী


জিয়াউল গনি সেলিম :

দৈহিক গঠনে খাটো।পরনে প্রিন্টের কালারফুল পাঞ্জাবী ও পাজামা। দাঁড়ি-গোফ ও চুলে মেহেদীর রঙ। রোববার বেলা ১১টার দিকে যখন রাজশাহীর আদালত প্রাঙ্গণে প্রিজন ভ্যান থেকে তাকে নামিয়ে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের এজলাশে নেয়া হয়, তখনও বেশ স্বাভাবিকই দেখাচ্চিল। প্রিজন ভ্যান থেকে নেমেই ডানহাতের তর্জনী আঙুল উঁচিয়ে  আত্মবিশ্বাসের কণ্ঠেই শ্লোগান দেন একাই। তখনও মুখে হাসি দেখা গেল শীর্ষ জঙ্গি জাহাঙ্গীর ওরফে রাজীব গান্ধীকে। বাবুর্চি থেকে তিনি জঙ্গি হন। তার বিরুদ্ধে অন্তত ২২টি হত্যায় জড়িত থাকার তথ্য রয়েছে পুলিশের হাতে।

রোববার ফাঁসির রায় ঘোষণার আগে আদালত চত্ত্বরে আঙুল উঁচিয়ে রাজীব গান্ধী

কে এই রাজীব গান্ধী :

প্রকৃত নাম জাহাঙ্গীর আলম। তবে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবিতে জড়িয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা নাম ধারণ করে তিনি। আত্মরক্ষায় জাহাঙ্গীর আলম, সুভাষ, শান্ত, টাইগার, আদিল, জাহিদ নামেও পরিচয়  দিতেন। তবে আইনশৃংখলাবাহিনীর তালিকায় সে রাজীব গান্ধী নামেই বেশি পরিচিত। রাজীব গান্ধী গাইবন্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার বোনারপাড়া ইউনিয়নের পূর্ব ভূতপাড়া গ্রামের ওসমান গনি ছেলে তিনি। রাজীব একসময় রঙমিস্ত্রির কাজ করতেন। লেখাপড়া পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত।

পুলিশের জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমনে গঠনে বিশেষায়িত কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের তথ্য বলছে, জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) তৎকালীন শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমানের জামাতা আবদুল আওয়ালের রান্নার বাবুর্চি ছিলেন রাজীব গান্ধী। বাবুর্চির কাজ করার সময় তিনি বগুড়ায় ছিলেন।সাইকেলে আব্দুল আওয়ালের নানা বার্তা আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে দেয়ার কাজ করতেন তিনি।সেখান থেকেই ধীরে ধীরে শীর্ষ জঙ্গিতে পরিণত হন। আওয়াল গ্রেফতার হলেও আইনশৃংখলাবাহিনীর কাছে অজানা থেকে যায় বাবুর্চি রাজীবের নাম।

পরবর্তীতে শায়খ রহমান ও আব্দুল আউয়ালসহ শীর্ষ জেএমবি নেতাদের ফাঁসির দণ্ড কার্যকরের পর নব্য জেএমবি হিসেবে পুনর্গঠিত এই জঙ্গি গোষ্ঠীটির অন্যতম প্রধানের ভূমিকায় আসেন রাজীব গান্ধী।কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট জানায়, জেএমবিতে সক্রিয়ভাবে কাজ করলেও বাবুর্চির ভূমিকা নিয়ে চলফেরা করতেন রাজীব।

রাজীব গান্ধী ( ডানে) ও তার গুরু তামিম চৌধুরী (চশমা পরা ডানে)

রাজীব গান্ধীর জঙ্গি নেটওয়ার্ক :

জেএমবির কোনো সদস্য আহত বা অসুস্থ হলে তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিত উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দা নজরুল।তখন থেকে সে সংগঠনে ‘ডাক্তার’ নজরুল হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে।২০১৩ সালে কানাডা ফেরত তামিম চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় হয় রাজীবের।এরপর নব্য জেএমবির উত্তরাঞ্চলের অন্যতম সামরিক কমান্ডার হিসেবে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তার সেলে ১০-১২ জন প্রশিক্ষিত জেএমবি সদস্যকে দেওয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে ছিল বাইক হাসান, রাহুল, ডন, ফারদিন ও বাঁধন। একই গ্রুপে ছিল রিপনও।

নব্য জেএমবির উত্তরাঞ্চলীয় কমান্ডার হওয়ায় টার্গেট কিলিংয়ে যোগ দেওয়া জঙ্গিদের নেতা ছিলেন রাজীব গান্ধী।  পুলিশের কাছে রাজীব গান্ধী আরও স্বীকার করেছেন, তিনি গুলশান হামলায় অংশগ্রহণকারী মো. খায়রুল ইসলাম পায়েল ওরফে বাঁধন, মো. শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ওরফে বিকাশকে নব্য জেমএবিতে ঢোকান। পরে তাঁদের হামলার জন্য বাছাই করেন। শোলাকিয়া হামলায় জড়িত শফিউল ইসলাম ওরফে ডনকেও তিনি প্রস্তুত করেছিলেন। নব্য জেএমবিতে যোগ দেওয়ার আগে রাজীব গান্ধী জেএমবির সুরা সদস্য নজরুল ইসলামের সহযোগী ছিলেন।

ভয়ঙ্কর জঙ্গি রাজীব গান্ধী :

জেএমবিতে ২০১১ সালে বিভক্তির পর ২০১৪ সালে নব্য জেএমবির নেতা তামিম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ হয় রাজীবের। এরপর তার পরিকল্পনায় শুরু হয় একের পর এক হত্যা মিশন।  ২০১৬সালে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা হয় গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে। ওই হামলার অন্যতম ‘পরিকল্পনাকারী’ হিসেবে ২০১৭ সালের ১৩ জানুয়ারি রাতে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে রাজীব গান্ধীকে গ্রেফতার করে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। জিজ্ঞাসাবাদে গুলশান হামলায় জড়িত বলে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন রাজীব গান্ধী। গুলশান হামলার পুরো পরিকল্পনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন রাজীব। এ হামলার আগে জঙ্গিরা বসুন্ধরার একটি বাসায় পরিকল্পনা করে। সেখানে রাজীবের স্ত্রী-সন্তানরা উপস্থিত ছিল।

টাঙ্গাইলে গ্রেফতারের পর রাজীব গান্ধী – ফাইল ফটো

গুলশানের হামলায় জড়িত শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ওরফে বিকাশ ও খায়রুল ইসলাম পায়েল ওরফে বাঁধনকে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে রাজীবই সম্পৃক্ত করেন এবং প্রশিক্ষণ দেন। ওই দুজনই পুলিশি অভিযানে নিহত হন। এছাড়া শোলাকিয়ার হামলায় গ্রেফতার হওয়া শফিউলকেও জঙ্গি কর্মকাণ্ডে তিনি সম্পৃক্ত করেন। পরে বন্দুকযুদ্ধে শফিউলও নিহত হয়।

২২ কিলিং মিশনে রাজীব গান্ধী :

রাজীব গান্ধী গুলশান ও শোলাকিয়া হামলায় জড়িত। পুলিশের অভিযানে নিহত জঙ্গি নেতা তামিম চৌধুরী ও নুরুল ইসলাম ওরফে মারজানের সঙ্গে গুলশান হামলার পরিকল্পনায় তিনি সরাসরি জড়িত ছিলেন। এ ছাড়া জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি, টাঙ্গাইলের দরজি নিখিল চন্দ্র জোয়ারদার, পাবনার পুরোহিত নিত্যরঞ্জন পাণ্ডে, রংপুরের মাজারের খাদেম রহমত আলী, কুষ্টিয়ার চিকিৎসক সানাউর, পঞ্চগড়ের পুরোহিত যজ্ঞেশ্বর, দিনাজপুরের হোমিও চিকিৎসক ধীরেন্দ্রনাথ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীসহ ২২টি হত্যার ঘটনায় তিনি পরিকল্পনাকারী ছিলেন। তবে সবশেষ রোববার (১৫ মার্চ ) পঞ্চগড়ের পুরোহিত যজ্ঞেশ্বর দাসাধিকারী হত্যা মামলায় রাজীব গান্ধীসহ চার জঙ্গির ফাঁসির রায় দিয়েছেন আদালত। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাদের  মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে হলে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র ও এডিসি গোলাম রুহুল কুদ্দুস ইউনিভার্সাল২৪নিউজকে জানান, জাহাঙ্গীর ওরফে রাজীব গান্ধী হলি আর্টিজান হামলার মাস্টারমাইন্ড। সারাদেশে যত জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে তার অধিকাংশতেই জড়িত রাজীব। তিনি নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবি’র অন্যতম শীর্ষ নেতা।


শর্টলিংকঃ