মাস্ক না পরতে নানা অজুহাত


ইউএনভি ডেস্ক:

টিকা না আসা পর্যন্ত করোনা মহামারী থেকে নিজেকে রক্ষা করতে মাস্কই ভরসা। কিন্তু মাস্ক পরতে চাচ্ছেন না অনেকেই। তারা মাস্ক না পরতে নানা অজুহাত দিচ্ছেন। কেউ বলছেন, গরম লাগে। কেউ বলছেন, মুখ ঘামে; আবার কেউ বলছেন, শ্বাসকষ্ট হয়।


সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সবই মাস্ক না পরার ছুঁতো। যারা মাস্ক ব্যবহার করছেন না, তারা নিজের পাশাপাশি আশপাশের মানুষকেও ঝুঁকিতে ফেলছেন। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকা হাতে পাওয়ার আগে মাস্কই করোনা মোকাবেলার বড় ঢাল।

মাস্ক ব্যবহারে নগরবাসীকে সচেতন করতে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। ঢাকা জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, ১৭ থেকে ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত ভ্রাম্যমাণ আদালত ১২শ’ ব্যক্তিকে ২ লাখ ৮২ হাজার ৮৯০ টাকা জরিমানা করেছেন। এর মধ্যে রোববার ১১৬টি মামলায় ১১৬ জনকে ২৫ হাজার ৯৮০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এছাড়া ১৮ হাজার মাস্ক বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে।

গুলিস্তান মোড়ে রোববার দুপুরে পকেটে মাস্ক রেখে দাঁড়িয়ে বন্ধুর সঙ্গে গল্প করছিলেন সোহেল রানা। এ সময় ঢাকা জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে ১০০ টাকা জরিমানা করেন। মাস্ক না পরার বিষয়ে তিনি বলেন, হোটেল থেকে খেয়ে বের হয়েছি। মাস্ক পরতে ভুলে গেছি। গুলিস্তানের ওসমানী উদ্যানের সামনের রাস্তায় মাস্ক পকেটে রেখে সড়কে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছিলেন সাজেদুল ইসলাম। এ সময় সেখানে হাজির হয় ভ্রাম্যমাণ আদালতের একটি দল। মাস্ক না পরার বিষয়ে জানতে চাইলে সাজেদুল বলেন, আমার কাছে মাস্ক ছিল। পরতে ভুলে গেছি। এ অপরাধে তাকেও গুনতে হয় ১০০ টাকা।

ঢাকা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উজ্জ্বল কুমার হালদার বলেন, অধিকাংশ মানুষ মাস্ক সঙ্গে থাকলেও পরতে চান না। মাস্ক না পরার বিষয়ে মানুষ গরম লাগে, ভুলে গেছি, একটু আগে পরা ছিল, এসব অজুহাত দেখান। মাস্ক পরার অভ্যাসটা বাড়ালে সবার জন্য উপকার হবে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, অপরাধের গুরুত্ব ও মাত্রা, সচেতনতার মাত্রা বুঝে জরিমানা করা হচ্ছে। একজন শিক্ষিত মানুষ অপরাধ করলে যে মাত্রায় শাস্তি হবে, একজন অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষ অপরাধ করলে সেই মাত্রায় শাস্তি হবে না। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের কারণে মাস্ক পরলেও অনেকেই পরে মাস্ক খুলে পকেটে রেখে দেন। গত তিন দিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ মানুষই মাস্ক ছাড়া চলাফেরা করছেন। না পরার কারণ জিজ্ঞেস করতেই কেউ কেউ ক্ষেপেও উঠছেন।

শুক্রবার সন্ধ্যায় কারওয়ান বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, গায়ে গা ঘেঁষে বাজার করছেন মানুষজন। তাদের অধিকাংশের মুখেই মাস্ক নেই। কারওয়ান বাজারে মাস্ক না পরেই সবজি কিনছেন আমজাদ হোসেন। মাস্ক ব্যবহার করছেন না কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি যুগান্তরকে বলেন, মাস্ক সঙ্গে আছে। তবে মুখে দিয়ে কথা বলতে একটু সমস্যা হয় তাই খুলে রেখেছি।

কারওয়ান বাজার ২ নম্বর মার্কেটের পাশের কাঁচাবাজারে মমিনুর রহমান নামে একজন থুতনিতে মাস্ক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তিনি বলেন, মাস্ক নিয়ম করে পরলে শ্বাস নিতে পারি না। তাই এভাবে পরছি। এভাবে পরলে করোনামুক্ত থাকা যাবে না জানালে তিনি বলেন, মোবাইল কোর্টের জরিমানার হাত থেকে তো বাঁচব। তাছাড়া করোনাভাইরাস আমাদের ঘায়েল করতে পারবে না। করোনাকে এখন আর ভয় করি না।

শুক্রবার সন্ধ্যার পর হাতিরঝিলে গিয়ে দেখা গেছে, রীতিমতো আড্ডা চলছে। কেউ বসে গল্প করছেন, কেউ তুলছেন ছবি। অধিকাংশের মুখে মাস্ক নেই। হাতিরঝিলে ঘুরতে আসা রামপুরার বাসিন্দা আলাউদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, এখানে করোনা নেই, তাই মাস্ক পরছি না।

বাংলামোটরে কথা হয় রিকশাচালক আবদুজ জাহিরের সঙ্গে। তিনি মাস্ক না পরেই দিব্যি রিকশা চালাচ্ছেন। আবদুজ জাহির বলেন, মাস্ক পরলে মুখে গরম লাগে। তাই পরি না। একটা মাস্ক পকেটে রাখি। যাত্রীরা বললে পরে নিই। তিনি বলেন, করোনা বড় লোকের রোগ। আমাগো গরিবরে ধরবে না। তাছাড়া করোনায় মারা গেলে তো শহীদী মৃত্যু হবে, সমস্যা কী।

মহাখালী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় মাস্ক ছাড়া চলাফেরা করছিলেন পথচারী আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, আমার শ্বাসকষ্ট আছে, মাস্ক পরলে শ্বাস নিতে পারি না। তাই মাস্ক পরছি না। রোববার দুপুরে মিরপুর ১০ নম্বরে কথা হয় রাহেলা খাতুন নামে এক গার্মেন্টকর্মীর সঙ্গে। তিনি বলেন, গার্মেন্টে যখন ঢুকি, তখন মাস্ক পরে ঢুকি। বাইরে মাস্ক পরা ভালো লাগে না। মাস্ক পরে থাকলে নিজেকে অদ্ভুত লাগে।

রাজধানীর পল্টন, প্রেস ক্লাব, শাহবাগ, বনানী, মহাখালী, ফার্মগেট, আগারগাঁও, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, কালশী মোড়, মিরপুর-১০, ১১, ১২সহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে তিন দিনে প্রায় একই চিত্র দেখা গেছে। সিএনজি অটোরিকশা চালকদেরও দেখা গেছে, মাস্ক ছাড়াই চলতে। আর বিভিন্ন রুটে লেগুনার চালক ও হেলপাররাও ব্যবহার করছেন না মাস্ক।

র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু যুগান্তরকে বলেন, মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে আমরা অভিযান অব্যাহত রেখেছি। আমরা মানুষকে বুঝাচ্ছি, ভ্যাকসিন আসার আগ পর্যন্ত নিজের জন্যই মাস্ক পরতে হবে। তিনি বলেন, আমরা কিছু কিছু জরিমানাও করছি। আবার বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণও করছি। মাস্ক শতভাগ পরা নিশ্চিত করাই অভিযানের উদ্দেশ্য। অভিযানের কারণে মাস্কের ব্যবহার আগের চেয়ে বাড়ছে।

নিপসম করোনা ল্যাবের ভাইরোলজিস্ট ডা. মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, প্রশাসনের কঠোরতা এবং শাস্তির বিধান নিশ্চিত করা গেলেই মাস্ক পরা শতভাগ নিশ্চিত করা যাবে। আর ভ্যাকসিন না আসা পর্যন্ত করোনাভাইরাস থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে মাস্কের বিকল্প নেই। তিনি বলেন, বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি শুরু হয়েছিল গরমকালে। তখন লোকজন মাস্ক পরায় অভ্যস্ত ছিল না। মাস্ক পরলে কারও কারও অস্বস্তি লাগত। কিন্তু এখন তো শীতকাল চলে আসছে। আমি বলব যারা মাস্ক পরায় যেসব সমস্যার কথা বলছেন, এগুলো এক ধরনের ছুঁতো।

২৫ অক্টোবর মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা পেতে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক। ১৮ নভেম্বর থেকে প্রতিদিন ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মহানগরী ও জেলার পাঁচটি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে মাস্ক পরার বিষয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান চালানো হচ্ছে। এছাড়া র‌্যাবের পক্ষ থেকেও অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। এরপরও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে মানুষের উদাসীনতা দেখা যাচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, দেশে এখন পর্যন্ত ৪ লাখ ৬২ হাজার ৪০৭ জনের দেহে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে ৬ হাজার ৬০৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।


শর্টলিংকঃ