মানবতার মূর্তপুরুষ অস্কার শিন্ডলার


“অস্কার শিন্ডলার (১৯০৮-১৯৭৪)। জাতীয়তা জার্মান। ছিলেন নাৎসি পার্টির সদস্য। পেশায় ব্যবসায়ী। যার মূলধন ছিল ইহুদী ধনীদের কাছ থেকে ধার করে নেওয়া অর্থ। ইহুদীদের টাকায় ইন্ডাস্ট্রি গড়েছেন। কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। মানুষটা খারাপ, তাইনা! হ্যাঁ খারাপ!…”  মানবতার মূর্তপুরুষ শিন্ডলারকে নিয়ে লিখেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মুয়াজ হোসেন।

মানুষ কাকে বলে?  মানবতার পরিচয় কি? মানবতাবাদ কাকে বলে?  প্রশ্নগুলো হয়তো কঠিন। তবে উত্তরগুলো সহজ।  খুবই সহজ। মতপার্থক্য এড়িয়ে সহজ ভাষায়- মানুষ হচ্ছে তারাই, যারা ভুল আর সঠিকের মাঝে পার্থক্য করতে পারে। মানবতা হচ্ছে সেই সঠিক পথে নিজেকে পরিচালিত করা। আর মানবতাবাদ হচ্ছে সঠিক পথে চলতে গিয়ে আরো হাজারটা মানুষকে মানবতা তথা সেই সঠিক পথে চলতে উদ্বুদ্ধ করা।

অস্কার শিন্ডলার (১৯০৮-১৯৭৪)। জাতীয়তা জার্মান। ছিলেন নাৎসি পার্টির সদস্য। পেশায় ব্যবসায়ী। যার মূলধন ছিল ইহুদী ধনীদের কাছ থেকে ধার করে নেওয়া অর্থ। ইহুদীদের টাকায় ইন্ডাস্ট্রি গড়েছেন। কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। মানুষটা খারাপ, তাইনা! হ্যাঁ খারাপ!

কারণ তার প্রাথমিক কর্মপদ্ধতি ছিল খারাপ। তার উদ্দেশ্য ছিল কোটিপতি হওয়া। ‘লাভ’ করার জন্য তিনি করতে পারতেন সবকিছু। তার ব্যবসায় লোকসান বলতে কিছুই ছিল না। তিনিই এমন কাজ করে গেছেন, যার জন্য আজও হাজার হাজার ইহুদি অস্কার শিন্ডলারকে ধারণ করে অন্তরের অন্তঃস্থলে।

তার নামে ইহুদীদের একটা বিশাল গোত্রের মত রয়েছে; ‘Schindlerjuden’ বা  ‘শিন্ডলারের ইহুদী’। যারা হলোকাস্টের (বিশ্বযুদ্ধকালীন গণহত্যা) সময়ে শুধুমাত্র শিন্ডলারের সহায়তায় মৃত্যুর নির্মম থাবা থেকে বেঁচে গেছে।

শিন্ডলার তার ব্যবসার পুঁজি হিসেবে ধনী ইহুদীদের কাছ থেকে টাকা নেয় এই বলে যে, যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে তারা ব্যবসার মূলধন সমেত বিরাট অংকের লভ্যাংশ পাবেন। ইহুদীরা তখন কোনঠাসা।

হাতের মুঠোয় প্রাণ রাখা যেখানে দুষ্কর সেখানে টাকা হাতে রেখে কী হবে এই ভেবে তারাও শিন্ডলারের কাছে তুলে দেয় তাদের সঞ্চয়।শিন্ডলার সেই অর্থ ব্যয় করে ব্যাংকরাপ্ট হয়ে যাওয়া একটি থালাবাসনের কারখানা কিনে নেন।

সেখান থেকেই শুরু হয় তার অর্থবিত্তের প্রভাববিস্তার। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মৃত্যুমুখী ইহুদীদের মাঝ থেকে পয়সাওয়ালাদের খুঁজে বের করা আর সেই অর্থ কাজে লাগিয়ে ব্যবসায় নামার সমস্ত বুদ্ধিবিবেচনার দায় থাকে শিন্ডলারের একাউন্টেন্ট কাম ম্যানেজার ইৎজাক স্টার্ণের।

যিনি শিন্ডলারের সাথে কাজ করার পূর্বে একটি থালাবাসনের কোম্পানিতে একাউন্টেন্ট ছিলেন। এবং তিনি ছিলেন ইহুদী। ফলে ইহুদীমহলে তার পরিচিতি এবং প্রভাব দুটোই ছিল। ইৎজাক স্টার্ন তার এই প্রভাব কাজে লাগিয়ে শিন্ডলারের কোম্পানিতে সমস্ত কর্মী নির্বাচন করেন ইহুদীমহল থেকে। তিনি যুক্তি দেন যে এসব কাজ জার্মানরা করবে না এবং পোলিশরা মজুরি বেশি নেবে।

শিন্ডলার ব্যাপারটা যুক্তিসম্মত মনে করেন। কিছুদিন পরেই কমান্ডার আমন গোয়েথ নামের এক নাৎসি কমান্ডারের নেতৃত্বে ঘটে ‘Liquidation of Ghetto‘ যেটি ‘ঘেটো তে ইহুদী নিধন’ নামে পরিচিত।

হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয় এই দিনে। রাস্তায় নামিয়ে পুরুষ, স্ত্রী আর বাচ্চাদের আলাদা করা হয়। প্রথমে পুরুষদের দাঁড় করানো হয় সামনাসামনি লাইনে। যাতে একটি বুলেটেই দু-তিনজন করে মারা পড়ে।

এরপরে মহিলাদের পালা। তাদের মাঝ থেকে যাকে পছন্দ হয় তাকে একটু আড়ালে নিয়ে গিয়ে করা হয় ধর্ষন। আর পছন্দ না হলে গুলি করে হত্যা। সবকিছু বাচ্চাদের চোখের সামনেই। শুরুতে বাচ্চারা কান্না শুরু করলেও আশু মৃত্যুভয় তাদেরকে নির্বাক করে দেয়।

তারা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখতে থাকে কীভাবে তাদের মায়েদের ধর্ষন করার পরে রাইফেলের একটি গুলি মাথার খুলি ভেদ করে যাচ্ছে। ধর্ষনে নিথর দেহ দ্বিতীয়বার নড়ে ওঠে না আর। হয়তো আগেই মরে গেছে সে। শিন্ডলার এসব দূর থেকে প্রত্যক্ষ করে।

অস্কার শিন্ডলারের সমাধি

তার মনে তখনই পণ জাগে যেভাবে হোক এদের বাঁচাতে হবে। তিনি তার কারখানার কর্মী বৃদ্ধি করতে থাকেন। আর বিভিন্ন জায়গা থেকে নাৎসিদের আর্মি ক্যাম্পে আগত ইহুদীদের তার কারখানায় কাজ দিতে থাকেন।

কারখানায় কাজ করাটা তখন ইহুদীদের কাছে সবচেয়ে সুখকর মনে হয়েছিল। অনেকে শিন্ডলারের কোম্পানিকে ‘Himmel auf Erden’ বা ‘পৃথিবীর স্বর্গ’ হিসেবে নামকরণ করেছিল। শিন্ডলার ঘেটোতে কারখানা বেশিদিন চালিয়ে যেতে পারেন না। তিনি তার জন্মস্থান চেকোস্লোভাকিয়ায় চলে যান।

তার প্রায় এক হাজার কর্মী এবং জুলিয়াস মাদ্রিস টেক্সটাইল মিলে কর্মরত প্রায় দুইশ’ কর্মীদের কমান্ডার আমন গথের কাছ থেকে ঘুষের বিনিময়ে নিয়ে যান সেখানে। শুরু করেন নতুন কারখানা। এবারে থালাবানান নয়। মর্টারশেলের খোলস আর যুদ্ধাস্ত্র।

শিন্ডলারকে নিয়ে ঔপন্যাসিক টমাস কেনেলির লেখা বই। ছবি: সংগৃহিত

একবার স্টার্ণ শিন্ডলারকে ডেকে বলে যে, তাদের কারখানার অস্ত্রগুলো পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। শিন্ডলার একথা শুনে বলেছিলেন, ‘এই কারখানায় তৈরি একটি শেলও যদি ঠিকভাবে লক্ষভেদ করে, আমি খুবই কষ্ট পাবো।’

১৯৪৫ সালের ৭ই এপ্রিল। সেদিন জার্মান নাৎসি বাহিনী সোভিয়েত আর্মির কাছে আত্মসমর্পণ করে। তার পরের দিন ৮ই এপ্রিল রাত ১২ টায় সেটি কার্যকর হবার কথা।

অস্কার শিন্ডলার তখন তার কারখানার কর্মীদের কাছ থেকে বিদায় নেন। বিদায় নেবার সময়ে ইৎজাক স্টার্ণের কাছে তিনি একটা কথাই বারবার বলছিলেন, “আমি তো আরও মানুষ বাঁচাতে পারতাম।”

তিনি তার গাড়ি দেখিয়ে বলেন, “এই যে গাড়িটা। এটা বিক্রি করলে আরও দশটা মানুষ বাঁচানো যেত।”

শিন্ডলারের বিদায়বেলায় তার কারখানার কর্মীরা তাদের এক সহকর্মীর সোনায় বাঁধানো দাঁত খুলে সেটি দিয়ে শিন্ডলারের জন্য তারা একটা আংটি তৈরি করে।

শিন্ডলার সেটি হাতে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, “এটা তো খাঁটি সোনার আংটি। এটা দিয়েও তো দুজন অল্পবয়েসি মানুষ বাঁচানো যেত। অথবা একজন পূর্ণবয়স্ক কে।”

তার এই করুণ দৃশ্য দেখে উপস্থিত প্রায় বারোশ মানুষ কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। ‘মা হারানো, বাবা হারানো, ভাই-বোন-স্বামী-স্ত্রী সবার মুখেই সেদিন কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছিল ব্রিনলিজ গ্রামের শুকনো মাটি।

পলদেক পেফারবার্গ নামে এক হলোকাস্টের উত্তরজীবির বয়ান অনুযায়ী অস্ট্রেলীয় ঔপন্যাসিক টমাস কেনেলি ১৯৮২ সালে ‘Schindler’s Ark’ নামে উপন্যাস রচনা করেন। যেটি পরবর্তীতে বুকার পুরস্কার জয়ী হয়।

১৯৯৩ সালে এই বইয়ের অবলম্বনে স্টিভেন স্পিলবার্গ তৈরি করেন ‘Schindler’s Ark’ নামের চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন লিয়াম নিসন, রাল্ফ ফিয়েন্স, বেন কিংসলি প্রমুখ।

যেটি পরবর্তীতে ১৯৯৪ সালে সর্বোচ্চ নমিনেশন সহ অস্কার পুরস্কার লাভ করে। অস্কার শিন্ডলার ১৯৭৪ সালের ৯ই অক্টোবর জার্মানিতে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃতদেহ বর্তমানে মাউন্ট জায়ন খ্রিস্টান সমাধিস্থলে শায়িত আছে।


শর্টলিংকঃ