- ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ - https://universal24news.com -

বীর বিক্রম আবদুল খালেক এর বুক ভেদ করে গিয়েছিল গুলি


বীর বিক্রম আবদুল খালেক  পাকিস্তানী হায়েনাদের ঘাঁটিতে গ্রেনেড হামলা করতে এগিয়ে গিয়েছিলেন একাত্তরের ৩ সেপ্টেম্বর। কিন্তু গ্রেনেড ছোঁড়ার আগেই আহত হন তিনি। শত্রুবাহিনীর একটা গুলি বুক ভেদ করে চলে যায় তার। জীবনের মায়া ত্যাগ করে সাত নম্বর সেক্টরের আরও বেশকিছু সম্মুখসমরে অংশ নেন তিনি। সেই অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা আবদুল খালেক স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর ‘বীর বিক্রম’ হিসেবে খেতাব বুঝে পেয়েছেন।

বীর বিক্রম আবদুল খালেক

কিন্তু এতোদিন পর রাষ্ট্রের এই স্বীকৃতি একটুও খুশি করতে পারেনি তাকে। আবদুল খালেকের বাড়ি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চাপাল গ্রামে। বীর বিক্রম হিসেবে ১৯৭৩ সালেই তিনি গেজেটভুক্ত হন। ২০০৪ সালের সংশোধিত গেজেটেও তার নাম থাকে। বিষয়টি খালেক জানতে পারেন ২০১১ সালে। কিন্তু ওই গেজেটেই তার ঠিকানা ছিল না। সংশোধন করার জন্য অনেকবার আবেদন করেছেন। কিন্তু সাড়া পাননি। অবশেষে গেল ২৪ মার্চ খালেকের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানাসহ নতুন গেজেট প্রকাশ হয়েছে। কয়েকদিন আগে তিনি এই গেজেট হাতে পেয়েছেন।

বৃহস্পতিবার (২৫ জুন) সকালে আবদুল খালেক বলেন, ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর একাত্তরের দোসররা আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠে। তিনি গ্রামছাড়া হন। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তিনি ফেরারি ছিলেন। এতো দিন পর এই স্বীকৃতি তাকে খুশি করতে পারেনি।এতো দিন কেন আমার স্বীকৃতি বুঝিয়ে দেয়া হয়নি? কোথায়, কীভাবে আছি কেউ কেন আমার খোঁজ নেয়নি?’- বলেন তিনি।

আবদুল খালেক ১৯৬৩ সালে যোগ দিয়েছিলেন নৌবাহিনীর একজন পেটি অফিসার (পিও) হিসেবে। পারিবারিক কারণ দেখিয়ে ১৯৬৯ সালে তিনি চাকরির ইস্তফাপত্র জমা দেন। তখন তাকে সব দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। তবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা শর্ত দিয়ে বলেছিলেন, তাকে রিজার্ভ ফোর্সে রাখা হলো। দেশের প্রয়োজন পড়লে তাকে আবারও চাকরিতে যোগ দিতে হবে। এরপর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আবদুল খালেকের ডাক পড়ে। তিনি যান।

কিন্তু যোগ দিয়ে তিনি চট্টগ্রাম থেকে রাজশাহী চলে আসেন। এখানে সাত নম্বর সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেন। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় সম্মুখ সমরে অংশ নেন। রাজশাহীর পবা উপজেলার হরিপুর ব্রিজ, গোদাগাড়ীর বিদিরপুর বারোমাইল ব্রিজ, শীতলাই কুমড়াপুকুর রেল ব্রিজ ভাঙার অপারেশনে অংশ নেন। হরিপুর থেকে রাজাকারদের ধরে আনেন বিনাফায়ারে। পবার গহমাবোনা গ্রামের শান্তি কমিটির নেতা সাত্তার প্রেসিডেন্টকে হত্যা করেছিলেন অপারেশন চালিয়ে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে একটি সম্মুখ সমরে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। শেষে গোদাগাড়ীর খেতুর গ্রামে শত্রুর গুলি বিদ্ধ করেছিল তার বুক। গুলি বের হয়ে গিয়েছিল পিঠ দিয়ে।

আরও পড়তে পারেন  বীর বিক্রম খেতাব পেলেন ৫০ বছর পর

আবদুল খালেক শোনালেন সেদিনের গল্পটি। বললেন, একদিন সাত নম্বর সেক্টরের লালগোলা সাব-সেক্টরের কমান্ডার গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী ডেকে বললেন, পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে একটা কোম্পানী কমান্ড করব। এর নেতৃত্ব তুমি দিবে। আমি রাজি হয়ে গেলাম। তারপর ৩ সেপ্টেম্বর বিকালে সহযোদ্ধাদের নিয়ে ভারতের লালগোলা থেকে আখেরিগঞ্জ আসি। নদী পার হয়ে আসি গোদাগাড়ীর মালমপাড়া গ্রামে। এখানে আদিবাসীদের একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে আশ্রয় নেই। রাতের খাবার শেষ করে আমাদের গন্তব্য হয় প্রেমতলী খেতুর গ্রাম।

আবদুল খালেক বলেন, খেতুর গ্রামের সিরাজুল চেয়ারম্যানের বাড়িতে ছিল পাকিস্তানী সৈন্যদের আস্তানা। আমরা তাদের লক্ষ্য করেই প্রেমতলী যাই। তখন মুষলধারে বৃষ্টি। এলাকার চারপাশে পানি। আমরা যখন হাসপাতালের সামনে পৌঁছাই তখন রাজাকাররা আমাদের খবর পাকিস্তানি আর্মিকে পৌঁছে দিয়েছে। আশপাশে ফায়ারিং শুরু হলো। পাকিস্তানী সেনাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আমরা সিরাজুল চেয়ারম্যানের বাড়ির দিকে এগোতে শুরু করলাম।

এরপর শুরু হলো সামনাসামনি গোলাগুলি। অন্ধকারে বাড়ির ওপর থেকে নিরাপদে ফায়ারিং করে যাচ্ছিল আর্মিরা। আমাদের সবার কাছে হাতিয়ার নেই। যা আছে তা দিয়ে ওদের আঘাত করতে পারছিলাম না। শেষে আমি বললাম, কে আছো বাড়ির ওপর একটা গ্রেনেড মেরে আসো। কিন্তু তীব্র গুলির মুখে কেউ সাহস পেল না। যেহেতু আমি এ অপারেশনের কমান্ডার ছিলাম, তাই জয়নাল নামে এক সহযোদ্ধাকে নিয়ে আমিই এগিয়ে গেলাম। বাড়ির সামান্য দূরে একটা গুলি এসে বুকে ঢুকল। বুঝলাম, একটা গরম কিছু বুক ভেদ করে পিঠ দিয়ে বের হয়ে গেল।

আবদুল খালেক বলছিলেন, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর সহযোদ্ধা জয়নাল তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যান। নিজের এবং জয়নালের গামছা দিয়ে বুক বাঁধেন। ৫ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে আবার মালমপাড়া যান। সহযোদ্ধাদের বলেন, পরদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি যদি বেঁচে থাকেন তাহলে রাতে যেন তাকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। খালেকের ভাগ্য ভাল। তিনি বেঁচেছিলেন। পরদিন তাকে পদ্মা পার করে ভারতে নিয়ে যান। ৭ সেপ্টেম্বর ভর্তি করা হয় বহরমপুর হাসপাতালে। চিকিৎসার পর সুস্থ হন খালেক। তারপর ১০ ডিসেম্বর আবার ফেরেন রণাঙ্গনে। ১৬ ডিসেম্বর বাজে বিজয়ের সুর।

বীর বিক্রম আবদুল খালেক বলেন, কোন যুদ্ধের জন্য আমাকে খেতাব দেয়া হয়েছে তা জানি না। কারণ, গেজেটে লেখা হয়েছে নায়েক। কিন্তু যখন গুলিবিদ্ধ হই তখন আমি পদোন্নতি পেয়ে হাবিলদার। আর যখন চাঁপাইনবাবগঞ্জে সম্মুখযুদ্ধ করি তখন ছিলাম নায়েক। তাই আমি বুঝতে পারছি না কোন যুদ্ধের জন্য খেতাব দেয়া হয়েছে। তবে এতো দিন পরের এই স্বীকৃতি পেয়েও তিনি খুশি হতে পারেননি। কষ্ট হচ্ছে। চোখ ভিজে যাচ্ছে। আমাকে এতো দিন কেন বঞ্চিত করা হলো?

আবদুল খালেকের ছেলে আবুল হাসনাত কচি জানালেন, তার বাবা আগে থেকেই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতা পেতেন। কিন্তু তিনি দুঃখ করতেন যে তার অধীনে যুদ্ধ করা কেউ কেউ খেতাব পেয়েছেন। অথচ তিনি খেতাব পাননি। তবে ১৯৭৩ এবং ২০০৪ সালের গেজেটেই তার বাবার নাম ছিল। সেটা অসম্পূর্ণ। ঠিকানা ছিল না। শুধু ‘নৌবাহিনীর নায়েক’ লেখা ছিল। ঠিকানা না থাকায় তার বাবাকে এই স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। বিষয়টি তারা জানতে পারেন ২০১১ সালে যখন জনতা ব্যাংক নিখোঁজ খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রকাশ করে।

এরপর তারা যোগাযোগ করেন। জনতা ব্যাংক তাদের দুই লাখ টাকা আর একটি ক্রেস্ট দেয়। তারপর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি বুঝে পেতে কয়েকবার মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। বার বার নাকি কাগজপত্র হারিয়ে যায়। শেষে গেল বছর আবার আবেদন করেন। এবার সংশোধিত গেজেট প্রকাশ হয়েছে। এতে তার বাবাকে স্বীকৃতি বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। এই স্বীকৃতিতে তার বাবা কিছুটা হলেও দুঃখ ভুলবেন।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আক্তারুজ্জামান আখতার বলেন, আবদুল খালেক যে একজন লড়াকু সৈনিক ছিলেন সেটা জানতাম। কিন্তু তিনি যে খেতাববঞ্চিত ছিলেন সেটা জানা ছিল না। এখন তিনি স্বীকৃতি পাওয়ায় আমরা আনন্দিত। তাকে নিয়ে গর্ব আরও বেড়ে গেল।

আরও পড়তে পারেন  এক বটবৃক্ষের অন্যতম স্তম্ভ মূলের জীবনের গল্প