ব্যবসায়ীদের গলার কাঁটা তামাবিল স্থলবন্দর


ইউএনভি ডেস্ক:

পাথর ব্যবসায়ীদের জন্য সিলেটের তামাবিল স্থলবন্দর যেন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওয়্যারহাউজের ভাড়া বাবদ প্রায় ১২০০ ডলারের এক টন ডালের জন্য যে ট্যারিফ, ১০ ডলারের এক টন পাথরের জন্য সেই (সমান) ট্যারিফ। এ কারণে বন্দরে ট্রাক প্রবেশ করিয়ে লোড-আনলোড না করেই বের করে নিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।


শুধু ১০-১৫ মিনিট বন্দরে ট্রাক প্রবেশ করানোর কারণেই ব্যবসায়ীদের গুনতে হয় টনপ্রতি ২৫২ টাকা ৮২ পয়সা। এ সময়ে শুধু ট্রাক ওজন করা হয়। আর ট্রাক প্রবেশের জন্য দিতে হয় ১২০.৩৩ টাকা।

তাই এই বন্দর দিয়ে আমদানি করা পাথরের মূল্য টনপ্রতি বেড়ে যাচ্ছে ৩৭৩ টাকা ১৫ টাকা, যা সিলেটের অন্যান্য স্থলবন্দরে নেই। এ কারণে অন্যান্য স্থলবন্দরের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন তামাবিল ব্যবহার করা পাথর ব্যবসায়ীরা।

এসব বিষয় নিয়ে তামাবিল স্থলবন্দরের সহকারী পরিচালক কোনো কথা বলতে রাজি না হলেও বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কেএম তারিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘পাথর ব্যবসায়ীদের এসব সমস্যার কথা ইতোমধ্যে শুনেছি। ব্যবসায়ীরা যাতে বন্দরের সুবিধা পান, এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে পুনরায় আলোচনা করে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

জানা যায়, তামাবিল স্থলবন্দর সিলেট বিভাগের একমাত্র এবং দেশের ১১তম স্থলবন্দর। এ বন্দর দিয়ে ভারত থেকে কয়লা, পাথর, চুনাপাথর, ফল ইত্যাদি আমদানি করা হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে দেশটিতে ইট, প্রক্রিয়াজাত খাবার, প্রসাধনী পণ্য ইত্যাদি রপ্তানি করা হয়। ৬৯ কোটি ২৬ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত স্থলবন্দরটি ২৩.৭২ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত।

২০১৭ সালের ২৭ অক্টোবর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে স্থলবন্দরটি। বর্তমানে এই বন্দর দিয়ে আমদানি হওয়া পণ্যের মধ্যে ৯৮ শতাংশই পাথর। সরেজমিনে দেখা যায়, বন্দরটিতে প্রবেশের জন্য আমদানীকৃত পাথরবোঝাই ট্রাকের লাইন। একটি ট্রাক প্রবেশ করে একবার ওজন দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে পাওয়া নাদিয়া স্টোর নামের এক আমদানিকারকের একটি বিলে দেখা যায়, সেদিন ২৪ টন পাথর আমদানি করেছেন তিনি।

২টি ট্রাক বন্দরে ঢুকে ওজন করেই বন্দর থেকে বের হয়ে পাশের ব্যক্তিমালিকানা স্থানে নিজের শ্রমিক দিয়ে আনলোড করাচ্ছেন পাথর। কিন্তু বন্দর কর্তৃপক্ষের বিলে দেখা যায়, ২৪ টনে তাকে পরিশোধ করতে হয়েছে একদিনের ওয়্যারহাউজ ভাড়া বাবদ প্রতি টনের জন্য ১২.০২ টাকা হারে ২৮৮.৪৮ টাকা, নিজের শ্রমিক দিয়ে ব্যক্তিমালিকানা স্থানে আনলোড করলেও বন্দর কর্তৃপক্ষকে আনলোড আর লোডের জন্য প্রতি টনে ১২০.৪০ টাকা হারে ২৮৮৯.৬০ টাকা, বন্দরে ট্রাক প্রবেশের চার্জ হিসাবে ১২০.৩৩ টাকা এবং ট্রাকটি একবার ওজন করেই বন্দর থেকে বেরিয়ে গেলেও দুইবার ওজনের জন্য প্রতি ট্রাকে ৬০.২০ টাকা হারে ২৪০.৮০ টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে ওই আমাদানিকারককে।

এসব বিষয় নিয়ে তামাবিল কয়লা পাথর আমদানিকারক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সারোয়ার হোসেন সেদু বলেন, ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা ছিল এই স্থলবন্দর ব্যবহার করে তারা লাভবান হবেন। কিন্তু এই স্থলবন্দর তাদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনি বলেন, শুধু একবার ওজনের সেবা পান ব্যবসায়ীরা; কিন্তু দিতে হয় দুইবার ওজনের চার্জ। এছাড়া এমন আরও চার্জ পরিশোধ করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। লোড-আনলোডের জন্য প্রতি টনে ১২০.৪০ টাকা নেওয়া হয়। তাই ট্যারিফ বেশি হওয়ায় ব্যবসায়ীরা বন্দরে লোড-আনলোড করেন না। তিনি অভিযোগ করেন, ঠিকাদার কোনো সেবা না দিয়েই প্রতিদিন প্রায় কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।

একই কথা বলেন ব্যবসায়ী সংগঠনটির সিনিয়র সহসভাপতি মনিরুজ্জামান মিন্টু। তিনি বলেন, সেবা না দিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জোর করে টাকা নেওয়া হচ্ছে। এ যেন নীরব চাঁদাবাজি। কিন্তু বিভিন্ন স্থানে অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি। ব্যবসায়ী ইলিয়াস উদ্দিন লিপু বলেন, নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরা।

এই বন্দর দিয়ে আমদানি করায় প্রতি টনে অতিরিক্ত ৩৭৫ টাকা ভ্যাটসহ প্রায় ৪৫০ টাকা পাথরের দাম বেশি পড়ছে। কিন্তু সিলেটের অন্যান্য স্থলবন্দরের ব্যবসায়ীরা একই দামে মেঘালয় থেকে পাথর আমদানি করে তাদের কোনো চার্জ দিতে হয় না। তাই ওদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছি না আমরা।

পাথর আমদানিকারক সমিতির প্রতিষ্ঠাকালীন সিনিয়র সহসভাপতি হেনরি লামিন জানান, এই বন্দরের ব্যবসায়ীরা খুব কষ্টে আছেন। ঠিকাদারের কোনো শ্রমিক নেই বন্দরে। ব্যবসায়ীরা নিজের টাকায় লোড-আনলোড করছেন। কিন্তু লোড-আনলোডের টাকা নিচ্ছেন ঠিকাদার। এতে সহযোগিতা করছেন বর্তমান সহসভাপতি জালাল আহমেদ। ঠিকাদারের সঙ্গে গোপন আঁতাঁত করে তারা প্রতিদিন মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জালাল আহমেদ বলেন, ‘ঠিকাদারের কাছ থেকে ব্যক্তিগত কোনো সুবিধা নিই না। ব্যবসায়ীরা বন্দরে লোড-আনলোড করতে চাইলে আমি শ্রমিক দেব।’

তিনি ব্যবসায়ীদের নানা অসুবিধার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘বন্দরে ওয়্যারহাউজের যে ট্যারিফ পাথরের জন্য ধরা হয়েছে, তা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত না।’

এসব বিষয়ে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কেএম তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘ফি যেটা দিতে হয়, সেটা সরকারের টেরিফ শিডিউল অনুযায়ী এবং তা দিতে হবেই। বন্দরে লোড-আনলোডের ব্যবস্থা আছে। ঠিকাদারের শ্রমিকও আছে।’

পাথরের ক্ষেত্রে যে ট্যারিফ ধরা আছে, তা বেশি কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা তা মনে করছেন। এ বিষয় নিয়ে প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে ব্যবসায়ীদের আলোচনা হয়েছে।


শর্টলিংকঃ