Site icon ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ

বিনা পয়সায় বই বিলাবে পলান সরকারের উত্তরসূরীরাও


বিশেষ প্রতিবেদক :

‘দূরের পাঠকদের যাতে পড়তে সমস্যা না হয়, সে জন্য ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি পয়েন্টে বই দিয়েছি। মানুষের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়ানো বাবার এ মহতী উদ্যোগ ধরে রাখতে এলাকার আরও ৩০ থেকে ৪০টি বাজারে একটি করে দোকানে ‘পলান সরকার স্মৃতি পয়েন্ট’ গড়ে তুলব।’

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোর ফেরিওয়ালা পলান সরকার

কখনো হেঁটে আবার কখনো নিজের পুরনো একটি সাইকেলে চেপে বইয়ের ঝোলা নিয়ে গ্রামে বেরিয়ে পড়তেন পলান সরকার। কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই নিজের টাকায় কেনা বই পৌঁছে দিতেন মানুষের বাড়ি বাড়ি।

গ্রামের সহজ-সরল লোকগুলোকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করাই ছিল তাঁর ধ্যান। তবে নিজের পাঠাগার, অসংখ্য বই আর বইপ্রেমীদের ছেড়ে তিনি এখন না ফেরার দেশে। তাই বলে জ্ঞান বিলানোর তার সেই পথচলা থেমে থাকছে না, সে দায়িত্ব নিয়েছেন তার ছেলে-মেয়ে এবং শুভানুধ্যায়ীরা।

‘বাবা চলে গেছেন! কিন্তু রেখে গেছেন অনেক স্মৃতি। মনে পড়ছে, খেয়ে না খেয়ে যখন-তখন বাবার বই নিয়ে বেরিয়ে পড়ার দৃশ্য! চা খাওয়ার জন্য টাকা নিয়ে সেই টাকায় কলম কিনে গ্রামের স্কুলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের তা উপহার দেওয়ার দৃশ্য চোখে ভাসছে। এলাকার ২০ গ্রামে বাবা বই পড়ার অভিনব যে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন, আমরা ৯ ভাই-বোন তা ধরে রাখব।

রাজশাহীর বাঘার বাউসা গ্রামের সদ্যপ্রয়াত ‘বইপ্রেমী’ ও একুশে পদকপ্রাপ্ত পলান সরকারের ছেলে হায়দার আলী সোমবার বিকেলে এভাবেই তার উদ্যোগের কথা জানান। তিনি স্থানীয় খাগড়বাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক এবং পলান সরকার পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পলন করছেন।

পলান সরকারের পাঠাগার

বাবার মতোই বইপাগল হায়দার আলী বলেন, ‘দূরের পাঠকদের যাতে পড়তে সমস্যা না হয়, সে জন্য ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি পয়েন্টে বই দিয়েছি। মানুষের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়ানো বাবার এ মহতী উদ্যোগ ধরে রাখতে এলাকার আরও ৩০ থেকে ৪০টি বাজারে একটি করে দোকানে ‘পলান সরকার স্মৃতি পয়েন্ট’ গড়ে তুলব।’

হায়দার আলী আরও বলেন, ‘বার্ধক্যের কারণে চলতে না পারায়, শেষদিকে বাবার পাঠাগার দেখাশোনার দায়িত্ব আমার ওপরই পড়ে। সেখানে বাবা অসংখ্য বই রেখে গেছেন। তবে নিত্য-নতুন বইয়ের সমারোহে এ পাঠাগারকে আরও বেশি আধুনিকায়ন করতে চাই।’

তিনি বলেন, ‘বাবা ছিলেন একজন সাদামনের মানুষ। তিনি কখনো অন্যের দয়াদাক্ষিণ্য পছন্দ করতেন না। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জ্ঞানের আলো ছড়াতে তিনি জেলার ২০টি গ্রামে গড়ে তুলেছেন অভিনব শিক্ষা আন্দোলন। সেই আন্দোলন চলমান রাখতে ও বাবার নীতি-আদর্শকে ধরে রাখতে আমরা ৯ ভাইবোন সবাই আন্তরিক।’

‘আমাদের বাবা ছিলেন একজন বইপাগল মানুষ। জন্মের মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় তিনি পিতৃহারা হন। আর্থিক অনটনের কারণে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময়ই লেখাপড়ায় ইতি টানতে হয় তাকে। কিন্তু নিজের পড়ালেখা বেশি দূর চালিয়ে নিতে না পারলেও মানুষকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করতে তিনি নিজের জীবন-যৌবন ত্যাগ করেছিলেন।’

পলান সরকার পাঠাগার এভাবে বাঁচিয়ে রাখতে চান তাঁর ছেলেরা

হায়দার বলেন, ‘মানুষকে ভালোবেসে সংসার, পরিবার-পরিজন থেকেও ছিলেন কিছুটা দূরে। নিজের টাকায় বই কিনে বিনামূল্যে পড়তে দিতেন পিছিয়ে পড়া গ্রামের মানুষকে। ওনার লক্ষ্য ছিল- গ্রামের প্রত্যেকটি মানুষ যেন বইয়ের আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে। কাজেই নিজের জীবন দিয়ে হলেও বাবার এ মহতী লক্ষ্য আমরা ধরে রাখব।’

এদিকে আলোকিত এ মানুষটির স্মৃতি ধরে রাখতে তার প্রতিষ্ঠিত হারুনুর রশিদ শাহ উচ্চ বিদ্যালয়কে জাতীয়করণের আশ্বাস দিয়েছেন জেলা প্রশাসক এসএম আবদুুল কাদের।

গত রোববার স্মৃতিচারণ করে বক্তব্য প্রদানকালে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের বাবা শামসুদ্দীন বাউসায় ‘পলান স্মৃতি পাঠাগার’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন।

এছাড়া পলান সরকারের অভিনব এ বই পড়ানোর আন্দোলন ধরে রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের আশ্বাস দিয়েছেন বাঘা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শাহিন রেজা।

মেয়ে রোকেয়ার সাথে পলান সরকার

জানা যায়, ১৯২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর নাটোরের বাগাতিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন পলান সরকার। তার আসল নাম হারেজউদ্দিন সরকার। সামাজিকভাবে জ্ঞানবৃদ্ধিতে অবদান রাখায় ২০১১ সালে তিনি পান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান ‘একুশে পদক’।

গত ১ মার্চ বার্ধক্যজনিত কারণে সাদামনের এ মানুষটি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। পরদিন নিজের প্রতিষ্ঠিত পাঠাগারের অদূরে স্ত্রীর কবরের পাশে বইপ্রেমী মানুষটি চিরনিদ্রায় শায়িত হন।

তিনি চলে গেছেন, তার না থাকার শূন্যতা আমাদের অনেককে হয়তো তাড়া করে বেড়ায়। কিন্তু ৯৮ বছরের জীবদ্দশায় স্বল্প শিক্ষিত একজন মানুষ হয়ে যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা সমাজের জন্য অনুকরণীয়। তার মতো তৈরি হোক হাজারো মানুষ, আলোকিত করুক পুরো দেশ- এমনটাই প্রত্যাশা পরিবারের।


Exit mobile version