Site icon ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ

বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্র হরণের জন্য বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশনেই তৈরি সান্ধ্যকোর্স


সালটা ২০০৭, রাবিতে সেই সর্বপ্রথম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে নৈশ কোর্স চালুর উদ্যোগ নেয়া হল। পরিকল্পনাপত্র দেখে বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই মানের ছাত্রছাত্রীরা পড়বে। যারা মেইনস্ট্রিমে থাকবে তাদের অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ভর্তি হতে হবে, মান যাচাই পদ্ধতি হবে শক্ত। আর যারা বেশি টাকা দিয়ে পড়বে তাদের ভর্তির ক্ষেত্রে প্রায় কোন যোগ্যতাই দেখা হবেনা। মান যাচাই হবে অনেক শিথিল ধরনের।

বিকেলেই ক্যাম্পাসে দেখা হয়ে গেল প্রফেসর মুশফিক আহমেদের সাথে। প্রসঙ্গটি পাড়তেই বললেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্র হননকারী এই উদ্যোগ থামাতে হবে, এবং এখনই। তিনিই একটি ড্রাফট তৈরি করলেন। পরের দুইমাস সেই ড্রাফট নিয়ে একেবারে আক্ষরিক অর্থেই প্রতিটি শিক্ষকের দ্বারে দ্বারে আমরা ঘুরেছি। তখন রাবি’র শিক্ষক সংখ্যা হাজার পেরোয়নি। ৭০০ এর বেশি শিক্ষক সেই ড্রাফটে স্বাক্ষর করেছিলেন। সেই অর্থে আমরা খুবই সফল হয়েছিলাম।

তবে তখনই কিছু অদ্ভুত বৈশিষ্ট আমরা লক্ষ করেছিলাম। বাণিজ্য এবং আইন অনুষদের প্রায় কেউই এই ড্রাফটে স্বাক্ষর করেননি। যাদের প্রগতিশীলতার ধ্বজাধরী বলে ভাবতাম তাদের অনেকেই পারলে আমাদের ধরে মারেন। ভাবখানা এমন যেন তাদের মুখের গ্রাস আমরা কেড়ে নিচ্ছি। আবার কলা অনুষদের দলমত নির্বিশেষে স্বাক্ষর দিয়েছেন। বিজ্ঞান এবং সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের যেসব বিভাগে নৈশ কোর্সের তেমন চাহিদা নেই তারা সবাই এতে স্বাক্ষর করেছেন, আর যারা ভেবেছেন যে এখানে তাদের সুবিধা হতে পারে তারা আমাদের উদ্যোগের বিরোধিতা করেছেন।

নৈশ কোর্সের প্রসঙ্গ এলেই আমার সিন্দবাদের সেই দৈত্যের কথা মনে পড়ে যায়। ঝড়ে জাহাজ ডুবির পরে নাবিকেরা একটি দ্বীপে আশ্রয় নেয়। সে এক অদ্ভুত দ্বীপ- যেখানে থরে থরে সাজানো থাকে উপাদেয় সব খাবার। নাবিকেরা মনের আনন্দে সেই খাবার খায়। কিছুদিন পর সেই দ্বীপে আসে এক দৈত্য। সবচে হৃষ্ট পুষ্ট মানুষটিকে সে খাদ্য বানানোর জন্য ধরে নিয়ে যায়।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্র হরণের জন্য বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশনেই তৈরি এইসব নৈশ কোর্স আর হেকেপ। শিক্ষকদের টাকার প্রলোভনে আস্টে পৃষ্ঠে বেঁধে শিক্ষার বাণিজ্যিকিকরণের পথ উন্মুক্ত করা- প্রশস্ত করা। প্রতিবাদ হয়েছে- প্রতিরোধের চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু তা সফল হয়নি। হালে এতে প্রাণ পেয়েছে যখন খোদ মহামান্য রাষ্ট্রপতি অত্যন্ত চাঁছা ছোলা ভাষায় এর সমালোচনা করেছেন। যে ইউজিসি এতকাল ধরে এইসব বটিকা আমাদের গিলিয়েছে তারাও এখন পালটি খেয়ে নৈশ কোর্স বন্ধের ফরমায়েশ করছেন।

কিন্তু এত কি হবে সিধে? যে বাঘ একবার রক্তের স্বাদ পেয়েছে আপনি তার মুখ থেকে মাংশের টুকরো কেড়ে নিতে পারবেন? ইউজিসির কোন কর্তৃত্বই নেই আমাদের ওপরে খবরদারি করার। তারা বড়জোর কিছু দিকনির্দেশনা দিতে পারেন। যা করার তা আমাদেরই করতে হবে। যারা নৈশ কোর্সের পক্ষে তারা আমাদের বিরুদ্ধে প্রায়ই অভিযোগ তোলেন যে আমরা শিক্ষা সংকোচনের পক্ষে। শিক্ষকেরা যদি তাদের বাড়তি সময়ে অতিরিক্ত কাজ করে কিছু আয় করেন তাতে আপনাদের চোখ পোড়ায় কেন? না, মোটেই পোড়ায় না।

যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যথাযথভাবে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করার পর কারো কাছেই বাড়তি সময় থাকার কথা নয়, তবে কেউ যদি সত্যিই তেমন কর্মক্ষম হন, করুননা অতিরিক্ত কাজ বুয়েটের শিক্ষকেরা যেভাবে করে থাকেন। একটা নির্দিষ্ট অংকের টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দিয়ে আপনি কনসালটেন্সি করুন বাইরের প্রতিষ্ঠানের সাথে। আর যদি মনে করি যে আমাদের পর্যাপ্ত শিক্ষক আছে, ভৌত অবকাঠামো আছে, যাতে আমরা আরেক শিফট ছাত্র ছাত্রী পড়াতে পারি তবে আসুন আমরা দাবি করি যে প্রতিটি বিভাগে আসন সংখ্যা দ্বিগুন করা হোক।

একই ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে সব ছাত্রছাত্রী ভর্তি হবে, তারা একই বেতন দেবে, তাদের একই মূল্যায়ন পদ্ধতি অনুসরণ করে ডিগ্রি দেয়া হবে। আর শিক্ষকেরা যেহেতু দ্বিগুন কাজ করবেন, তাদের মূল বেতনও দ্বিগুন করে দিতে হবে। ঝুঁকি ভাতা বলে একটি ভাতার প্রচলন তো সব সরকারি প্রতিষ্ঠানেই আছে ক্ষেত্র বিশেষে যা মূল বেতনের কয়েকগুণ। শিক্ষকেরা ‘শিক্ষা সম্প্রসারণ ভাতা’র আওতায় না হয় দ্বিগুণ ভাতাই পেলেন। কিন্তু নৈশ কোর্স আর নয়।

শিক্ষা পণ্য নয়, ভবিষ্যত প্রজন্মকে গড়ে তোলার জন্য বিনিয়োগ। আসুন এই দাবিতে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় জনগণের টাকায়, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য পরিচালিত হোক।

লেখক : প্রফেসর ড. রহমতউল্লাহ ইমন , বল স্টেট ইউনিভার্সিটি, ইন্ডিয়ানা, যুক্তরাষ্ট্র


Exit mobile version