মহামারী পরবর্তী মহামন্দা: কী করবে বাংলাদেশ


করোনা তথা কোভিড-১৯ নামের এক অতিক্ষুদ্র জীবাণু পুরো দুনিয়ার আর্থ-সামাজিক গতিপ্রকৃতিকে বদলে দিচ্ছে। দুনিয়াজুড়ে লাখে লাখে মানুষ আক্রান্ত আর হাজারে হাজার মৃত। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ লকডাউনে। রুদ্ধ সকল আন্তর্জাতিক যোগাযোগ। মানুষ চলাচল থেকে পণ্য পরিবহন- স্থবির গোটা বিশ্ব। এ সর্বনাশা অবস্থার দুটো পর্যায়। প্রথম পর্যায় চলমান মহামারী। আর এর পরেই সামনে আসবে দ্বিতীয় পর্যায় মহামন্দা। অর্থনৈতিক মহামন্দা। এর সূচনা ইতোমধ্যেই হয়ে গেছে। সামনে তার ভয়াবহতা প্রকাশ পাবে। পুঁজির দুনিয়ায় পুঁজিবাজার বন্ধ, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বন্ধ। প্রবাসী শ্রমিকদের কাজ নেই, দলে দলে ফেরত যাচ্ছে নিজেদের অনুন্নত দেশে। কারখানা শাটডাউন, পরিষ্কার বেকারত্বের ইঙ্গিত।

কাজ হারাবে লাখে লাখে মানুষ। আক্রান্ত দেশগুলোতে সামাজিক নিরাপত্তা খাত শক্তিশালী করতে না পারলে দরিদ্র মানুষের মাঝে খাদ্যাভাব-পুষ্টির অভাব দেখা দেবে। দেশে দেশে জিডিপি কমে আসবে, রিজার্ভ মুদ্রা কমে আসবে। তারল্য সঙ্কট, ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ধ্বস নামবে। বীমা সুরক্ষার আওতায় না থাকা সিংহভাগ নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পড়বে বিপাকে। অর্থনৈতিক এই সঙ্কটের প্রভাব পড়বে সামাজিক স্থিতিশীলতায়। বিদ্যমান সমাজকাঠামো ভেঙ্গে পড়বে। মানুষে মানুষে হানাহানি, সন্দেহ-অবিশ্বাবাস বাড়বে। সামাজিক বন্ধন ক্ষতিগ্রস্ত হবে চরম মাত্রায়। এসবের ইঙ্গিত এখন থেকেই দেখা যাচ্ছে, অন্তত আমাদের দেশে।

এই ভয়াবহ মহামন্দা থেকে বাংলাদেশও মুক্ত থাকতে পারবে না। গেলো দশকের মহামন্দার আঁচ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে খুব একটা লাগেনি। কিন্তু এবারের ‘লকডাউন সিচুয়েশন’ বাংলাদেশের নির্মীয়মান অর্থনীতিকে কতোখানি বাঁচাবে তা সন্দেহের উর্ধে নয়। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের উপর এই পরিস্থিতির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আড়াইশো কোটি ডলারের তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ এরই মধ্যে বাতিল (২৫ মার্চ পর্যন্ত নিট ২৫৮ কোটি ডলার)। ওই সময় পর্যন্তক্রয়াদেশ বাতিল হওয়া কারখানার সংখ্যা ৯৩৬টি। আর এগুলোতে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা ১৯ লক্ষ ২০ হাজার। আমাদের তৈরি পোশাকের প্রধান বাজার ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্র।

পুরো ইউরোপ-আমেরিকা শাটডাউনের পথে। সামনের দিনগুলোতে কী দাঁড়াবে, অনুমান করাই যাচ্ছে। সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের বর্তমান অগ্রগামিতার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ তৈরি পোশাক শিল্প। সেখানেই শুরুর ধাক্কা। রপ্তানিমুখী অন্যান্য শিল্পেও ধাক্কা লেগেছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে রপ্তানিমুখী শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারিদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। কিন্তু এই টাকা কার ঘরে যাবে, তা নিয়ে সন্দেহমুক্ত থাকা যাচ্ছে না। কারণ রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির এই দেশে যথাযথ শ্রমিক-কর্মচারিরা এই প্রণোদনার অর্থ পাবেন কিনা কে তার নিশ্চয়তা দেবে? আর প্রণোদনার অর্থ যেহেতু সরকারি কোষাগার থেকে মালিকদের মাধ্যমে যাবে, তাই মাঝপথে লুটপাটের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্কটে সুবিধা নেওয়ার প্রবণতা এতো বেশি যে মানুষ আর কোনোভাবেই তাদের বিশ্বাস করে না। এদেশে এখনও জাতীয় পুঁজির বিকাশ যথাযথভাবে ঘটেনি, ফলে ব্যবসায়ী বলি বা উৎপাদক শ্রেণি বলি, তাদের মাঝে ফাটকাবাজি চরিত্রই এখনো প্রধান।

বাংলাদেশের অর্থনীতির আরেকটি শক্তিশালী ভিত্তি হলো প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। সেখানেও নিয়মিত করবঞ্চিত থেকে যায় রাষ্ট্র। ব্যাংকিং ব্যবস্থার বদলে নানা প্রকার অবৈধ পথে দেশে টাকা আসে। আর চলমান করোনা পরিস্থিতিতে যে হারে প্রবাস থেকে বাংলাদেশি শ্রমিকরা ফিরে এলেন, তাতে এখনই বড় ধরনের অশনীসংকেত দেখা যাচ্ছে। রেমিট্যান্স কমতে শুরু করেছে ফেব্রুয়ারি থেকেই। সামনের দিনগুলোতে প্রবাসী শ্রমিকরা হারানো কাজ ফিরে পাবেন কিনা তাও সংশয়মুক্ত নয়। আবার দেশে ফেরা শ্রমিকরা আগের কর্মস্থলে ফিরতে পারবেন কি পারবেন না তা নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে। কারণ বাংলাদেশের প্রধান রেমিট্যান্স বাজার সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, কুয়েত, যুক্তরাজ্য, ওমান, মালয়েশিয়া, কাতার, ইতালি, বাহরাইন, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, জাপান ও জার্মানির প্রত্যেকেই করোনা আক্রান্ত। ওইসব উন্নত দেশগুলোও তাদের স্ব স্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। ফলে তারাও ঘুরে দাঁড়াতে কতোখানি ঘাম ঝরাবে, বলা মুশকিল এখনই। ফলে সামনের দিনগুলোতে নিশ্চিতভাবেই রেমিট্যান্স প্রবাহ ব্যাপক আকারে কমে যাবে।

দেশের অভ্যন্তরীণ অবকাঠামোগত উন্নয়নেও তীব্র ধীরগতি সৃষ্টি হবে। পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, এক্সপ্রেসওয়ে, গভীর সমুদ্রবন্দর, পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র-সহ যে সব বড় উন্নয়ন প্রকল্প দেশের অভ্যন্তরে চলমান, তাতে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে কর্মরতদের সিংহভাগই বিদেশি। এদের বেশিরভাগই নিজ নিজ দেশে ইতোমধ্যেই ফিরে গেছেন। চলমান করোনা পরিস্থিতির পুরো নির্মূলের আগে তাদের কাজে ফেরার সম্ভাবনা খুব একটা নেই। দ্বিতীয়ত এসব মেগা প্রকল্পে বিদেশি উৎস (পদ্মা সেতু বাদে) এবং অভ্যন্তরীণ কোষাগারের অর্থপ্রবাহেও নিশ্চিতভাবেই টান পড়বে। ফলে এসব প্রকল্প স্থির হয়ে পড়লে নির্ভরশীল অপরাপর অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞও স্থির হবে। এরও প্রভাব পড়বে সামগ্রিক অর্থনীতিতে।

এসবের সামগ্রিক প্রভাব পড়বে ব্যাংকিং খাতেও। এমনিতেই ব্যাংকিং ব্যবস্থা বিগত সময়ে বেশ খানিকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যাপক লুটপাট আর দুর্নীতির কারণে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে অনিয়ন্ত্রিত ঋণ উত্তোলন, বিপুল পরিমাণ খেলাপী ঋণের পাহাড়, হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে অবৈধভাবে পাচার এমনকি ব্যাংকের উদ্যোক্তারা নিজেরাই লুটেরার ভূমিকা গ্রহণের মতো বাজে নজির সৃষ্টি হয়েছে এদেশে। তার উপর খেলাপী ঋণ পরিশোধে বারবার দুর্বৃত্তদের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এর উপর এখন সৃষ্টি হলো করোনা সঙ্কট। এ সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, উৎপাদন ও রপ্তানিতে যে ঘাটতি সৃষ্টি হবে, তাতে ব্যাংকের খেলাপী ঋণ আরো বাড়বে। তার উপর সরকারের নানা ব্যয় মেটাতে অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ দিনে দিনে বাড়ছে। ফলে গ্রাহক পর্যায়ে ঋণ বিতরণের হার কমেছে আগেই।

রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যাংক অনুমোদন দিয়ে পরিস্থিতি এমন করে তোলা হয়েছে যে হিসাব খোলানোর জন্য ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের প্রতিনিয়ত চাপের মুখে রাখছেন উর্ধ্বতনরা। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে তারল্য সঙ্কট তো এমনিতেই চলছে, তার উপর করোনার প্রভাবে সৃষ্ট নয়া অর্থনৈতিক সঙ্কটে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যেই ঋণ তফশিলীকরণ-সহ অন্যান্য কাজে নানা ধরনের প্রণোদনা ঘোষণা দিয়েছে। এই সঙ্কটে বাংলাদেশের একাধিক রুগ্ন ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

ইতোমধ্যেই পরিস্থিতির ভয়াবহতা স্বীকার করে নিয়ে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছে সাহায্য চেয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ওই দুই সংস্থার গঠিত আপৎকালীন সহযোগিতা তহবিল থেকে সাহায্য চেয়ে তাদের প্রতিনিধিদের সাথে ২৫ মার্চ ভিডিও কনফারেন্সে অর্থমন্ত্রী আশঙ্কা জানিয়েছেন, করোনা সঙ্কটে সামগ্রিকভাগে ১ শতাংশের বেশি জিডিপি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। চলতি অর্থবছরের কাক্সিক্ষত ৮.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন হওয়া রীতিমতো দুষ্কর। তৈরি পোশাক, রেমিট্যান্স, অর্থনৈতিক অবকাঠামো এ তিন খাতেই ধ্বসের আশঙ্কা জানিয়েছেন তিনি।

কিন্তু যে কথাটা কেউ বলছেন না, সেটা হলো কর্মসংস্থান ধরে রাখার মারাত্মক চ্যালেঞ্জ। তাবৎ দুনিয়ার মতো বাংলাদেশও এবারের বৈশি^ক সঙ্কটে এই চ্যালেঞ্জে ইতোমধ্যে পড়ে গেছে। শিল্প কারখানা বন্ধ হলে, বেসরকারি অফিসগুলো বন্ধ হলে কর্মসংস্থান ধরে রাখা খুব কঠিন হয়ে পড়বে। সরকারি কর্মচারিদের খুব একটা ক্ষতি হবে না, কারণ সরকার তাদের বেতন-ভাতা সবই দেবে। কিন্তু বেসরকারি খাতের শ্রমিক-কর্মচারি-কর্মজীবীরা পড়বেন নিদারুণ সঙ্কটে। আগে থেকেই চলে আসা সঙ্কটে এভিয়েশন খাতের রিজেন্ট এয়ারলাইন্স তার সব শ্রমিক-কর্মচারিকে তিন মাসের বিনা বেতন ছুটির নোটিশ হাতে ধরিয়ে দিয়ে সেবা বন্ধ করেছে। চূড়ান্তভাবে এরা বেকারই হতে চলেছেন। এই সঙ্কটের মধ্যেও বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন এসএ টিভি তাদের বেশ কিছু সংবাদকর্মিকে ছাঁটাই করেছে। আর করোনা সঙ্কটের কারণে যে আরো বহু প্রতিষ্ঠান ছাঁটাইয়ের পথে হাঁটবে এটা নিশ্চিত।

রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক-কর্মচারিদের জন্য তাও তো পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন সরকারপ্রধান, কিন্তু অন্যান্য খাতের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো প্রণোদনার ঘোষণা নেই। মালিকরা হয়তো আর্থিক ক্ষতি সত্বেও কোনোভাবে বেঁচেবর্তে যাবেন, কিন্তু শ্রমিক-কর্মচারিদের জন্য নিদান কী হবে?ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারাও বাজার হারিয়ে ব্যবসা হারাবেন। হাঁটবেন বেকারত্বের পথে। এদের সংখ্যাও বিশাল। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য সরকারের কোনো প্রণোদনা ঘোষণা নেই এখনও।

এই মহাসঙ্কট-সমুদ্র পাড়ি দেবার জন্য বাংলাদেশের সামনে পথ কী? এলোপাথারি পুঁজির বিকাশে মদদ দিতে গিয়ে কল্যাণ অর্থনীতির ধারেকাছ দিয়েও হাঁটিনি আমরা। উন্নয়ন হয়েছে এই সরকারের আমলে চোখ ধাঁধানো, কোনো সন্দেহ নেই। দেশের অবকাঠামোগত চিত্র আমূল পাল্টে গেছে। সামগ্রিক অর্থনীতিতে বিষ্ময়কর উত্থান। ব্যাংক রিজার্ভ অবাক করার মতো। প্রবৃদ্ধি এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে সর্বোচ্চ, আটের বেশি। আগের তিন অর্থবছরে টানা সাতের ওপর। মাথাপিছু গড় আয় ১ হাজার ৯০৯ ডলার। মানে দুই হাজার ডলার ছুঁইছুঁই।

অর্থাৎ মাসিক আয় গড়ে ১৫ হাজারের কাছাকাছি। নিজেদের অর্থে পদ্মাসেতু। অনেকগুলো মেগা প্রকল্প চলমান। পঞ্চাশ বছরে কৃষি জমি হ্রাস ও জনসংখ্যা দ্বিগুণ হওয়া সত্বেওখাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। চলতি অর্থবছরের বাজেট সোয়া পাঁচ লক্ষ কোটি টাকা। দশ বছর আগেও এসব চিন্তাও করা যেতো না। কিন্তু এই উন্নয়নের সুফল, প্রবৃদ্ধির সুফল থেকে এখনও পর্যন্ত সিংহভাগ মানুষ নিদারুণ বঞ্চিত। আয়বৈষম্য, সম্পদের বণ্টনের ক্ষেত্রে বৈষম্য এদেশে প্রবল। ফলে অল্প সংখ্যক মানুষের হাতে সম্পদের পাহাড়, সিংহভাগ বঞ্চিত। তার উপর সীমাহীন দুর্নীতি। এই অবস্থা এই সঙ্কটের কালে আরো বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

এই অবস্থায় করণীয় কী বাংলাদেশের জন্য? সবার আগে যা করা দরকার তা হলো সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী আরো শক্তিশালী করা। প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে রপ্তানিমুখী শিল্পখাতের শ্রমিক-কর্মচারিদের বেতন-ভাতা প্রদানের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু কঠোরভাবে লক্ষ রাখতে হবে, এই তহবিল যেন পর্দাকাণ্ড বা বালিশকাণ্ডের মতো লুট না হয়। অন্যান্য বেসরকারি খাতের কর্মজীবীদের জন্যও অনুরূপ আশার আলো দেখাতে হবে।

ঘরহীন মানুষকে ঘরে ফেরানোর কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। ভালো উদ্যোগ। ভাষাণচরে গৃহায়ন প্রকল্প প্রস্তুত। অন্যান্য এলাকাতেও এ ধরনের কর্মসূচি নিশ্চয়ই সরকারের তরফ থেকে নেওয়া হবে। তবে এই মুহূর্তে লকডাউন বা সাধারণ ছুটির কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত যে দিন এনে দিন খাওয়া মানুষেরা, তাদের জন্য সর্বাগ্রে খাদ্য নিরাপত্তার বিহিত করতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী শক্তিশালী করেই ফাটকাবাজির অর্থনীতির কবল থেকে গরিব মানুষকে বাঁচাতে হবে। মনে রাখতে হবে, এই মানুষেরাই আমাদের সিংহভাগ। এদের সুরক্ষা নিশ্চিত না হলে বাংলাদেশ মুখ থুবড়ে পড়বে।

বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি সব খাতে ২৬ এপ্রিল থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা দেওয়া হলেও এখনও পর্যন্ত তৈরি পোশাক শিল্প বন্ধ করা হবে কি হবে না সে সিদ্ধান্ত সরকার নিতে পারেনি। এতো প্রভাবশালী টাকাওয়ালা ব্যবসায়ীদের ঘাটাতে সরকার কি তবে সাহস হারাচ্ছে? তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের বণিক সমিতি বিজিএমইএ তাদের সদস্যদের উদ্দেশ্যে একটা সাধারণ আহ্বান কেবল জানিয়েছে। সেখানেও কারখানা বন্ধ করার সুস্পষ্ট কোনো ঘোষণা নেই। কেবল যাদের ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে, তাদের কারখানা বন্ধ করতে জোর দেওয়া হয়েছে। এই যে কার লকডাউন হবে, আর কার হবে না, কে পেটের টানে লকডাউনে যেতে পারবে না, সাধারণ মানুষের মধ্যে এই বিভাজন তৈরি হওয়া বা কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে এই বিভাজন তৈরি করে দেওয়া হলে পরিণতি যে কতো মারাত্মক হতে পারে, ইতালি তার দারুণ উদাহরণ।

ফেব্রুয়ারিতে ইতালিতে যখন করোনা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো তখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওয়ার্ক ফ্রম হোম করে শ্রমজীবীদের একটা অংশকে বাড়িতে পাঠানো হলেও মোটরগাড়ি, ইলেকট্রনিক্স ও ইলেকট্রিক যন্ত্রাংশ, জামাকাপড় তৈরির কারখানা সহ নানা শিল্প প্রতিষ্ঠান খোলা রাখা হয়েছিলো। এর পরে মহামারী যখন বাড়তে থাকলো তখনও শ্রমিকদের একটা অংশকে ছুটি না দিয়ে মালিকরা শিল্প কারখানায় উৎপাদন প্রক্রিয়া চালু রেখেছিলো। মালিকদের স্বার্থে সরকারও এটা মেনে নিয়েছিলো। ইতালি আজ এর ফলও ভুগছে। আসলে নয়া উদারবাদী ফাটকাবাজির অর্থনীতির অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গির বিষময় ফল এটি। বাংলাদেশও যেন ইতালির অনুরূপ ফল ভোগ না করে, আমাদের সরকারকে সে ব্যবস্থা দ্রুতই নিতে হবে। পুরো লকডাউন করে নিচের তলার মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

সবচেয়ে বড় কথা, অর্থনীতির ফাটকাবাজি বন্ধ করতে হবে। সর্বগ্রাসী দুর্নীতি রুখতে হবে। দুর্নীতি যদি অন্তত অর্ধেকও কমিয়ে আনা যেতো, ইতোমধ্যেই আমাদের প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্ক ছুঁতো। সেক্ষেত্রে আমাদের এই লকডাউনে এতো ক্ষতি হতো না। দুর্নীতি আর দুর্বৃত্তায়ন রুখতে প্রধানমন্ত্রীকেই বড় ভূমিকা নিতে হবে। তাকে কঠোর অবস্থানে যেতে হবে। তবে পপুলিশ সরকারের দ্বারা খুব বেশি কঠিন ভূমিকা নেওয়াটাই কঠিন। তারপরও নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, করোনা আক্রান্ত ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, চীন, জাপান, কোরিয়ার রাজনৈতিক বাস্তবতা আর আমাদের দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা এক নয়। করোনা সঙ্কট বৈশ্বিক, আক্রান্ত সবাই, মানুষ মরছে সবখানে, উন্নতির শিখরে থাকা ইউরোপেই তো বেশি।

মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে সব দেশ। কিন্তু সেসব দেশে এই সঙ্কটের মধ্যে সরকার পতনের স্বপ্ন কেউ দেখছে না। আমাদের দেশে করোনা সঙ্কটকেও পুঁজি করে কারো কারো মধ্যে ক্ষমতার হাতবদলের স্বপ্ন জাগ্রত হচ্ছে। এর আগেও সরকারি চাকরিতে কোটা সংরক্ষণ বাতিলের আন্দোলন কিংবা নিরাপদ সড়কের দাবিতে কিশোর আন্দোলনের জলকেও ঘোলা করে সরকার পতনের স্বপ্ন দেখেছিলো একটি গোষ্ঠী। তারা তো এখনও থেমে নেই। আর ভূ-রাজনৈতিক নানা জটিল হিসাবনিকাশও তো বহাল আছে। ফলে কোনোভাবেই সরকারপ্রধান পপুলারিজম ধরে রাখতে গিয়ে কোমল মনোভাব প্রদর্শন করলে তার সুযোগ নেওয়ার জন্য একদল ওঁৎ পেতে বসেই থাকে। তাই ফাটকাবাজি আর দুর্বৃত্তায়ন থেকে অর্থনীতিকে মুক্ত করতে প্রধানমন্ত্রীকেই ভূমিকা নিতে হবে।

তবে এগুলো সব সাময়িক ব্যবস্থা। দীর্ঘমেয়াদে উন্নয়নের এক নতুন রাস্তায় হাঁটতেই হবে বাংলাদেশকে। সেটা হলো কল্যাণ অর্থনীতির পথ। আজ সারাবিশ্বে পুঁজির পাগলা ঘোড়া যেভাবে ছুটছে, কল্যাণকামী রাষ্ট্রের ধারণাকে ভুলিয়ে দেওয়ার যে পথ বেছে নেওয়া হচ্ছে, তার পরিণতি খুব খারাপ হবে। সমাজতন্ত্রের কথা ছেড়েই দিলাম, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সিক্ষত বাংলাদেশ অন্তত কল্যাণ রাষ্ট্রের স্বপ্ন ধারণ করার দাবি করতেই পারে। বঙ্গবন্ধুর বাকশালের কথাও যদি ধরা হয়, সেটাও কিন্তু সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার আদলে বাংলাদেশের নিজস্ব বাস্তবতায় একটা পরিপূর্ণ কল্যাণ অর্থনীতির পথেই হাঁটতে চেয়েছিলো। উন্নত রাষ্ট্রগুলোর উদার পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের আদলে ফাটকাবাজির অর্থনৈতিক পরিকাঠামো গড়ে তুলতে গেলে নিচের তলার মানুষেরা কী হারে বিপদগ্রস্ত হয় আর নিচের তলার সিংহভাগ মানুষকে বিপদগ্রস্ত করে তুলে উন্নয়নের চেষ্টা কতোখানি অবান্তর, তা তো আজ এই এক ছোট্ট ভাইরাসই আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে।

মাথাপিছু প্রায় ১৫ হাজার টাকা মাসিক আয়ের দেশে ১৫ দিনের লকডাউনে নিচের তলার কোটি কোটি মানুষের খাবারের চিন্তা করতে হচ্ছে আমাদের। স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা, শিক্ষার ভিত্তি কতোখানি নড়বড়ে তা একেবারে নগ্ন কঙ্কালের মতো বেরিয়ে আসছে। উদার পুঁজিবাদী মুক্তবাজার অর্থনীতির অনুকরণে বাজারের ভাগ্য ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দেওয়ারও ফল ভোগ করছি আমরা। মানবিক বিপর্যয়কে পুঁজি করে নিত্যপণ্য তো বটেই, এমনকি ওষুধেরও কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে ব্যবসায়ীরা মানুষকে তো বটেই, সরকারকেও নাকানি চুবানি খাইয়ে ছেড়ে দিচ্ছে। সব ক্ষেত্রে রাষ্ট্র তার দায়িত্ব ছেড়ে দেবে এ ব্যবস্থা এখানে চলবে না। ঢালাও বিরাষ্ট্রীয়করণের পথ আমাদের নয় করোনা সঙ্কটের দিনগুলো থেকেও যেন আমাদের সে উপলব্ধি হয়।

পুঁজিবাদের ভিতরের পরিষ্কার দুর্দশাগুলো করোনা ভাইরাস আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার পরও যেন আমরা চোখ বন্ধ করে না থাকি। ধনী দেশের মতো স্বাস্থ্য সুরক্ষাকেও যেন আমরা পণ্য করে না ফেলি, শিক্ষাকে পণ্যায়নের যে সর্বনাশা পথে আমরা গত অন্তত তিন দশক ধরে হাঁটছি, সে পথ থেকে যেন আমরা সরে আসি। রাষ্ট্রকে এখনো দায়িত্ব নিতে হবে মৌলিক অধিকারের। এ কাজ আমেরিকা-ইউরোপের চেয়ে আমাদের জন্য সহজ। কারণ পুঁজির বিস্তার সেখানে যতো প্রকট আকারে ঘটেছে, আমরা এখনও তার ধারেকাছেও যাইনি। সময় আছে ফিরে দাঁড়াবার, সময় আছে পথ পাল্টাবার।

করোনা সঙ্কট আমাদের উন্নয়নের ভিতরকার কঙ্কালসার চেহারাকে নগ্নভাবে প্রকাশ করে দিয়েছে। অন্যান্য দেশের সাথে তুলনা করলে আমাদের স্বাস্থ্যখাত অনেক দুর্বল। এখানে প্রতি আড়াই হাজার রোগীর জন্য মাত্র একজন ডাক্তার, যেখানে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুসারে প্রতি এক হাজার রোগীপিছু অন্তত একজন ডাক্তার থাকা দরকার। আর বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের হিসাব করলে ডাক্তারপ্রতি রোগীর সংখ্যা লক্ষাধিক। আবার সে অনুপাতে নার্সও নেই আমাদের। যেখানে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশমতো প্রতিজন ডাক্তারের বিপরীতে তিনজন নার্স থাকা দরকার, সেখানে আমাদের ডাক্তারের সংখ্যার অর্ধেক পাওয়া যাবে নার্স। উল্লেখ্য, রোগীপ্রতি ডাক্তার ও নার্সের এই অনুপাতে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আমরাই সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে আছি। এমনকি যে নেপাল-ভুটান থেকে আমাদের দেশে চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়তে আসে প্রতিবছর প্রচুর শিক্ষার্থী, তারাও এ আনুপাতিক হিসাবে আমাদের চেয়ে অনেকখানি এগিয়ে আছে।

করোনা সঙ্কটের সময়ে অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যেখানে এ ভয়ংকর ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কারের পথ খুঁজছেন, সেখানে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল হ্যান্ড স্যানিটাইজার বানানোর কাজ চলছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্যানিটাইজার আর মাস্ক বানানোতেই সার্থকতা খুঁজছে, কারণ প্রতিষেধক বানানোর মতো গবেষণায় নামার স্বপ্ন ও সাহস কোনোটাই তাদের নেই। এই না থাকার কারণ কেবল তারাই নয়, কারণ আমাদের সার্বিক ব্যবস্থাপনা।

আমাদের দেশে চিকিৎসা খাতে ও শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ কাক্সিক্ষত পরিমাণের চেয়ে বেশ কম। যা বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার সিংহভাগ ব্যয় করা হয় ফিজিক্যাল অবকাঠামো আর বেতন-ভাতার পিছনে। গবেষণা আর জ্ঞানসৃজনে আমাদের বরাদ্দ নামমাত্র, বলা চলে বরাদ্দই নেই। আমরা উপরি অবকাঠামো উন্নয়নে যতোটা এগিয়েছি, গবেষণা করে ভিতরগত জ্ঞান সৃজন ও আহরণে তার সামান্যতমও কিছু করিনি। এ কারণে আমাদের অবকাঠামোর শ্রমিক হতে পারি আমরা, কিন্তু বিশেষজ্ঞ ভাড়া করতে হয় বিদেশ থেকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের গবেষণা প্রবন্ধ যা বেরোচ্ছে, তার সিংহভাগ কেবল কপি-পেস্ট, মৌলিক গবেষণা কোথায়? এই যে ভিতরকার উন্নয়নে আমরা রিক্তহস্ত, এখানে গুরুত্ব আরোপ করতে হবে দীর্ঘমেয়াদে। না হলে কেবল মাস্ক আর পিপিই পাওয়ার জন্য আমাদের এই যে তীর্থের কাকের মতো পরমুখাপেক্ষী হয়ে বসে থাকা এই গণ্ডিতেই ঘুরপাক খেতে হবে। এবারের সঙ্কট আমাদের শিখিয়ে দিলো, ভিতরগত উন্নয়নের দিকে এবার মনোযোগী হতে হবে।

লেখক: বাপ্পাদিত্য বসু, সাধারণ সম্পাদক, ইয়ুথ ফর ডেমোক্রেসি এন্ড ডেভেলপমেন্ট।


শর্টলিংকঃ