Site icon ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ

বীর বিক্রম আবদুল খালেক এর জবানিতে মুক্তিযুদ্ধ


বীর বিক্রম আবদুল খালেক এর জবানিতে মুক্তিযুদ্ধ :   ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালে বাবার ইচ্ছায় স্বেচ্ছা অবসর নেন। পাকিস্তানী হায়েনাদের ঘাঁটিতে গ্রেনেড হামলা করতে এগিয়ে গিয়েছিলেন একাত্তরের ৩ সেপ্টেম্বর। কিন্তু গ্রেনেড ছোঁড়ার আগেই আহত হন তিনি। শত্রুবাহিনীর একটা গুলি বুক ভেদ করে চলে যায় তার। জীবনের মায়া ত্যাগ করে সাত নম্বর সেক্টরের আরও বেশকিছু সম্মুখসমরে অংশ নেন তিনি।

এখন জানা যাক তাঁর নিজ জবানিতে (লিখিত) কিছু কথা:

‘আমি যুদ্ধাহত ও খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। ক্রমিক সংখ্যার ভুলের কারণে সরকার প্রদত্ত যুদ্ধাহত ভাতা এবং খেতাবের সুবিধা পাইনি। গেজেটে (১৯৭৩) আমার ক্রমিক নম্বর ৬২। এতে সৈনিক নম্বর ৬৩০২৯১। আমার সৈনিক নম্বর ৬৩০২১৯। আমার জানা মতে, ৬৩০২৯১ নম্বর একজন পাকিস্তানির। তার নাম কিউ এ জামান।
‘১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার আগে আমি সিভিলিয়ান ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাকে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর নায়েক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি আর সেনাবাহিনী বা নৌবাহিনীতে চাকরি করিনি।

‘১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের শেষে একদিন তৎকালীন ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন আহমদ চৌধুরী (বীর বিক্রম, পরে ব্রিগেডিয়ার) আমাকে ডেকে বললেন, “তোমাকে একটি অপারেশনে যেতে হবে।” এটা আমার জীবনের উল্লেখযোগ্য অপারেশন। তাঁর কথামতো আমি এমএফের (নিয়মিত বাহিনী) দিলদার, হাকিম, রাজ্জাক, রেন্টু প্রমুখ এবং এফএফের (গণবাহিনী) নূর হামিম রিজভী (বীর প্রতীক), দাউদ, নজরুল প্রমুখকে সঙ্গে নিয়ে ৩ সেপ্টেম্বর লালগোলা থেকে আখরিগঞ্জ যাই। সেখানে আমাদের সঙ্গে আরও কয়েকজন যোগ দেন।

‘আমরা বাংলাদেশের ভেতরে এসে আদিবাসী পল্লির এক বাড়িতে আশ্রয় নিই। রেকির তথ্য পাওয়ার পর রাতে (৫ সেপ্টেম্বর) অপারেশন করার জন্য বের হই। যাওয়া ও ফেরত আসার একমাত্র পথের এক স্থানে (সিরাজুল চেয়ারম্যানের বাড়ি) ছিল রাজাকার ক্যাম্প। রাজাকাররা যাতে পাল্টা আক্রমণ করতে না পারে, সে জন্য ওই বাড়ির অদূরে ছয়জন মুক্তিযোদ্ধাকে পাহারায় রেখে যাই।

মসেই রাতে বৃষ্টি হয়। মেঘ সরে যাওয়ার পর চাঁদের আলোয় দূরের অনেক কিছু দেখা যাচ্ছিল। রাজাকাররা সেখানে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে ফেলে এবং গুলি শুরু করে। এর আগেই অবশ্য আমরা প্রেমতলি হাসপাতাল পার হয়ে সেতুর কাছে পৌঁছি। রাজাকাররা গুলি শুরুর পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রেমতলি ক্যাম্প থেকে দুটি গাড়ির একটি কলেজের সামনে, অপরটি ইব্রাহিম শাহর বাড়ির কাছ অবস্থান নিয়ে গোলাগুলি শুরু করে। পাকিস্তানিদের কাছাকাছি আরও দুটি অবস্থান থেকেও গুলি শুরু হয়।

‘চারদিক থেকে ফায়ার শুরু হওয়ার পর আমি সহযোদ্ধাদের নিয়ে সেখানেই অ্যাম্বুশ করি; যদি পাকিস্তানি গাড়ি আসে, এ আশায়। কারণ, আমরা বিল ও নদী পার হতে পারিনি। পার না হয়ে সরাসরি আক্রমণ করাও সম্ভব ছিল না। প্রায় তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করি। কিন্তু পাকিস্তানিরা আসেনি।
মএরপর আমরা পেছনে রওনা দিই। আমাদের কাছে যোগাযোগ-যন্ত্র (ওয়্যারলেস) ছিল না। ফলে পেছনে রাজাকার ক্যাম্পের কাছে থাকা সহযোদ্ধারা কী অবস্থায় আছেন, তা জানতে পারিনি; তাঁরাও আমাদের অবস্থা জানতে পারেননি। গোলাগুলি শুরু হওয়ার পর তাঁদের আরও পেছনে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার খবর আমরা জানতাম না।

‘আমরা চেয়ারম্যান বাড়ির দক্ষিণে পুকুরপাড়ে যাওয়া মাত্র রাজাকাররা আমাদের দেখে ফেলে এবং গুলি শুরু করে। আমি সহযোদ্ধাদের পাল্টা আক্রমণ চালাতে বলি। রাজাকাররা ছিল দালানবাড়ির ছাদে। সেখান থেকে তারা গুলি অব্যাহত রাখে। পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে আমরা সুবিধা করতে পারছিলাম না। কারণ, এলিভেট করলে গুলি ওপর দিকে যাচ্ছিল, আবার ডিপ্রেস করলে দেয়ালে লাগছিল। আমাদের কাছে মর্টার ছিল না।

মএ অবস্থায় আমি ছাদে গ্রেনেড চার্জ করার কথা ভাবি। কিন্তু কেউ তা করতে রাজি না হওয়ায় আমি নিজেই তা করার সিদ্ধান্ত নিই। জয়নাল নামে একজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে আমি রওনা হই। তিনি আমার বেশ পেছনে ছিলেন এবং একপর্যায়ে হঠাৎ চিৎকার করে ওঠেন। আমি ভাবি, তাঁর গুলি লেগেছে। তখন আমি তাঁর কাছে যাই। দেখি তাঁর কিছু হয়নি। এ সময় আরও কিছু ঘটনা ঘটে এবং জয়নাল হঠাৎ তাঁর এসএলআর দিয়ে গুলি করেন। তখন রাজাকাররা পাল্টা গুলি চালায়। একটি গুলি আমার বুকে লাগে।’

আবদুল খালেক বিদিরপুর সেতু, হরিপুর সেতু, অভয়া সেতু অপারেশনসহ আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য অপারেশন করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার (ডাক: রাজাবাড়ি) চাঁপাল গ্রামে। তাঁর বাবার নাম কামির উদ্দীন মণ্ডল, মা গোলজান বিবি। স্ত্রী মাসুরা খাতুন। তাঁদের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে।
সূত্র: আবদুল খালেক বীর বিক্রমের লিখিত বয়ান, মো. ইমরান হোসেন (সারোইল, গোদাগাড়ী, রাজশাহী) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর-৭।


Exit mobile version