ব্রিটিশদের দেখানো স্বপ্নের পেছনে আজো ছুটছে ওরা


বিশেষ প্রতিবেদক :

সরকারের নানা উন্নয়ন প্রকল্পের ছিটেফোঁটাও জোটে নি হরিজন সম্প্রদায়ের ভাগ্যে । ফলে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন তারা।শিক্ষা অর্জনের পর চাকরিরও নিশ্চয়তা নেই। বিশ্লেষকরা বলছেন, অবহেলিতদের ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও শিক্ষার অভাব না মেটাতে পারলে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি পূরণ করা সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়বে।

রাজশাহীর হেতেমখা হরিজন পল্লী

স্বাধীনতার প্রায় পাঁচ দশকের কাছে এসেও সমাজের মূলস্রোতের বাইরেই থেকে গেছে সুইপার বা হরিজন সম্প্রদায়। বিশেষ করে ভোটের সময় প্রার্থীদের কাছে তাদের কদরের কমতি না হলেও পরে আর পাত্তাই দিতে চান না জনপ্রতিনিধিরা। তাই সরকারের নানা উন্নয়ন প্রকল্পের ছিটেফোঁটাও তাদের ভাগ্যে জোটে না। ফলে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন তারা। বিশ্লেষকরা বলছেন, অবহেলিতদের ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও শিক্ষার অভাব না মেটাতে পারলে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি পূরণ সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়বে।

ভালো খাওয়া-পরার প্রলোভন দিয়ে ব্রিটিশ শাসকরা ভারতের উত্তরপ্রদেশ থেকে রাজশাহী নগরীর হেতেমখার এই জায়গাতেই এনেছিল সুইপার বা হরিজন সম্প্রদায়কে। পরে এখানেই বসতি গড়ে তারা। বৃটিশ থেকে পাকিস্তান সরকার হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পার হচ্ছে ৪৭বছর। পার হয়েছে কয়েক প্রজন্ম। কিন্তু সে আশা পুরণ হয় নি এখনো।

ব্রিটিশদের দেখানো স্বপ্নের পেছনে আজো ছুটছেন তারা। এই পল্লীর প্রায় তিন হাজার বাসিন্দা এখনো কুঁড়েঘরে বাস করেন ঠাসাঠাসি করে। নেই স্যানিটেশন কিংবা কর্মসংস্থানের সুযোগ। তবে এখন নানা সঙ্কট, সমস্যা আর অবহেলার মধ্যেই বিদ্যালয়মুখী হচ্ছে রাজশাহীর হেতমখা হরিজন পল্লীর শিশুরা। এক সময় স্কুল কী? সে সম্পর্কে জানাই ছিল না তাদের। খুপরি ঘরের ঘিঞ্জি পরিবেশেই বেড়ে উঠে এক সময় বেছে নিতে হতো বাপ-দাদার পেশা। এখন সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হরিজন পল্লীর শিশুরাও যাচ্ছে স্কুলে।

হরিজন পল্লীতে বেড়ে ওঠা কয়েকজন শিক্ষার্থী

পড়াশোনার পরিবেশ নেই ঘরে, তারপরেও লেখাপড়ায় আগ্রহী পল্লীর শিশুরা। এরই মধ্যে প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার সিঁড়ি ছুঁয়েছে পল্লীর শিশুরা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়ছে কয়েকজন। আর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে পড়ছে অনেকে। আগে খুব বেশি হলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় থেকে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনার সুযোগ পেত তারা। তবে এখন প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়েছে অনেকে।  রাজশাহী নগরীর হেতমখা হরিজন পল্লীতে সরেজমিন গিয়ে এখানকার বাসিন্দা, বিদ্যালয়গামী শিশু শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

কথা হয় পল্লীর কিশোরী তানিয়া রানীর সঙ্গে। ১৮/১৯ বছরের তানিয়া শত প্রতিকূলতার মাঝেও প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে এখন পড়াশোনা করছেন রাজশাহী নগরীর শহীদ কামারুজ্জামান সরকারী কলেজের ডিগ্রীতে (পাস কোর্স)। তার দুই ভাইয়ের মধ্যে একজন রাজশাহী বিদ্যালয়ে, একজন আছেন এবি ব্যাংকে মাস্টাররোলে কর্মচারী। তাদের বাবা রামেশ্বর অন্য হরিজন বাসিন্দাদের মতোই কাজ করেন।

শুধু তানিয়া নয়, এ পল্লীর সব ঘরের শিশুরা এখনও ঘিঞ্জি পরিবেশে বেড়ে উঠে স্কুলে যাচ্ছে। তাদের পল্লীতেই রয়েছে হরিজন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখানেই সব ছাত্রই হরিজন পল্লীর। বাসায় বাবা-মায়ের সঙ্গে কাজ করে স্কুলেও যাচ্ছে তারা। অনেকে প্রাথমিকের গ-ি পেরিয়ে পড়াশোনা করছে উচ্চ মাধ্যমিকে।

রাজশাহীর হেতমখা হরিজন পল্লীর বাসিন্দা ও হেলা সমাজ পঞ্চায়েত কমিটির সহকারী মণ্ডল শ্রী হরিলাল বাবু জানান, এখানে  আবাসন সঙ্কট, কর্মসংস্থান নেই। ছেলেমেয়েরা উপযুক্ত হলেও কাজ পাচ্ছে না। ঘরে বসে বাবার আয় রোজগারেই তাদের খেতে হয়। এর মধ্যে স্কুলের পরিবেশে মিশতে পারে না অনেকে। তারপরেই তারা এখন স্কুলে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, এ পল্লীর শিশুরা স্কুলে গেলেও হরিজন পরিচয় পাওয়ার পর তাদের স্কুল থেকেই বের করে দেয়া হতো। এখনও তাদের আলাদা থাকতে হয়। স্কুলে টিফিন পায় না হরিজনের শিশুরা। পড়াশোনা করে তারা আদৌ কমসংস্থানের সুযোগ পাবে কি না এ নিয়েও শঙ্কায় রয়েছেন।

তার অভিযোগ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি তাদের প্রতিশ্রুতি দিলেও কোন কাজ করেন নি তাদের উন্নয়নে। তবে, তাদের ভরসা এখন রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনে মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। আগের টার্মে তিনি হরিজন পল্লীর উন্নয়ন করতে চেয়েছিলেন। এবার আবার মেয়র হয়েছেন। তিনি ইতোমধ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তারা আশা করছেন তাদের উন্নয়নে এবার কাজ করবেন লিটন।

এবিষয়ে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল হক বলেন, রাজশাহী নগরীর বস্তি ও হরিজন পল্লীর উন্নয়ন প্রকল্পে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে উন্নয়ন কাজের জন্য ওয়ার্ক অর্ডার দেয়া হয়েছে।

এদিকে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন এর আঞ্চলিক সমন্বয়কারী সুব্রত কুমার পাল বলছেন, জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-এসডিজিতে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে ২০৩০ সালের মধ্যেই ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও শিক্ষার অভাবের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে শুন্যের কোঠায় নামাতে হবে। তাই সমাজের এমন অবহেলিত অংশকে মূলস্রোতে ফেরানো জরুরি ।


শর্টলিংকঃ