মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা মেডিকেল কলেজ


ভাষা আন্দোলনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ

ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতীয় জীবনে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা, যে ঘটনার ফলে আজ আমরা বাঙালি জাতি। আমরা কথা বলি বাংলা ভাষায়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল, পশ্চিমা শাসকদের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ও নিপীড়নের দিনক্ষণ এবং বছর পার করে আন্দোলনের যে দিনটি শোক ও স্মৃতির পাতায় জমা হয়েছিল, সেটি হলো ২১ ফেব্রুয়ারি। জাতীয় মাতৃভাষা দিবস থেকে শুরু হয়ে যা স্বীকৃতি অর্জন করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। সেই দিবসটি অর্জনের পেছনে ছাত্র-শিক্ষক ও যুব সমাজের যে ত্যাগ, সেটাকে আমরা কখনো ভুলতে পারি না। পূর্ববাংলার কেন্দ্র ঢাকায় যে আন্দোলনের শুভসূচনা, যে আন্দোলনে ব্যক্তি থেকে শুরু করে দল ও প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা দৃশ্যমান ছিল, সে ভাষা আন্দোলনে ১৯৪৬ সালে ১০১ জন ছাত্র নিয়ে যাত্রা করা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

১৯৪৮ সালের মার্চে রমনার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান) যেদিন জিন্নাহ সাহেব ঘোষণা দেন ‘উর্দু শুধু উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’, সেদিন বাংলা ভাষাভাষী সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতাসহ ছাত্র-শিক্ষক সমাজ ক্ষোভে উত্তাল হয়েছিল। ধীরে ধীরে ছাত্র যুবকদের সেই চাপা ক্ষোভ ১৯৫২ সালে প্রতিবাদে রূপ নেয়। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ডাকে ৪ জানুয়ারি সফল ছাত্র ধর্মঘটের পর শাসকগোষ্ঠী ২১ ফেব্রুয়ারি সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ও ১৪৪ ধারা জারি করে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের অনেকেই ১৪৪ ধারা ভাঙার বিপক্ষে থাকলেও ছাত্রনেতারা তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে ঐতিহাসিক আমতলায় (বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে, যেখানে নতুন অপারেশন থিয়েটার কমপ্লেক্স তৈরি হয়েছে) প্রতিবাদী ছাত্রদের সভার পর ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল শুরু হয়। পুলিশের বেপরোয়া লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও গ্রেফতারের ফলে শান্তিপূর্ণ মিছিল কিছুক্ষণের মধ্যে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। দুপুরের পর পুলিশ গুলিবর্ষণ শুরু করে। ফলে ব্যারাক চত্বর ও এর আশপাশে গুলির আঘাতে শহীদ হন রফিক, বরকত, জব্বার। বরকতকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে জরুরি অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা লাশগুলো বর্তমান ডিসেকশন হলের পেছনে লুকিয়ে রেখেছিলেন পরদিন জানাজার জন্য, কিন্তু রাতে পুলিশ তা ছিনিয়ে নিয়ে যায় এবং আজিমপুর কবরস্থানে গোপনে দাফন করে।

এরই মধ্যে পুলিশের গুলিবর্ষণের খবর ছড়িয়ে পড়লে হাসপাতাল ও ব্যারাক চত্বরে মানুষের ঢল নামে। মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ গণপরিষদের অধিবেশন বর্জন করে ব্যারাক চত্বরে ২০ নং শেডের ১ নং কক্ষে স্থাপিত কন্ট্রোল রুমে এসে মাইকে আবেগজড়িত ভাষার বক্তব্য রাখেন। ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে তখনকার ছাত্রসংসদের সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ব্যারাকবাসী ছাত্রদের সঙ্গে আলাপ করে কন্ট্রোল রুম স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। এ কন্ট্রোলরুম স্থাপন মেডিকেল কলেজের তৎকালীন ছাত্রদের একটি বুদ্ধিদীপ্ত সাহসী সিদ্ধান্ত ছিল। পরবর্তী সময়ে এ কন্ট্রোল রুমেই রাজনীতিক বুদ্ধিজীবীসহ সর্বস্তরের জনতার সংহতি প্রকাশের একটি মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। তাছাড়া কন্ট্রোল রুমের মাইক থেকেই নেতারা পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন।

সেই ২১ ফেব্রুয়ারি রাতেই তৎকালীন ছাত্রসংসদের সভাপতি গোলাম মাওলার রুমে আব্দুল মতিন ও অলি আহাদসহ অন্য ব্যারাকবাসী ছাত্রদের উপস্থিতিতে আন্দোলন পরিচালনার জন্য সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠন করে গোলাম মাওলাকে আহ্বায়কের দায়িত্ব দেয়া হয়। বস্তুত তার নেতৃত্বেই পুলিশের গুলিবর্ষণের পর পরবর্তী আন্দোলন পরিচালিত হয়। পুলিশের গুলিবর্ষণ ও ব্যারাকে হামলা ব্যারাকবাসী সব ছাত্রকে আন্দোলনে আরো সম্পৃক্ত করে।

২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিবর্ষণে নিহত শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে মেডিকেল ব্যারাকের ছাত্ররা ২৩ ফেব্রুয়ারি শনিবার রাতে এক দুঃসাহসিক কাজ আরম্ভ করে। সেদিন রাতেও কারফিউ ছিল। এর মধ্যেই রাত ১০টা থেকে ভোর ৫টার মধ্যেই সংসদের সাধারণ সম্পাদক শরফুদ্দিন ইঞ্জিনিয়ারের তত্ত্বাবধানে ব্যারাকের সব ছাত্র-ছাত্রীর শ্রমে তৈরি হয় সাড়ে ১০ ফুট উঁচু ও ৬ ফুট চওড়া স্মৃতিস্তম্ভ। কলেজ প্রাঙ্গণে জমা ছিল কলেজ ভবন সম্প্রসারণ কাজের জন্য ইট, বালি ও সিমেন্ট। এগুলো সদ্ব্যবহারে তৈরি হয় স্মৃতিস্তম্ভ। প্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছিল ব্যারাকের প্রধান গেটের কাছে ১২ নং শেডের পূর্ব প্রান্তে। এ মিনারের নকশা করেছিলেন বদরুল আলম এবং সঙ্গে ছিলেন সাঈদ হায়দার। ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ ফলকটিও তারই হাতের লেখা। উল্লেখ্য, কলেজ প্রাঙ্গণে তালাবদ্ধ সিমেন্ট গুদাম খুলতে কন্ট্রাক্টর মহল্লা সরদারের (পিয়ারু সরদার) কাছ থেকে চাবি আনা ও সিমেন্ট ব্যবহারে সম্মতি আনার কৃতিত্ব অবশ্যই তৎকালীন ছাত্র আলী আজগরের। হাসপাতালের স্ট্রেচার ব্যবহূত হয়েছিল বালি ও সিমেন্ট বহনে। এসব কাজে ছিল সবার সহযোগিতা। আর আমাদের হাতে হাতে ইট বহন, কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে হোস্টেল প্রাঙ্গণে। বরকতের গুলিবিদ্ধ হওয়ার স্থানটির কাছেই তৈরি করা হয় শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। হোস্টেল গেট থেকে সামান্য দূরে ১২ নম্বর ব্যারাকের সামনে ছিল স্মৃতিস্তম্ভের অবস্থান।

২৪ ফেব্রুয়ারি রোববার, সহকারী ছুটির দিন। নবনির্মিত শহীদ মিনারটি প্রথমে উদ্বোধন করেন শহীদ শফিউরের পিতা। কিন্তু তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর ছুটির আরাম হারাম হয়ে যায়, যখন তিনি শুনতে পান স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির কথা এবং দলে দলে লোকজনের স্মৃতিস্তম্ভ দর্শন ও তাকে ধিক্কার দেয়ার কথা। শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ সত্যই আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে, ছাত্র-জনতার মধ্যে প্রতিবাদী চেতনার নতুন উদ্ভাস তৈরি করে। ‘দৈনিক আজাদ’ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির খবর প্রকাশ করে ‘শহীদ বীরের স্মৃতিতে’ শিরোনামে।

আনুষ্ঠানিকভাবে ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে এ স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধন করেন ‘দৈনিক আজাদ’ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন। ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকালেই সশস্ত্র পুলিশ হোস্টেল ঘেরাও করে শাবল, কোদাল, গাঁইতি ও দড়ি নিয়ে হোস্টেল প্রাঙ্গণে ঢোকে, সঙ্গে ট্রাক। মিনারের বুকে মোটা দড়ির প্যাঁচ এঁটে ট্রাকের সাহায্যে হ্যাঁচকা টানে শহীদ স্তম্ভটা ভেঙে ফেলা হয়। মাটি খুঁড়ে শহীদস্তম্ভের শেষ খণ্ডটিকে ট্রাকে তুলে নিয়ে চলে যায় সশস্ত্র পুলিশের দল।

পেছনে রেখে যায় ধুলো আর ডিজেলের পোড়া গন্ধ। রাইফেল তাক করে বসে থাকা পুলিশের সামনে শেষ বিকালে হোস্টেলে উপস্থিত জনাকয়েক ছাত্রের পক্ষে কিছুই করার ছিল না অসহায় চোখে মিনার ধ্বংসের দৃশ্য দেখা ছাড়া। এ ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের তৎকালীন ছাত্ররা স্মরণীয় হয়ে আছেন। শহীদ মিনার ভেঙে ফেলার প্রতিক্রিয়ায় দেশের অনেক শিক্ষায়তনে ক্ষুদ্র শহীদ মিনার জন্ম নেয়।

পরবর্তীকালে এর ধারাবাহিকতায় তৈরি হয় সরকারি প্রচেষ্টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এবং তা প্রথম শহীদ মিনারের সামান্য দূরে, বিলুপ্ত হোস্টেল ব্যারাকের উত্তর সীমারেখা ধরে। শিল্পী হামিদুর রহমান ও ভাস্কর নভেরা আহমদের নকশা ও মডেলভিত্তিক শহীদ মিনার তৈরি হয় নানা বাধাবিপত্তির মুখে। নতুন আঙিকে তৈরি হলেও তা ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের দ্বারা প্রথম শহীদ মিনারের সংস্করণ মাত্র।

মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা মেডিকেল কলেজ

মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা চিকিৎসক, তৎকালীন ছাত্র, কলেজ ও হাসপাতালে কর্মরত নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। তাদের অনেকেই অস্ত্র হাতে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। আবার কেউ কেউ হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধা এবং অসহায় বাঙালির চিকিৎসা করেছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভূমিকা দুই ভাগে বর্ণনা করা যেতে পারে।

এক ভাগে যারা ওই সময় কলেজের ছাত্র ছিলেন ও প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের তৎপরতা, আরেক ভাগে এ কলেজ থেকে পাস করা চিকিৎসকদের একটি অংশ যারা অন্যান্য হাসপাতাল ও সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরে কর্মরত ছিলেন কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধ করেছেন।

এ কলেজের তৎকালীন ছাত্রদের মধ্যে বিভিন্ন সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মোয়াজ্জেম হোসেন, সেলিম আহমেদ, আলী হাফিজ সেলিম, আবু ইউসুফ মিয়া, ইকবাল আহমেদ ফারুক, মুজিবুল হক, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, মোজাফ্ফর, আমজাদ হোসেন, ওয়ালীত, ওসমান, গোলাম কবীর, ডালু নুরুজ্জামান, শাহাদত প্রমুখ পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এদের অনেকেই ঢাকা শহর কমান্ডের তত্ত্বাবধানে থেকে যুদ্ধ করেছিলেন।

এ কলেজের কয়েকজন ছাত্র শহরের কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাসহ বর্তমান শহীদ ডা. ফজলে রাব্বি ছাত্রাবাসে রাজাকারদের ওপর হামলা চালান। ছাত্রাবাসের ১০৭ নং রুমে সে সময় রাজাকারদের ঘাঁটি ছিল। তাদের গোপন হামলায় হোস্টেল গেটে পাহারারত দুজন রাজাকার নিহত হয়। গুলির শব্দ শুনে ১০৭ রুমে অবস্থানরত অন্য রাজাকাররা পালিয়ে যায়। এদের একজন সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে থাকলে সেও মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির আঘাতে নিহত হয়। একই দিনে তারা ২১৯ নং রুমে হামলা চালান।

এই গ্রুপটি কলেজ-ডি সেকশন হলেও বোমা হামলা চালিয়েছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজের আরেকজন ছাত্র সিরাজুল ইসলাম হাসপাতালে বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতেন। তিনি রাতে হোস্টেলে না গিয়ে হাসপাতালের ক্যান্সার ওয়ার্ডে ঘুমাতেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের কিছু স্বাধীনতাবিরোধী ছাত্রের সহায়তায় তাকে ১১ ডিসেম্বর রাতে রাজাকার বাহিনী ক্যান্সার ওয়ার্ড থেকে তুলে নিয়ে যায় এবং রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নির্মমভাবে হত্যা করে।

তৎকালীন সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরের সদস্যদের মধ্যে স্কোয়াড্রন লিডার এম শামসুল হক, মেজর খুরশীদ, মেজর শামসুল আলম, ক্যাপ্টেন আব্দুল লতিফ মল্লিক, ক্যাপ্টেন মোশায়েফ হোসেন, ক্যাপ্টেন আ. মান্নান, লে. আখতার, লে. নুরুল ইসলাম প্রমুখ অফিসার বিভিন্ন সেক্টরে নিয়োজিত ছিলেন। এদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ক্যাপ্টেন খুরশিদ ‘বীরউত্তম’ ও লে. আখতার ‘বীরপ্রতীক’ উপাধি পেয়েছিলেন। তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরের যেসব সদস্য শহীদ হয়েছেন তাদের মধ্যে ডা. লে. কর্নেল এএফ জিয়াউর রহমান, ডা. মেজর আসাদুল হক, ডা. লে. আমিনুল হক, ডা. লে. খন্দকার আবু জাফর মো. নুরুল ইমাম প্রমুখ ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত প্রায় সব চিকিৎসকই আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করতেন। মুক্তিযোদ্ধারা আসল নাম গোপন রেখে হাসপাতালে ভর্তি হতেন। হাসপাতালে এসব কাজের সমন্বয়ে দায়িত্ব পালন করতেন অধ্যাপক ফজলে রাব্বি। তিনি তার আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করতেন। যুদ্ধের শেষের দিকে অধ্যাপক ফজলে রাব্বিসহ অনেক চিকিৎসককেই রাজাকার আলবদর বাহিনী গোপন চিঠির মাধ্যমে মৃত্যুর ভয় দেখিয়েছিলেন।

তাদের চিঠির ভাষা ছিল ‘কলকাতার মাড়োয়ারীর দালালদের হত্যা করা হবে’। লাল কালির লেখা চিঠিতে একটি তরবারির প্রতিকৃতি আঁকা ছিল। তবে চিঠির নিচে প্রেরকের ঠিকানা ছিল না। রাজাকারদের ভয়ভীতি উপেক্ষা করেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকরা বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতেন। শহীদ অধ্যাপক আলীম চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সময় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে কর্মরত থাকলেও বেশির ভাগ সময় কাটাতেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা অনেক চিকিৎসক ভারতে গিয়ে বিভিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ওইসব চিকিৎসকের অনেকে অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেছেন। আবার কেউ আহত মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের চিকিৎসা করেছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা চিকিৎসকদের মধ্যে যারা মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তারা হলেন ডা. শিশির মজুমদার, ডা. সরওয়ার আলী, অধ্যাপক সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী, ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান, ডা. মাখদুম নার্গিস, ডা. কাজি তামান্না, ডা. ফৌজিয়া মোসলেম ও ডা. সমীর কুমার শর্মা প্রমুখ (অনেকের নাম সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি)। দেশের ভিতর থেকে অসংখ্য চিকিৎসক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার জন্য পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের হাতে অনেককে জীবন দিতে হয়েছে।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের বেশির ভাগেই ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তৎকালীন ছাত্র ও চিকিৎসকরা বিভিন্নভাবে দেশের শ্রেষ্ঠসন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছিলেন।

এ দেশ আমার মা। এ দেশের মাটি যেন মায়েরই মমতা, সেই মমতা ভরা বাংলা উচ্চারণে আজ আমরা জাতিগত পরিচয় বহন করি। আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি আজ বিশ্বদরবারে স্থান করে নিয়েছে, সেই ঢাকা মেডিকেল কলেজকে জাতীয় স্বীকৃতিস্বরূপ ‘একুশে পদক’-এ ভূষিত করার জোর দাবি জানাচ্ছি।

আর ভাষা আন্দোলনের যুগপৎ হিসেবে যে প্রতিষ্ঠান ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অসংখ্য বুদ্ধিজীবী ও বীর মুক্তিযোদ্ধার জন্ম দিয়েছিলেন এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠায় অসামান্য অবদান রেখেছিলেন, সেই অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ঢাকা মেডিকেল কলেজকে স্বাধীনতা পদক উপহার দেয়ার আকুল আবেদন জানাচ্ছি।

ডা. এসএম মোস্তফা জামান: চিকিৎসক


শর্টলিংকঃ