বিমানবন্দরের উন্নয়ন প্রকল্পে নানা অনিয়ম


ইউএনভি ডেস্ক:

দেশের বিমানবন্দরগুলোর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে বড় ধরনের অনিয়ম ও অসঙ্গতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দুটি প্যাসেঞ্জার টার্মিনালের আধুনিকায়ন প্রকল্পে নানা অসঙ্গতি এবং পণ্য ও সেবার দরের ব্যাপারে অস্বাভাবিক প্রস্তাব দিয়েছে বেবিচক।


ফলে এটি চূড়ান্ত না করে ফেরত পাঠিয়েছে বেসামরিক, বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে দর পর্যালোচনা করে যেখানে বেশি ধরা হয়েছে, তা কমিয়ে নতুন প্রস্তাব পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়।

এছাড়া কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্প নিয়েও নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা জানান, প্রকল্পের দরপত্র চূড়ান্তকরণের সময় সরকারের পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন অমান্য করা হয়েছে।

মানা হয়নি সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) ধারা। পোস্ট কোয়ালিফিকেশন ছাড়াই সর্বনিু দরদাতা নির্বাচন করা হয়েছে। করোনার অজুহাত দেখিয়ে দরদাতার দাখিলকৃত দলিলপত্র সঠিক কিনা তা যাচাই-বাছাই না করেই চূড়ান্ত করা হয়েছে। দেখা হয়নি দরদাতার টার্নওভারসংক্রান্ত ব্যাংকের ডকুমেন্ট।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এসব প্রকল্প নিয়ে মামলা হতে পারে- এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মামলা-মোকদ্দমা হলে প্রকল্পগুলো অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। ঝুলে যাবে সরকারের অগ্রাধিকার এসব প্রকল্প। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, পর্যটন সম্ভাবনা কাজে লাগাতে কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার কাজটি মুখ থুবড়ে পড়েছিল এ প্রকল্প পরিচালকের (পিডি) দুর্নীতি, ব্যর্থতা ও অদক্ষতার কারণে। তার জন্য সরকারের অপচয় হয়েছে শত কোটি টাকার বেশি। বাধ্য হয়ে প্রকল্প পরিচালককে বরখাস্ত করা হয়েছে।

সম্প্রতি এ বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্প নিয়েও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, এ প্রকল্পে পিপিআর (পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রেগুলেশন) ২০০৮-এর বিধি-৮ ও পিপিএ (পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন) ২০০৬-এর আইনের ধারা-৭ লঙ্ঘন করা হয়েছে। এ দুই আইন অনুযায়ী সাধারণত যে সব দরপত্র সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি থেকে অনুমোদিত হয় সেগুলো মূল্যায়নের জন্য একটি স্থায়ী কমিটি গঠন করা আছে।

অনুমোদিত মূল্যায়ন কমিটিতে মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) পদটিকে মূল্যায়ন কমিটির সদস্য হিসেবে নির্ধারিত আছে। কিন্তু অভিযোগ আছে, সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দরপত্র এবং কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্প কাজের দরপত্র মূল্যায়নে মন্ত্রণালয় রহস্যজনক কারণে একজন অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে কমিটিতে রেখেছে এবং তাকে দিয়ে মূল্যায়ন করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন- নিয়ম হল, যদি কোনো অতিরিক্ত সচিবকে মূল্যায়ন কমিটিতে রাখতে হয় তাহলে দরপত্র আহ্বানের আগেই কমিটির সংশোধন করে আদেশ জারি করতে হবে। এ অবস্থায় কক্সবাজার ও সিলেট বিমানবন্দরের দুটি প্রকল্পের মূল্যায়ন নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তবে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট একজন শীর্ষ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এ বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে করা হয়েছে। তাছাড়া আইনে বলা আছে, যুগ্ম সচিব অথবা তার উপরের কর্মকর্তাকে দিয়ে মূল্যায়ন করাতে হবে। কাজেই এখানে কোনো অনিয়ম হয়নি।

অপর একটি সূত্রে জানা গেছে, সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি যে কোনো দরপত্র অনুমোদনের জন্য সরকারের সিপিটিইউ (সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট) থেকে প্রস্তুতকৃত স্ট্যান্ডার্ড ফরমেটে প্রায় ৩০টি তথ্য মেনে কাজ করার কথা। কিন্তু অভিযোগ আছে, কক্সবাজার বিমানবন্দরের সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের দরপত্র পোস্ট কোয়ালিফিকেশন নিয়ে নিয়মনীতি লঙ্ঘন করা হয়েছে। এমনকি পোস্ট কোয়ালিফিকেশন পর্যন্ত করা হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আইনে এ লঙ্ঘন ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, কক্সবাজার প্রকল্প কাজের দরপত্র মূল্যায়নে করোনাকালীন সময়সহ অন্যান্য অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের কথা বলে প্রকল্পের পোস্ট কোয়ালিফিকেশন করা হয়নি। আইন অনুযায়ী পোস্ট কোয়ালিফিকেশনের উদ্দেশ্য হল ঠিকাদারের দাখিলকৃত দলিলাদি (কারিগরি ও আর্থিক) সঠিক কিনা- সেগুলো তার মূল দলিলাদির সঙ্গে যাচাই করে নেয়া।

কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্পে কাজ এবং সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ কাজের কোনোটির ক্ষেত্রেই এটি করা হয়নি। দরপত্র দাখিলের সময় ঠিকাদার টেন্ডার ডকুমেন্টের নির্দেশনা অনুসরণ করে অভিজ্ঞতা সনদ, ‘টেন্ডারারস কান্ট্রি অফ অরিজিনে’ অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাস কর্তৃক ‘অথেনটিকেট’ করে নিয়ে দরপত্র দাখিল করার কথা। কিন্তু অভিযোগ আছে, এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশ দূতাবাসের কোনো দলিলপত্র দেয়া হয়নি।

অভিযোগ কক্সবাজার বিমানবন্দরের প্রকল্পের ক্ষেত্রে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি ‘এভারেজ অ্যানুয়্যাল কনস্ট্রাকশন টার্নওভার’ সংক্রান্ত শর্তটি নিয়েও ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ‘দরদাতা দেশি হলে টার্নওভারের সমর্থনে বাংলাদেশের তফশিলভুক্ত ব্যাংক হতে ‘স্টেটমেন্ট অব রিসিপট’ দাখিল, দরদাতা বিদেশি হলে সংশ্লিষ্ট দেশের কোনো অনুমোদিত ব্যাংক কর্তৃক দরদাতার হিসাবের বিপরীতে ইস্যুকৃত ‘স্টেটমেন্ট অব রিসিপট’ দাখিল করতে হবে।

এ প্রকল্প কাজের দরপত্রে সর্বমোট ৮টি দরপত্র দাখিল হয়। যেখানে ৩টি প্রতিষ্ঠান সব দলিলাদি যথাযথভাবে দাখিল করলেও তাদের মধ্য থেকে একটি প্রতিষ্ঠানকে রেসপন্সিভ দেখিয়ে বাকি দুটি প্রতিষ্ঠানকে নন-রেসপন্সিভ করা হয়েছে। যদিও সিপিটিইউর ব্যাখ্যায় একটি প্রতিষ্ঠান রেসপন্সিভ হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে সিলেট ওসমানী বিমানবন্দর প্রকল্প কাজের ক্ষেত্রে ২টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রেসপন্সিভ করে। তার মধ্যে ১টি প্রতিষ্ঠানের টার্নওভার কক্সবাজার বিমানবন্দরের দরপত্র মূল্যায়নে যে ২টি কোম্পানিকে নন রেসপন্সিভ করা হয়েছে তাদের মতো। অপর কোম্পানির টার্নওভার দলিলাদিতে নানা ভুল ভ্রান্তি থাকলেও ওই কোম্পানিকে রেসপন্সিভ করা হয়েছে। দরপত্র মূল্যায়ন শর্ত অনুযায়ী, দরপত্রে অংশগ্রহণকারী ঠিকাদারদের অভিজ্ঞতা ন্যূনতম ১৫ বছর থাকতে হবে। কিন্তু জানা যায়, যে কোম্পানিকে কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে ওই কোম্পানিটি ২০০৭ সালে চীনে নিবন্ধভুক্ত হয়। এতে কোম্পানির অভিজ্ঞতা ১৩ বছর হয়।

জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী বলেন, ‘আমরা কক্সবাজার প্রকল্পে অনিয়মের কারণে প্রকল্প পরিচালককে বরখাস্ত করেছি। তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। কাজেই এ প্রকল্পে কোনো ধরনের অনিয়ম সহ্য করা হবে না। শুধু কক্সবাজার বিমানবন্দরই নয়, দেশের সব বিমানবন্দরের উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

অভিযোগ আছে, কক্সবাজার বিমানবন্দর প্রকল্পের জন্য একটি কোম্পানিকে রেসপন্সিভ করা হয়েছে যে কোম্পানির জয়েন্টভেঞ্চার গঠন নিয়েও নানা অনিয়ম হয়েছে। ওই জয়েন্টভেঞ্চার কোম্পানির একটি পেরেন্ট কোম্পানিকে ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাংক কালো তালিকাভুক্ত করেছে। সে হিসাবে ওই জয়েন্টভেঞ্চার কোম্পানি কিভাবে প্রকল্পে অংশ নিয়েছে সেটি নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সুত্র- যুগান্তর


শর্টলিংকঃ