মহামারিতেও এই দ্বীপরাষ্ট্রে কেন দূতাবাস খুললো চীন


ইউএনভি ডেস্ক:

মহামারিতে গোটা বিশ্ব যখন মুখ থুবড়ে পড়ছে, ঠিক সেই সময় মে মাসের রৌদ্রজ্জ্বল এক দিনে বেইজিং থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে অবস্থিত ছোট্ট এক দ্বীপরাষ্ট্রে লাল পতাকা উড়িয়ে দূতাবাস খুলে বসলো চীন। কিন্তু এমন সংকটকালে দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের কারণ কি?

প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যখানে অবস্থিত কিরিবাতি দ্বীপের জনসংখ্যা মাত্র ১ লাখ ১৬ হাজার। মাত্র তিনটি দেশের দূতাবাস আছে দ্বীপটিতে- অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড আর কিউবা। এবার এখানে চীনের দূতাবাসও স্থাপিত হলো। ছোট্ট দ্বীপটি কি তাহলে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার নতুন কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে চলেছে?

গত সেপ্টেম্বরে ত্ইাওয়ানের রাজধানী তাইপে থেকে বেইজিংয়ে নিজেদের কূটনৈতিক অফিস সরিয়ে নেয় কিরিবাতি। স্বায়ত্তশাসিত তাইওয়ানকে নিজেদের একটি বিচ্ছিন্ন প্রদেশ হিসেবে বিবেচনা করে চীন। সম্প্রতি কিরিবাতির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাইওয়ানপন্থী প্রার্থীকে হারিয়ে জয়ী হয়েছেন বেইজিংপন্থী তেনেতি মামাউ।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন বলছে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়ার সাম্প্রতিক নিদর্শন হলো এই কিরিবাতি দ্বীপ। প্রশান্ত মহাসাগরের এসব প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ দ্বীপগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। এশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ জলপথগুলো নিয়ন্ত্রণ করে তারা।

এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেই ছবির মতো সুন্দর দ্বীপগুলোর কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ, বড় রকমের মার্কিন সামরিক উপস্থিতিও ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র অস্ট্রেলিয়া এই অঞ্চলে সর্ববৃহৎ দাতা দেশ। কিন্তু সম্প্রতি চীনের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক ক্ষমতার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে, ফলে অধিকাংশ দ্বীপ রাষ্ট্রই চীনের দিকে ঝুঁকেছে।

২০০৬ সালে তৎকালীন চীনা প্রধানমন্ত্রী বেইজিংয়ের শীর্ষস্থানীয় কোনো নেতা হিসেবে প্রথমবারের মতো কিরিবাতি সফর করেন। তার ওই সফরে কিরিবাতির উন্নয়ন, কৃষি, মৎস ছাড়াও অন্যান্য প্রধান শিল্পখাতগুলোতে ৩০০ কোটি ইউয়ান রেয়াতি ঋণের কথা বলা হয়। আর আজ অস্ট্রেলিয়ার পর দেশটিতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দাতা চীন।

তবে ওই অঞ্চলে চীন তার প্রভাব যে বাড়াতে চাইছে এর অন্যতম একটি বড় কারণ হলো অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের চরম অবনতি। করোনার উৎপত্তিস্থল নিয়ে তদন্তের কথা বলে চীনের সঙ্গে বিরোধ জড়িয়ে পড়ে অস্ট্রেলিয়া। শুরু হয়েছে বাণিজ্যিক দ্বন্দ্ব। তাদের সেই দ্বন্দ্ব এখন প্রকাশ্য হয়ে পড়েছে।

মার্চে কোভিড -১৯ মোকাবিলয়া সহায়তা করার জন্য এসব দেশকে নগদ ও চিকিৎসা সরবরাহের জন্য প্রায় দুই মিলিয়ন ডলার অনুদানের ঘোষণা দেয় চীন। অঞ্চলটিতে অবস্থিত চীনা দূতাবাসগুলোর বিবৃতি অনুযায়ী, এসব দেশে বিনামূলে চিকিৎসা সরঞ্জাম, প্রতিরক্ষামূলক গিয়ার এবং পরীক্ষার কিটও পাঠায় বেইজিং।

এছাড়া মে মাসের মাঝামাঝি কোভিড-১৯ নিয়ে বেকায়দায় পড়েছিল চীন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বৈঠকের কয়েকদিন আগে চীনের নেতৃত্বে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১০ দ্বীপরাষ্ট্রের মন্ত্রীরা এক ভিডিও কনফারেন্সে অংশ নেয়। এসব অঞ্চলে কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে চীনের সহযোগিতার উজ্জ্বল প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে শেষ হয় বৈঠক।

বৈঠকের পর অংশগ্রহণ দ্বীপগুলোর পক্ষ থেকে একটি যৌথ প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। তাতে চীন সম্পর্কে লেখা ছিল- ‘করোনা পরিস্থিতিতে দেশটি সময়োপযোগী ও শক্তিশালী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আর এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণ উন্মুক্ত, স্বচ্ছ এবং দায়িত্বশীলতার সঙ্গে অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিয়েছে বিশ্ববাসীর সঙ্গে।’

ক্যানবেরায় অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ডেংহুয়া ঝ্যাং বলেন, ‘ব্যস, এটাই দরকার ছিল চীনের। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের এই সুযোগসন্ধানী পদক্ষেপ নেওয়ার কারণ- যত বেশি প্রভাব খাটাতে পারবে, তত শক্তিশালী অবস্থানে থেকে বিশ্ব দরবারে কথা বলতে পারবে তারা।’

লোভি ইনস্টিটিউটের প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্রোগ্রামের পরিচালক জোনাথন প্রাইক বলেছেন, ‌‘আজ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের এহেন কার্যক্রম সুবিধাবাদী দৃষ্টির দ্বারা পরিচালিত হয়েছে, তারা যতটা সম্ভব প্রভাব ফেলতে চেষ্টা করছে এই অঞ্চলে। এর মাধ্যমে ওই অঞ্চলের নিজেদের উপস্থিতি আরও পোক্ত করছে বেইজিং।’

তবে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এমন অভিযোগ অস্বীকার করে বলছে যে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দ্বীপরাষ্ট্রগুলো চীনের এই সহায়তা ‘অকৃত্রিম’ এবং এর পেছনে ‘কোনও রাজনৈতিক সংযুক্তি’ নেই। তবে প্রয়োজনের সময় আরও শক্তিশালী বন্ধন যে কতটা কার্যকর হতে পারে তা সময়ই বলে দেয়।


শর্টলিংকঃ