Site icon ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ

‘বোস্তামী কাছিমে’র স্বর্ণালি দিন


ইউএনভি ডেস্ক:

একটু ভালো করে তাকাতেই চোখে পড়ে ‘বোস্তামী কাছিমে’র কালো নরম শেল। আর মানুষ দেখলে মুখের সামনের চিকন সরু অংশটা তুলে পানি কেটে সে-ও এগিয়ে আসে; পাউরুটি বা কোনো খাবার দিলে হাঁ করে তুলে নেয় মুখে।

চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী মাজারের পুকুরে এ রকম সাড়ে পাঁচশ বিরল ও বিপন্নপ্রায় কাছিম এখনও টিকে আছে। পুকুরের পূর্বপাড়ে কাছিমের একমাত্র প্রজননকেন্দ্র নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কয়েক বছর ধরে ব্যাহত হচ্ছিল এদের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ডিম দেওয়া ও বাচ্চা ফোটানো।

সম্প্রতি মাজারের পাশে বন বিভাগ একটি প্রজননকেন্দ্র তৈরি করে দেওয়ায় সংকটাপন্নম্ন এই কাছিম করোনাকালেও স্বর্ণালি দিন ফিরে পেয়েছে। সংগ্রহ করা হয়েছিল এবার ৭৫২টি ডিম, যেগুলো থেকে বাচ্চা হয়েছে ২০৫টি, যা এক যুগের মধ্যে রেকর্ড।

এগুলোকে বন বিভাগ ও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পরামর্শে প্রজননকেন্দ্রে বিশেষ পরিচর্যায় বড় করা হচ্ছে। ২০১২ সালে বোস্তামী কাছিম রক্ষায় পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) হাইকোর্টে একটি রিট করলে এ ব্যাপারে পাঁচ দফা নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। এর পর থেকে পাল্টাতে থাকে পরিস্থিতি।

বায়েজিদ বোস্তামী মাজারের মোতোয়ালি অ্যাডভোকেট খোরশেদ আলম সমকালকে বলেন, পৃথিবীতে এই প্রজাতির কাছিম এখন শুধু এখানেই টিকে আছে। কয়েকশ’ বছর ধরে এগুলো মাজারের পুকুরে বসবাস করে আসছে। অতীতে এদের পরিচর্যায় তেমন নজর দেওয়া না হলেও কয়েক বছর ধরে যথাযথভাবেই দেখাশোনা করা হচ্ছে।

পরিবেশ সংগঠন ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্সের ফ্যাসিলিটি ম্যানেজার ফাহিম জাহান বলেন, বোস্তামী কাছিম পৃথিবীতে একটি চরম সংকটাপন্ন প্রাণী। তাই তাদের বংশ বৃদ্ধিতে আমরা গত দুই বছর ধরে মাজার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ করছি। ২০১৯ সালে ৫০টি ডিম থেকে আমরা ৩৪টি বাচ্চা ফোটাই। এবার ৭৫২টি ডিম থেকে ২০৫টি বাচ্চা হয়েছে। পুকুরের গজার মাছ খেয়ে ফেলে বলে আলাদা প্রজননকেন্দ্রে এগুলোকে লালনপালন করা হচ্ছে। বড় হলে পুকুরে ছাড়া হবে।

২৪ ঘণ্টা বাচ্চা পরিচর্যার দায়িত্বে থাকা এরশাদ মিয়া বলেন, বাচ্চা কাছিমগুলোর প্রধান খাদ্য পাউরুটি। তবে মাঝেমধ্যে মুরগির মাংসও খেতে দেওয়া হয়। এ ছাড়া ছোট ছোট মাছ খেয়ে থাকে বাচ্চাগুলো। এগুলো যাতে ভালো থাকে, সে জন্য প্রজননকেন্দ্রের পানি কিছুদিন পরপর পাল্টানো হয়।

বোস্তামী কাছিম বেশ কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক প্রাণী সংরক্ষণ সংস্থা আইইউসিএনের অতি বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় রয়েছে। কয়েক দশক ধরে প্রজননস্থল সংকুচিত হয়ে পড়ায় ও আবাসস্থল দূষণের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে এ কাছিম।

যূগ যুগ ধরে কাছিমগুলো পুকুরটির চার পাড়ের নরম মাটিতে ডিম পেড়েছে। কিন্তু গত কয়েক দশকে পুকুরপাড়ের মাটি শক্ত হয়ে যাওয়া, পুকুর ঘেঁষে স্থাপনা নির্মাণ; কাক, কুকুর, শিয়ালসহ নানা প্রাণী এর ডিম খেয়ে ফেলায় এ কাছিমের প্রজনন সংকট বাড়ছিল। মাজারে আসা ভক্তদের দেওয়া খাবারে পানির গুণাগুণও নষ্ট হচ্ছিল। সপ্তদশ শতকে খনন করা এ পুকুরের এক পাড়ে সিঁড়ি ও বাকি তিন পাড় কাছিমের প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র ছিল।

মার্চের প্রথম থেকে মে পর্যন্ত বোস্তামী কাছিমের ডিম পাড়ার মৌসুম। ডিম দেওয়ার ৮০ থেকে ৯০ দিন পর এর বাচ্চা ফোটে। আগে বাচ্চা ফোটার পর সেগুলো পুকুরে চলে যেত এবং পুকুরের গজার ও রাক্ষুসে মাছের খাদ্যে পরিণত হতো। বাচ্চা কাছিম রক্ষায় এখন পুকুর থেকে দূরে চারপাশে দেওয়ালঘেরা একটি প্রজননকেন্দ্র তৈরি করেছে বন বিভাগ।

বায়েজিদ বোস্তামী মাজার পুকুরের দৈর্ঘ্য ৯৮ দশমিক ৮ মিটার এবং প্রস্থ ৬১ দশমিক ৩ মিটার। শুস্ক মৌসুমে এর গভীরতা আড়াই মিটার ও বর্ষায় পাঁচ মিটারে দাঁড়ায়। মাজার কর্তৃপক্ষের হিসাবে বর্তমানে পুকুরে সাত শতাধিক কাছিম রয়েছে। তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ আহসান ১৯৮৫ সালে ‘ক্যাপচার, মার্ক ও রিলিজ’ পদ্ধতিতে একটি জরিপ চালিয়ে জানিয়েছেন, পুকুরে ৩২০টি কচ্ছপ রয়েছে। ১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে বোস্তামী মাজারের কচ্ছপের সামগ্রিক চালচিত্র ও সংরক্ষণের ঝুঁকি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বন কর্মকর্তা আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াছিন নেওয়াজ বলেন, কাছিম সংরক্ষণে বন বিভাগ থেকে একটি প্রজননকেন্দ্র তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। এগুলো সংরক্ষণে মাজার কর্তৃপক্ষকে সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে।


Exit mobile version