Site icon ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ

মুদ্রার পিঠে ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের ইতিহাস


৭৪২ হিজরি সনে ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ সোনারগাঁ এবং আলাউদ্দীন আলি শাহ ফিরোজাবাদের সিংহাসনে আরোহণ করলে বাংলার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। ইতিহাসবিদরা এ সময়কালের যে বিবরণী দিয়েছেন, তা বেশ বিভ্রান্তিকর এবং বিষয়টিতে ব্লখম্যান, থমাস, মি এম চক্রবর্তী (জেএএসবি ১৯০৯, পৃষ্ঠা ২০৩, ২০৪, ২১৮) এবং মিআরডি ব্যানার্জী এমএ তার ‘বাংলার ইতিহাস’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে বিশদভাবে আলোকপাত করেছেন।

তাদের পরস্পরবিরোধী বর্ণনার বিশদে প্রবেশ করব না। আমাদের কাছে যেটা পরিষ্কার মনে হয়, ৭৪০ হিজরি সনে ফখরুদ্দীন স্বাভাবিকভাবে অথবা হত্যার মাধ্যমে তার প্রভু বাহরাম খানকে সরিয়ে সোনারগাঁর সিংহাসনে বসেন এবং স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

এর অব্যবহিত পরেই লখনৌতির গভর্নর কদর খান তার (ফখরুদ্দীনের) বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন এবং কিছু সময়ের জন্য সফল হন। কিন্তু চতুর ফখরা দ্রুতই পাশার দান উল্টে দেন, এবং কদর খানকে হত্যা করা হয়। ধারণা করা হয় এ ভয়ানক ঘটনায় কদর খানের সেনাদলের ইন্সপেক্টর আলী মুবারক মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন।

৭৪২ হিজরি সনে কদর খানকে হত্যার মধ্য দিয়ে আলী মুবারক লখনৌতির সিংহাসন দখল এবং সরকারের রাজধানী ফিরোজাবাদে স্থানান্তর করেন। এরপর ‘আলাউদ্দিন আলী শাহ’ উপাধি ধারণ করে নিজেকে রাজা হিসেবে ঘোষণা করেন। সুতরাং, ৭৪২ হিজরি সনে আমরা সোনারগাঁর সিংহাসনে ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ এবং ফিরোজাবাদে আলাউদ্দিন আলী শাহকে দেখতে পাই। আমরা এখন দেখব ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ সম্পর্কে মুদ্রা কী সাক্ষ্য দেয়।

বর্তমানে আবিষ্কৃত মুদ্রাগুলোর মধ্যে ফখরুদ্দীনের একটি পাওয়া গেছে এবং সৌভাগ্যক্রমে এটি খুব ভালো নমুনা।

১. ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের ৭৪১ হিজরি সনের রৌপ্য মুদ্রা, সোনারগাঁ (টাঁকশাল)। মুদ্রাটির মাপ শূন্য দশমিক ৯৯ ইঞ্চি, ওজন ১৬০ দশমিক ৫ গ্রেন।

ঢাকা জাদুঘরের সংগ্রহশালায় ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের মুদ্রার সমৃদ্ধ সংগ্রহ রয়েছে। এগুলো সিলেটের কাস্তাবির মহল্লায় অন্বেষণের পর প্রাপ্ত বিপুল আবিষ্কার থেকে পাওয়া এবং সবই আসাম সরকার কর্তৃক দেয়া উপহার। ফখরুদ্দীনের এ মুদ্রাগুলো মুদ্রাশিল্পের অমূল্য রত্নস্বরূপ, এগুলো থেকে সোনারগাঁর সে আমলের কারিগরদের চমত্কার শিল্পনৈপুণ্যের প্রমাণ পাওয়া যায়। মুদ্রাগুলোর আকৃতি স্বাভাবিক এবং মুদ্রাগুলোর ওপরে যে উত্কীর্ণ লিপি দেখা যায় তা সুনির্মিত ও সুগঠিত। মুদ্রাগুলোর গঠন তাদের নান্দনিকতার পরিচয় বহন করে।

এগুলো দেখেও যেমন আনন্দ, পড়েও স্বস্তি পাওয়া যায়। এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে বাংলায় মুদ্রা তৈরির শিল্পে এমন নান্দনিকতা পরবর্তী সময় আর কখনই সেভাবে সাধিত হয়নি। ঢাকা জাদুঘরে বিদ্যমান ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের মুদ্রাগুলো ৭৪৩, ৭৪৫, ৭৪৬,৭৪৭, ৭৪৮ ও ৭৪৯ হিজরি সনের। এদের মধ্যে শেষোক্তটি ‘ক’ শ্রেণীর এবং বর্তমানে প্রাপ্ত ৭৪১ হিজরি সনের মুদ্রাটি ‘খ’ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত, এ মুদ্রাগুলো আলোকচিত্র যুক্ত করা হলো। এ মুদ্রাগুলোর ওজন যথাক্রমে ১৬৪ গ্রেন এবং ১৬০ দশমিক ৫ গ্রেন।

ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের ‘ক’ এবং ‘খ’ শ্রেণীর মুদ্রার মধ্যে অনেক দিক থেকেই সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। তবে কেবল একটি ক্ষেত্রে পার্থক্য আছে। পার্থক্যটা হলো ‘ক’ শ্রেণীর মুদ্রার গৌণ পিঠে এবং ‘খ’ শ্রেণীর গৌণ পিঠে উত্কীর্ণ রয়েছে। এখন পর্যন্ত ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের মাত্র তিনটি মুদ্রা পাওয়া গেছে, যেগুলো এই ‘ক’ এবং ‘খ’ শ্রেণী থেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা। এগুলো ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের অভিন্ন উত্কৃষ্ট মুদ্রাগুলোর তুলনায় নির্মাণ শৈলীতে নিম্নমানের। এ মুদ্রাগুলোর মুখ্য এবং গৌণ পিঠের নকশা এবং গৌণপিঠের কিনারার দিকের বিন্যাস ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের প্রচলিত মুদ্রার সম্পূর্ণ বিপরীত। এ মুদ্রাগুলোর দুষ্প্রাপ্যতাও রহস্যজনক।

থমাসের বক্তব্য অনুযায়ী, তিনটি মুদ্রার একটি ৭৩৭ হিজরি সনের, যেটাকে ‘গ’ শ্রেণীতে রাখা যেতে পারে। এর মুখ্য পিঠে বৃত্ত দিয়ে ঘেরা বর্গের মাঝে মুদ্রালিপি ও বৃত্তের মাঝে বিন্দু দেখা যায়, কিন্তু গৌণ পিঠ আবার ‘ক’ এবং ‘খ’ শ্রেণীর মতোই শুধু বৃত্তের মাঝে মুদ্রালিপি পাওয়া যায়। গৌণ পিঠের কিনারার লেজেন্ডের লিখনের অবস্থান ‘ক’ এবং ‘খ’ শ্রেণীর লেজেন্ডের অবস্থান হতে আলাদা।

বাকি দুটি মুদ্রাকে শিলং সাপ্লিমেন্টারি ক্যাটালগে ‘গ’ শ্রেণীতে রাখা হয়েছে, কিন্তু এখন মনে হয় ‘ঘ’ শ্রেণীতে রাখতে হবে। উভয় মুদ্রারই মুখ্য ও গৌণ পিঠ বৃত্ত দিয়ে ঘেরা বর্গ দ্বারা গঠিত এবং এ দুয়ের মাঝে বিন্দু দেখা যায়। গৌণ পিঠে লেজেন্ডের (মুদ্রা নং ২/৩৯) বিন্যাস ‘গ’ শ্রেণীর মতোই এবং ‘ক’ ও ‘খ’ শ্রেণী থেকে আলাদা।

মি থমাস তার মুদ্রাটিকে ৭৩৭ হিজরি সনের বলে মনে করলেও ব্লখম্যান এটাকে ৭৩৯ হিজরি সনের বলে রায় দিয়েছেন। শিলংয়ের মুদ্রাটির তারিখ কিংবা নামাঙ্কন কোনোটাই পড়া যায়নি, তবে এটা স্পষ্ট, মুদ্রাটিতে ৪০ সংখ্যাটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি, তাই সম্ভবত এটি ৭৪০ হিজরির আগেকার সময়কার মুদ্রা। সব মুদ্রা যদি ৭৩৯ হিজরি সনের হয়, তাহলে এটি আমাদের গৃহীত কালপঞ্জির সঙ্গে মিলে যায়, এ কালপঞ্জি অনুযায়ী ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের রাজত্বকাল শুরু হয় ৭৪০ হিজরি; কিন্তু এ মুদ্রাগুলোর সাক্ষ্যের ওপর নির্ভর করে, যা ৭৩৯ হিজরি থেকে শুরু করা যায়।

যা-ই হোক, ভবিষ্যতে প্রাপ্ত এ শ্রেণীরই কোনো নমুনা পরীক্ষা করে সন্দেহাতীতভাবে যদি প্রমাণিত হয় যে তা ৭৩৯ হিজরি সনেরও আগের, তাহলে ধরে নিতে হবে এ মুদ্রাগুলো বাহরাম খানকে সিংহাসনচ্যুত করে মুবারক শাহের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টারই আভাস। এসব মুদ্রার কারুকার্যের নিকৃষ্টতা এবং দুষ্প্রাপ্যতা প্রমাণ করে যে তার এ প্রচেষ্টার সফলতা ছিল ক্ষণস্থায়ী ও নিষ্পত্তিহীন।

আইএমসির তথ্যানুযায়ী ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের মুদ্রাগুলো ৭৪৫-৪৭-৪৮-৪৯ হিজরি সনের। শিলং-এর ক্যাবিনেটে যে মুদ্রাগুলো রয়েছে, তার সবই সোনারগাঁ টাঁকশালের নামাঙ্কিত এবং সেগুলো ৭৪০ থেকে ৭৫০ হিজরি সনের।*

থমাসের ‘কয়েনস অব দ্য পাঠান সুলতান্স অব হিন্দুস্তান’ গ্রন্থের ৮২ পৃষ্ঠায় ও ৪ নং প্লেটের ১৫১ নং চিত্রে যে মুদ্রার বিবরণ পাওয়া যায়, তা নিঃসন্দেহে ৭৫০ হিজরি সালের। তাই এটা পরিষ্কার, ৭৩৯ হিজরি সনে বাহরাম খানের মৃত্যু হলে ফখরুদ্দীন তার বাহিনীকে সংঘবদ্ধ করেন এবং ৭৪০ হিজরি সনে সিংহাসনে স্থিত হন। নানা যুদ্ধবিগ্রহের মধ্যেও তিনি ৭৫০ হিজরি পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে সোনারগাঁ শাসন করেন। এটাই সঠিক কালপঞ্জি এবং এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক যেকোনো লিখিত ইতিহাস বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে বাতিল হবে।

* পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ঢাকা জাদুঘর কর্তৃপক্ষ কিছু মুদ্রা শিলং ক্যাবিনেট থেকে সংগ্রহ করে। এর মধ্যে দুটি মুদ্রা সোনারগাঁ টাঁকশালের নামাঙ্কিত ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের এবং এগুলোয় পরিষ্কারভাবে ৭৫০ হিজরি সনের তারিখ খুদিত রয়েছে। সাপ্লিমেন্টারি ক্যাটালগে এ মুদ্রাগুলোর প্রতি খুব বেশি মনোযোগ দেয়া হয়নি, কারণ ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের শেষ মুদ্রাটিকে ৭৪৯ হিজরি সনের বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।


Exit mobile version