ভালোবাসার চেয়ে পদ বড় নয়



রাজশাহী জেলা আওয়ামীলীগের সম্মেলনের কাউন্সিল অধিবেশনে বিকেলেই নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়ে গেছে। আমি চিন্তা করছিলাম বাইরে অপেক্ষমান তৃণমূলের সাধারণ নেতাকর্মীরা চলে যাক, তার পরই আমি বের হবো। ভাবছিলাম আওয়ামীলীগের মর্মাহত অগণিত ত্যাগী নেতাকর্মীর আবেগ সামলানো কষ্টকর। যারা দিনের পর দিন দলের জন্য শ্রম দিচ্ছেন, সময় দিচ্ছেন, যারা আওয়ামীলীগের জন্য নিজের জীবন দিতে এক মুহূর্তও ভাববেন না, এমন জীবনবাজি রাখা কর্মীদের ভাঙ্গা মন আমি সামলাব কেমন করে। এসব ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম কিছুক্ষণ শিল্পকলা একাডেমীর ভেতরেই অপেক্ষা করি।

আমি আর চারঘাটের সাবেক এমপি রায়হান ভাই হলরুমের ভেতরেই বসে থাকলাম। সেই সময়ই আবেগ দেখেছি রায়হান ভাইয়ের। কষ্টে তার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠছিল বারবার। তিনি বারবার বলছিলেন, তিলে তিলে গড়ে তোলা রাজশাহী জেলা আওয়ামীলীগের ভবিষ্যৎ কী? মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা ভালো থাকবে তো সামনের দিনগুলোতে ?

এভাবেই কেটে গেল বেশ কিছুক্ষণ। কাউন্সিলররা সবাই একে একে বের হওয়ার পর আমি আর রায়হান ভাই বের হলাম হল রুম থেকে। ভেবেছিলাম নেতা কর্মীরা চলে গেছে। মুহূর্তেই নিজের ভুল ভাঙল। আবেগি কয়েক হাজার নেতা কর্মী ঘিরে ধরলেন, অনেকেই জাপটে ধরলেন। হাউ মাউ করে কাঁদলেন। অবুঝ শিশুর মতো ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন ওরা। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না।

আমি না, কোন মানুষই নিজেকে সামলাতে পারার কথা নয় এমন সময়। ওদের কান্না আমার চোখেও পানি আনল। নিজেকে সামলে নিয়ে সান্তনা দিতে চাইলাম তাদের। বেশ বেগ পেতে হয়েছে সামলাতে। এখানেই শেষ নয়। আমি জেলা শিল্পকলা একাডেমী থেকে হাাঁটতে হাঁটতে রওনা হলাম লক্ষীপুরের দিকে। তৃণমূল নেতা কর্মীদের আস্থার জায়গা সেখানেই। দলীয় কার্যালয়। আমি যখন হাঁটতে হাঁটতে এগোচ্ছিলাম, তখন কর্মীদের উপস্থিতি আমাকে আপ্লুত করেছে। পেছন দিকে তাকিয়ে আমিতো নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছিলাম না। অগনিত নেতা কর্মী হাঁটছেন। যোগ দিলেন পবা মোনপুরের এমপি ছোট ভাই আয়েনও। ভারাক্রান্ত মনে আমার সাথে সাথে প্রায় দুই কিলোমিটার পথ হাঁটলেন সকলেই।

হাঁটতে হাঁটতে আসলাম লক্ষ্মীপুরে দলীয় কার্যালয়ের সামনে। সেখানে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিস্তম্ভের সামনেও হাজারো মানুষ অপেক্ষমান। শিল্পকলা একাডেমীর মতোই দৃশ্য এখানেও। এর থেকে বেশি পাওয়া আর কী হতে পারে? আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, আমি যদি সভাপতি কিংবা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হতাম, সেটাও এর থেকে বেশি পাওয়া হতো না। আপনাদের এই আবেগ ও ভালোবাসার থেকে বেশি কিছু হতেই পারে না। আমি ছোট বেলা থেকেই রাজনীতির সাথে জড়িত। ছাত্র জীবনে যে যাত্রা শুরু করেছি, তা আজও চালিয়ে যাচ্ছি। কর্মীদের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, আবেগের থেকে বেশি প্রাপ্তি আমাকে কোন কিছুতেই দেয়নি। দেয় না। আগামীতেও দেবে না।

কমিটি ঘোষণার পর থেকে অসংখ্য ভক্তের কান্না দেখেছি আমি। অগণিত নেতা কর্মীর মুষড়ে পড়া আপ্লুত করেছে আমাকে। এরা সবাই শুধু আমার ভক্ত, এমন কিন্তু নয়। এরা আমাদের সবার প্রিয় সংগঠন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে, দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে চলা আওয়ামীলীগের একনিষ্ঠ কর্মী, সমর্থক, ভক্ত। আমি জানি আপনাদের এই কষ্ট, আপনাদের প্রিয় সংগঠনকে ঘিরেই।

নতুন কমিটি ঘোষণার পর বহু মানুষ আমার সাথে দেখা করে কষ্ট প্রকাশ করেছেন, ফোন করে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের চিত্রতো আপনাদেরই জানা। ফেসবুকে দল মত নির্বিশেষে রাজনৈতিক সচেতন অসংখ্য মানুষ যে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন, এটি আমার দীর্ঘ ৩৭ বছরের রাজনীতিতে বড় অর্জন। ইতিমধ্যে সংবাদ মাধ্যমেও জেলা আওয়ামীলীগের কমিটি এবং আমাকে নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী লেখাও প্রকাশিত হয়েছে।

আবেগী, অভিমানী, ক্ষুব্ধ, সম্মানিত নেতা কর্মীদের উদ্দেশ্যে আমার অনুরোধ, আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারি। আমাদের নেতা দেশরত্ন শেখ হাসিনা। আমাদের সম্মেলনের স্লোগান ছিলো ‘দেশরত্ন শেখ হাসিনার উন্নয়ন দর্শনে, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে’। এই শ্লোগানকে ধারণ করেই এগিয়ে যেতে হবে।

আমাদের সম্মেলন ছিল বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার চেয়ে সুন্দর ও সুশৃঙ্খল। এই সুশৃঙ্খল সম্মেলন করা সম্ভব হয়েছে সম্মানিত সমন্বয়ক এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন ভাইসহ বিভিন্ন উপ কমিটি ও জেলা আওয়ামীলীগের সম্মানিত নেতৃবৃন্দের সার্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে। তবে, এতো শান্তিপূর্ণভাবে সম্মেলন সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে আমাদের বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছেন তৃণমুলের সাধারণ মুজিবপ্রেমী ভাই ও বোনেরা।

কারণ নতুন কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে আপনাদের প্রত্যাশার বাস্তবায়ন না হওয়ার পরও আপনারা আমার কথা রেখেছেন। কেউ এতোটুকু হই হট্টগোলও করেননি। এটিও আমার জন্য বড় পাওয়া। আমার প্রতি আপনাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ এটি। আমরা কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে কথা দিয়েছিলাম আপনারা যে কমিটি দিবেন তা আমরা মেনে নিবো। আসুন, জেলা আওয়ামীলীগের এই নতুন কমিটিকে আমরা সার্বিক সহযোগিতা করে আওয়ামীলীগকে এবং দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে সামনের দিকে এগিয়ে নিই।

একটি কথা মনে রাখতে হবে, আমরা যারা আওয়ামীলীগের পতাকাতলে সমবেত, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বই আমাদের মূল শক্তি। এখানে আমি আসাদ খুবই সামান্য। আমি আপনাদের মতোই একজন কর্মী। আমি বিগত তিন যুগের রাজনৈতিক জীবনে নিজেকে একজন সাধারণ কর্মীর কাতারেই রেখেছি। এই সময়ে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালনের সময়ও এর থেকে বেশি কিছু ভাবিনি। আপনাদের সহযোগিতার ক্ষেত্রে যখন যেখানে প্রয়োজন হয়েছে, ছুটে গেছি। আগামীতেও এভাবেই ছুটে যাবো, এতে কোন সন্দেহ নেই। আমি কখনই পদের জন্য রাজনীতি করি না, আমার রাজনীতি শুধুই আদর্শের।

সম্মানিত আবেগি এবং ক্ষুব্ধ বন্ধুরা, আপনাদের জানিয়ে রাখতে চাই, রাজনীতির নেতৃত্বে যে পঁচন, এই পঁচন ক্ষমতায় থাকার পরও আমাকে ছুঁতে পারেনি। ভবিষ্যতেও পারবে না। আমার জীবনের বড় চাওয়াই হলো, আপনাদের ভালোবাসা। এই ভালোবাসা নিয়েই বাকি জীবন চলতে চাই। আর আমার মৃত্যুর পর শেষযাত্রাতেও আপনাদের ভালোবাসা ও দোয়াকেই সম্বল হিসেবে নিয়ে যেতে চাই।

লেখক : মোহাঃ আসাদুজ্জামান আসাদ ,সাবেক সাধারণ সম্পাদক, রাজশাহী জেলা আওয়ামীলীগ


শর্টলিংকঃ