Site icon ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ

মানবিক মূল্যবোধ থেকেই মা-বাবাকে ভালোবাসুন


ইউএনভি ডেস্ক:

মা-বাবার সেবা করা সন্তানের অন্যতম দায়িত্ব। যেমনভাবে সন্তানের লালন-পালন মা-বাবার দায়িত্ব। জন্মগ্রহণের পর শিশুর প্রধান ও একমাত্র আশ্রয়স্থল মা-বাবা। শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যুবক ও প্রতিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত মা-বাবার আশ্রয়ে সে থাকে।

মা-বাবা জীবনের অমূল্য সম্পদ। কিন্তু বর্তমানে বৃদ্ধ মা-বাবার আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে বৃদ্ধাশ্রম। এমন অনেক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ২৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদে পাস হয় মা-বাবার ভরণপোষণ আইন, যা পরবর্তী সময়ে বাধ্যতামূলক করা হয়।

আমাদের সমাজে পরিবার প্রথাটি অনেক পুরনো, যার মূলভিত্তি স্বামী-স্ত্রী। যে স্বামী-স্ত্রীর জৈবিক সম্পর্কের ফলে সন্তান জন্মলাভ করে, মূলত তারাই সেই সন্তানের মা-বাবা। এছাড়া অনেক নিঃসন্তান হওয়ায় কিংবা সন্তান দত্তক নিয়ে থাকেন। সন্তানের লালনপালন মা-বাবাই করেন ও মা-বাবার মৃত্যুর পরে সব সম্পত্তির উত্তরাধিকার ওই সন্তানই হয়ে থাকে।

এক্ষেত্রে ধর্ম ভেবে আলাদা আলাদা উত্তরাধিকার আইন রয়েছে। সন্তানের সঙ্গে মা-বাবার রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। মা-বাবা ও সন্তানের সম্পর্ককে সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দিয়েছে বিভিন্ন ধর্ম। একসময় সন্তানের নৈতিক দায়িত্ব ছিল কিন্তু বর্তমানে আইন করে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর কারণ বৃদ্ধ মা-বাবাকে নির্যাতন এবং আর কোনো প্রতিকার না থাকায় ও বৃদ্ধাশ্রমে প্রেরণ করার ফলে।
ষাটোর্ধ্বদের সিনিয়র সিটিজেন বলা হয়। ২০১৪ সালের বিশ্ব প্রবীণ দিবসে দেশের ১ কোটি ৩০ লাখ প্রবীণ নাগরিককে সিনিয়র সিটিজেন ঘোষণা করেন বাংলাদেশ মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি বিভাগে সরকারি ও বেসরকারিভাবে বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে। এসব বৃদ্ধাশ্রমে ক্রমাগত বৃদ্ধের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, যা আসলে আমাদের জন্য অশনী সংকেত।

বর্তমানে কাউকে আর ঠাকুরমার ঝুলি বলার জন্য বাসায় রাখতে চায় না। অথচ একটি সময় ছিল যখন শিশুদের শৈশব আর কৈশোর পরিতৃপ্তি পেত দাদা ও নানা বাড়িতে বেড়াতে গেলে। চাকরির পরিসংখ্যানের কথা বললে সাধারণত ষাটোর্ধ্ব বয়সের বেশি কারও জন্য চাকরি নেই। চাকরিহীন বৃদ্ধরা এসময়টায় অসহায় বললেই চলে। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে পেনশন সম্বল হয়, কিন্তু বেসরকারি কিংবা প্রাইভেটে এমন সুবিধা নেই।

মা-বাবাকে ভরণপোষণের বিষয়টি আইনত বাধ্যতামূলক করার আগে ধর্মীয় ও নৈতিক বিষয় ছিল। সামাজিক রীতিনীতি ছিল। একসময় এই দেশে বৃদ্ধাশ্রম বলতে কিছুই ছিল না। আশ্রম ছিল যেখানে সন্যাসীরা থাকতো। ইসলাম ধর্মে মা-বাবার মর্যাদা ও ভরণপোষণের নির্দেশ দেওয়া আছে।

মা-বাবার হক সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আর তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তার সঙ্গে কোনো বস্তুকে শরিক করো না এবং মা-বাবার প্রতি উত্তম আচরণ করো।’

এছাড়া হজরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ইয়া রসুলুল্লাহ! আমি সর্বাগ্রে কার সঙ্গে সদাচরণ করব?’ রসুল (সা.) বলেন, ‘তোমার মায়ের সঙ্গে।’ লোকটি প্রশ্ন করলেন, ‘তারপর?’ উত্তর এলো, ‘তোমার মা’। লোকটি আবার জানতে চাইলেন, ‘এরপর কে?’ রসুল (সা.) এবারও জবাব দিলেন, ‘তোমার মা।’ ওই লোক চতুর্থবার একই প্রশ্ন করলে রসুল (সা.) বলেন, ‘তোমার বাবা।’ (বোখারি ও মুসলিম)।
সনাতন ধর্ম অনুযায়ী, ‘জননী স্বর্গ অপেক্ষা গরীয়সী। পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাই পরম তপস্যার ব্যক্তি।’ খ্রিস্টান ধর্মে জিসু (ঈসা আ.) উনার মাতা মারিয়া (মরিয়ম আ.) পবিত্রতার কথা আজীবন বলেছেন। বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ‘ত্রিপিটক’-এ বলা হয়েছে ‘মাতা-পিতার সেবা করাই সবচেয়ে উত্তম।’

কিন্তু বর্তমানে সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষা ভুলে মানুষ মা-বাবাকে ভুলতে বসেছে। মানুষ অকৃজ্ঞত না হলে এমন পর্যায় আসে না। ফলে বাংলাদেশের সরকার মা-বাবার ভরণপোষণ আইন ২০১৩ প্রণয়ন করেছে। আইনের ২ ধারা অনুযায়ী জন্মদাতা মা-বাবা এই আইনের আওতাভুক্ত হবেন। ভরণপোষণের বিষয়ে ওই আইনের ৩ ধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, মা-বাবার ভরণপোষণের বিষয় সন্তান নিশ্চিত করবে। একাধিক সন্তান থাকলে আলাপ আলোচনা করে নিশ্চিত করবে।

মা-বাবার সব সেবাদানের বিষয়ে সন্তান পরস্পরের সঙ্গে আলোচনা করে পরস্পরের স্থান থেকে কাজ করবেন। ৪ ধারা অনুযায়ী দাদা-দাদি ও নানা-নানি থাকলে মা-বাবার অবর্তমানে তাদের ৩ ধারা অনুযায়ী সেবা দিতে বাধ্য। আইন অমান্যে রয়েছে শাস্তি। কেউ যদি এই আইন অমান্য করে, তবে তাকে এক লাখ টাকার অর্থদণ্ড, অনাদায়ে তিন মাসের জেলের বিধান করা হয়েছে।

এ আইনের ৮ ধারায় বর্ণিত, আপস নিষ্পত্তির ক্ষমতা স্থানীয় সরকার পরিষদকে দেওয়া হয়েছে। তবে ওই মামলার ক্ষেত্রে মা অথবা বাবাকে বাদী হয়ে মামলা করতে হবে। যেখানে বৃদ্ধ মা-বাবাই সন্তানের কাছে জিম্মি হয়ে থাকে, সেখানে থানায় কিংবা আদালতে মামলা করা অনেক সাহস ও সামর্থ্যের ব্যাপার। ফল হিসেবে বাংলাদেশে এমন আইনের বাস্তবায়ন তেমন নজির নেই। কিন্তু গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর প্রশাসনের উদ্যোগে অনেক অত্যাচারী সন্তানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

আইন সম্পর্কে অনেক কিছুই জানলাম। কিন্তু বাবা-মাকে ভরণপোষণের দায়িত্ব যতটা না আইনের উপর নির্ভর করে, তার চেয়ে বেশি নির্ভর করে মানবিক মূল্যবোধের উপর। সন্তান যখন জন্ম নেই, তখন তো তার কান্না ছাড়া কোনো ভাষাই থাকে না। তখনও তো বাবা-মা সন্তানের সবগুলো প্রয়োজনই বোঝেন, তেমনি সন্তানেরও বাবা-মা বৃদ্ধ হয়ে গেলে তার প্রয়োজনের ভাষা বুঝতে হবে। এভাবেই আইনের প্রকৃত উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হবে। বৃদ্ধাশ্রম নয়, মা-বাবাকে নিজের কাছে রেখেই সেবাযত্ন করতে হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।


Exit mobile version