বিদেশে বসে আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণে শাহাদাত-শাহীন: সক্রিয় শাহাদাতের ১০ গ্রুপ


বিদেশে বসে আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করছে শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাত ও শাহীন শিকদার। দেশে সক্রিয় আছে তাদের বেশ কয়েকটি গ্রুপ। শুধু শাহাদাতেরই ১০টির বেশি গ্রুপ রয়েছে। প্রতি গ্রুপে সদস্য সংখ্যা ৮ থেকে ১০। তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ও টার্গেট করা ব্যক্তির ছবি আদান-প্রদান করছে ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপসহ ভার্চুয়াল মাধ্যমে।

ভারতে বসে বাংলাদেশে যোগাযোগ রক্ষা করে শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাত ও তার অন্যতম সহযোগী বাচ্চু। শাহিন শিকদারও শাগরিদদের কাছে একই কায়দায় বার্তা পাঠায়। সম্প্রতি শাহাদাত বাহিনীর একাধিক সদস্য র‌্যাব-পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়। তারপরও তাদের চাঁদাবাজি থেমে নেই। ব্যবসায়ী, ঠিকাদার ও ধনাঢ্যদের কাছ থেকে শাহাদাত ও শাহিন শিকদারের লোকজন হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। অভিযোগ-অনুযোগ না করে ভুক্তভোগীরা নীরবেই চাঁদা দিয়ে যাচ্ছেন।

র‌্যাব সূত্র জানায়, ১৯ আগস্ট শাহাদাত বাহিনীর কিলার নজরুল ওরফে মিঠুকে সাভার থেকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-৪ এর একটি দল। তার কাছে পাওয়া যায় বিদেশি পিস্তল ও ৪ রাউন্ড গুলি। মিঠু একাধিক হত্যা ও অস্ত্র মামলার আসামি।

২৫ জুলাই মিরপুরে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় শাহাদাত গ্রুপের কিলার ব্যাঙ্গা বাবু। সে ২৬টি খুন করেছে। শাহাদাতের সেকেন্ড ইন কমান্ডের দায়িত্ব পালন করত সে।

এদিকে র‌্যাব শাহাদাত বাহিনীর অন্যতম সদস্য আবু হানিফ বাদল ওরফে ডিশ বাদলকে অস্ত্র ও গুলিসহ ক্যান্টনমেন্ট থানার মাটিকাটা এলাকা থেকে গ্রেফতার করে। মিরপুর, পল্লবী ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় রয়েছে শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাতের একাধিক গ্রুপ। গ্রুপের বেশ কিছু সদস্য সক্রিয় রয়েছে। এর মধ্যে জামাল, নয়ন বন্ড, রমিজ, পানি শাহীন, ব্লাক জাকির, আনোয়ার, নজরুল, সেলিম, দেলোয়ার, কসাই আকবর, আমান, শ্যুটার সোহেল, মীর্জা বাবু ওরফে মৃদুল, গাজী সুমন, মুক্তার সেন্টু, পিয়াল, কিলার সুমন বেগ, শামীম, আলমগীর, জিসান, বড় রনি, পিচ্চি মর্তুজা, বেকার রহমানসহ বেশ কয়েকজনের নাম রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শাহাদাত বাহিনীর ডিশ বাদল তাদের সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করত। ডিশ বাদল গ্রেফতার হওয়ার পর দায়িত্ব পালন করছে নয়ন বন্ড। সে চাঁদার টাকা হুন্ডির মাধ্যমে ভারতে পাঠাচ্ছে। এছাড়া টার্গেট ব্যক্তিদের তথ্য সংগ্রহের দায়িত্বও পালন করে সে।

এদিকে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র‌্যাব-৪ এর একটি সূত্র জানিয়েছে, শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাত বাহিনীর ১০টি গ্রুপ রাজধানী ঢাকায় সক্রিয় রয়েছে। এদের কেউ টার্গেট করা ব্যবসায়ীদের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে, কেউ চাঁদা দাবি করে, কেউ অস্ত্র সরবরাহ করে আবার কেউ আদায় করা চাঁদার টাকা হুন্ডির মাধ্যমে ভারতে পাঠানোর দায়িত্ব পালন করে বলে তথ্য রয়েছে তাদের কাছে।

এর আগে পিবিআইর হাতে গ্রেফতার আনোয়ার হোসেন ওরফে কিলার সবুজ একই তথ্য দেয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বেশিরভাগ ব্যবসায়ী ও ঠিকাদার আপসে মাসিক চাঁদা দিচ্ছেন শাহাদাত বাহিনীকে। চাঁদার রেট ২০ হাজার টাকা লাখ টাকা বা তারও বেশি। ভারতে বসেই দাবি করা হয় কোটি টাকার চাঁদা।

এরপর দেন-দরবারের একপর্যায়ে রাজি না হলে নির্দেশ আসে শেষ করে দেয়ার। আর তা তামিল করে ৫ থেকে ৬ সদস্যের কিলার গ্রুপ। এমন নির্মম পরিণতি বরণ করেন মিরপুরের নিউ শাহাজালাল আবাসিক হোটেল ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম জুনায়েদ।

২০১৬ সালের জানুয়ারিতে জুনায়েদের কাছে ভারত থেকে শাহাদাত ফোন করে ১ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করে। অসম্মতি প্রকাশ করায় ওই বছরের ১ ফেব্রুয়ারি রাতে গুলি করে হত্যা করা হয় জুনায়েদকে। হত্যা মিশনে ছিল শাহাদাতের কিলার গ্রুপের আনোয়ার হোসেন সবুজ, শিশির ওরফে সোহেল, রহিম, পলাশ, মৃদুল।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআইর হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর সবুজ শাহাদাত বাহিনীর চাঞ্চল্যকর তথ্য দেয়। এর আগে ২০১৫ সালে পল্লবীর ওষুধ ব্যবসায়ী জাহিদুল ইসলাম রাসেল হত্যাকাণ্ড ঘটায় শাহাদাত বাহিনী।

এদিকে কাফরুলে সক্রিয় রয়েছে শাহীন শিকদারের গ্রুপ। গত বছরের ১৩ অক্টোবর কাফরুলে চাকু মেরে হত্যা করা হয় ব্যবসায়ী মিজানুর রহমানকে। একই বছরের ৩১ অক্টোবর ইব্রাহিমপুর এলাকায় শাহজাহান রুবেল নামে আরেক ব্যবসায়ীকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় গ্রেফতার করা হয় শাহীন শিকদারের সহযোগী শিপন শিকদারকে।

শাহীন শিকদার গ্রুপে জিল্লুর, রাসেল, কানা জাহাঙ্গীর, আজাদ, শাহনেওয়াজ, মামুন, রূপচান, নিজাম, মানিক, রাজিবসহ অনেকেই সক্রিয় রয়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী কিলার আব্বাস এক সময় কাফরুল, ভাসানটেক ও মিরপুরে চাঁদাবাজির একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করত। শাহীন শিকদার ছিল সেকেন্ড ইন কমান্ড।

কিলার আব্বাস গ্রেফতার হওয়ার পরই শাহিন শিকদার নিজ নামে পৃথক বাহিনী তৈরি করে। এরপর বিভিন্ন সময়ে কিলার আব্বাস ও শাহিন শিকদারের গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনাও ঘটে। বর্তমানে শাহিন শিকদার বিদেশে বসে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছে।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই’র বিশেষ পুলিশ সুপার বশির আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, কিলার সবুজের তথ্যের ভিত্তিতে অনুসন্ধান এবং অপরাধীকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা অব্যাহত আছে।

র‌্যাব-৪-এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার সাজেদুল ইসলাম বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাতের বাহিনী ও শাহিন শিকদার বাহিনীর কারণে মিরপুর এলাকায় কেউ ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারত না। এ দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী ভারতে বসে শিষ্যদের মাধ্যমে চাঁদাবাজি করে। এরইমধ্যে র‌্যাবের হাতে শাহাদাত বাহিনীর দুই সদস্য গ্রেফতার ও বন্দুকযুদ্ধে একজন নিহত হয়েছে।

এদিকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ উত্তর বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বিদেশে বসে ফোনে চাঁদা দাবি বা অশান্তি সৃষ্টিকারী গ্রুপের অনেককেই ইতোপূর্বে আমরা গ্রেফতার করেছি। কেউ কেউ বন্দুকযুদ্ধে মারাও গেছে। তিনি বলেন, মানুষ চাঁদাবাজির শিকার হলেও থানায় যায় না, মুখ খোলে না। ভুক্তভোগী মুখ না খুললে আমাদের পক্ষে কিছু করা কঠিন হয়ে পড়ে। সূত্র – যুগান্তর


শর্টলিংকঃ