- ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ - https://universal24news.com -

তারেক-টুনির হার না মানা প্রেম


ভালোবাসা যত বড়, জীবন তত বড় নয়! প্রায় এক যুগ আগে এ গানটি চরম আঘাত ছবির জন্য সৃষ্টি করা হয়! ছবির গল্প ও দৃশ্যের সাথে সংগতির জন্য গানটির সৃষ্টি হলেও তা যে প্রেম ভালোবাসা নিয়ে রচিত ও লোকমুখে চর্চিত বহু গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ছবির পরিচালক তৈরী করেছিলেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই বললেই চলে! পরবর্তীতে এ গানটিই মানুষের মুখে মুখে থাকলো কখনো প্রেমিকার বা পছন্দের মানুষটির সুদৃষ্টি পাবার আশে, কখনো আবার সত্যিই কাউকে ভালোবেসে!

আজ হতে ঠিক বছর ১৩ আগে এক ভালোবাসা দিবসে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন টুনি ও তারেক! তবে ভালবেসে নয়, পারিবারিক ভাবেই সম্পন্ন হয় সে আয়োজন; প্রথম দেখাতেই একে অপরের খুব আপন হয় টুনি ও তারেক! দুজনের পারস্পরিক সৌহার্দপূর্ণ ভালোবাসায় সংসার হয়ে ওঠে সোনার সংসার। কিছু বছর পর তারেক টুনির সংসারে আগমন ঘটে সন্তান দিব্যর! দিব্য-টুনি-তারেক এ তিনে মিলে যেন স্বর্গ সুখে পূর্ন হয়ে ওঠে সে সংসার!

স্বর্গ সুখেই কাটছিলো দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর! কিন্তু সব কিছুরই শুরু আছে, শেষও হয়ে যায়! এই অমোঘ সত্যিটি যেন টুনির সংসারে ঠাঁই করে নেওয়ার চেষ্টা করতে চাইলো! হঠাৎই বড় একটা ধাক্কা খেলো টুনি তারেক এর সোনার সংসার! প্রাণঘাতী জটিল কিডনি রোগ টুনির কাছ থেকে তারেককে কেড়ে নেওয়ার জন্য টুনির সোনার সংসারে নিরবে কখোন যে বাসা বেঁধেছে তা কেউ ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি! সে ভায়াবহ রোগ যেন টুনির কাছ থেকে তারেক কে নিয়েই ছাড়বে! বিস্ময় ও ব্যাথায় কাতর টুনি যেন দিশেহারা! যেন হঠাৎ আসা ঝড়ে দিকভ্রান্ত কোন এক নাবিক! যে নাবিকের সামনে কেবলই বিপুল নীল জলোরাশি! যেই জলোরাশির প্রতিটি ঢেউ যেন আছড়ে পরে, ভয়ংকর মৃত্যুর বারতা নিয়ে!

কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের সময় হাসপাতালে তারেক ও টুনি

টুনির এত বছরের সোনার সংসার, এত আদরের সকল কিছু, সব কি তবে সে নীল ঢেউয়ের ভয়াবহতায় বিলীন হয়ে যাবে? কোন রকম প্রতিরোধ এর দেওয়াল কি টুনি সত্যিই তুলতে পারবেনা?

টুনি আধুনিক যুগের মেয়ে, যেই যুগে প্রতি ঘন্টায় একটি করে ডিভোর্সের মামলার ঘটনা ঘটে, খোদ তাঁর শহরে! এমন একটি যুগে, এমন একটি শহরে থেকে টুনির পক্ষে আসলে কতটুকু প্রতিরোধ গড়া সম্ভব? এমন শতসহস্র প্রশ্ন যখন সবার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে, ঠিক তখনই টুনি বের হয়ে এসেছে “ভালোবাসা যত বড়, জীবন তত বড় নয়” এই মহামন্ত্রটি বুকে ধারন করে! যে মহামন্ত্রের বীজ টুনি আর তারেক ১৩ টি বছর ধরে একে অপরের হৃদয়ে বুনেছিলো!

আধুনিকতার ছোঁয়ায় মোড়ানো যান্ত্রিক এই শহরে, টুনি যেন আবহমান বাংলার গৃহবধূর প্রকৃত রুপটিই ফুটিয়ে তুলতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ! মানবতা আর ভালোবাসার মহামন্ত্রে দীক্ষিত টুনি স্বামীর এই সংকটময় মুহূর্তে একজন দক্ষ নাবিকের মত শক্ত হাতে হাল ধরেছে! নিজের জীবনের চেয়ে প্রিয় করে তুলেছে প্রাণপ্রিয় অর্ধাঙ্গকে!

প্রাণপ্রিয় মানুষটিকে বাঁচাতে একটি কিডনির প্রয়োজন। চাইলেই দিতে পারবেনা যে কেউ! মেডিকেল সায়েন্সের অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরীক্ষায় পাশ করতে পারলেই কেবল সম্ভব হবে কিডনি দানের মত ভয়াবহ ঝুঁকির এই কাজ!

এত এত সব মৃত্যু ঝুঁকিকে পাশ কাটিয়ে টুনিই কিডনিটি দিবে ! কিন্তু প্রশ্ন, তারেক এর শরীরের সকল কিছুর সাথে কি টুনির সব কিছু ম্যাচ করবে? এসব প্রশ্নের ইতি ঘটে, তারেক কে কিডনি দেবার সামর্থ্য টুনির রয়েছে, এ অবিশ্বাস্য সত্যটি জানার পর!

দুটি পৃথক সত্তা আর দেহ নিয়ে জন্ম নেওয়া দুটি মানুষ এর সবকিছু একই রকম হয়ে যাওয়াটা তাই হয়তো-বা কেবল বিধাতার অশেষ রহমত ও একে অপরের নিগূঢ় ভালোবাসার কল্যানেই সম্ভব হয়েছে! টুনি জানতো, এই ভয়াবহ ঝুঁকি নিতে গিয়ে তাঁর মৃত্যু হতে পারে! আর সে যে অর্ধেক হয়ে যাবে, এটা তো নিশ্চিৎ-ই ছিলো! তবুও টুনির কাছে এসব যেন কিছুই মনে হয়নি! হয়তো তার বিশ্বাস ছিলো বিয়ের পর অর্ধাঙ্গ ও অর্ধাঙ্গিনী মিলিয়েই একটি জীবন, একটি সংসার।

সব ভয় সব ভীতি জয় করে টুনি চলে যায় ডক্টরের ছুড়ি কাঁচির নিচে! নিজে কে অর্ধেক করে মৃত্যুর কাছ থাকে ফিরিয়ে আনেন নিজের ভালোবাসার প্রিয় মানুষটিকে!

একটা মানুষ কে কতটুকু ভালোবাসলে এমন মৃত্যু ঝুঁকি নেওযা যায়? একটা মানুষকে কতটা ভালোবাসলে নিজ শরীর টাকে অর্ধেক করে দেওয়া যায়? একটা মানুষকে কতটা ভালোবাসলে? এসব প্রশ্নের উত্তর না হয় টুনি ও মহাকালের হাতে তোলা থাক! সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে না হয়, বড় বড় লেখকরা তাঁদের গল্পের হাজার উপকরণ খুঁজে পাক! সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে না হয়, সমাজের ঘুনে ধরা বহু দাম্পত্য জীবন আবারও আলোয় আলোয় ভরে উঠুক!

একমাত্র সন্তানের সঙ্গে তারেক-টুনি দম্পতি

আধুনিক বিশ্ব সমাজ-সংসারে টুনির বিরল দৃষ্টান্ত যেন প্রকৃত ভালোবাসার-ই এক অনন্য প্রতিচ্ছবি! বর্তমানের এ আধুনিক সমাজ সংসারে টুনির এই মহান আত্মত্যাগ যেন প্রতিটি দাম্পত্য জীবন থেকে জীবনে, হৃদয় থেকে হৃদয়ে এক অকৃত্রিম এবং বিশ্বস্ত ভালবাসার বীজ বুনে যাওয়ার অনুপ্রেরণা। যেই ভালোবাসা এবং আত্মত্যাগ নিয়ে পৃথিবীতে রচিত হয় গান গল্প আর কবিতা! যেই ভালোবাসা এবং আত্মত্যাগ গুলো কে শ্রদ্ধা জানাতেই হয়তো পৃথিবীর প্রতিটি কোনে, প্রতিটি বছর পালিত হয় বিশ্ব ভালোবাসা দিবস।
তবে কোন বিশেষ দিনে নয়, সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা, সামাজে অকৃত্রিম ভালবাসার জয়গান শুনিয়ে যাওয়া, দাম্পত্য জীবনের সংজ্ঞা নতুন করে মনে করিয়ে দেওয়া এই টুনিদের জন্য ভালবাসা, প্রতিটি দিনে, প্রতিটি ক্ষণে, বুকের বাঁপাশের গভীরে থাকা এক টুকরো মাংশপিন্ডের ঠিক মাঝখান থেকে, যাকে নাকি হৃদয় বলে।

(একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

লেখক : একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সিনিয়র নিউজ প্রেজেন্টার