মেট্রোপলিস: উদ্ভাবনের অগ্রদূত


প্রথম বীজের অঙ্কুরোদগমের পর মানুষ যেদিন থিতু হওয়ার কথা ভেবেছিল, সেদিন গ্রাম কিংবা শহর কিছুই ছিল না। মানুষ যাযাবর জীবন ছেড়ে বসতি স্থাপনের পর ধীরে ধীরে গ্রাম তৈরি হয়েছিল। সেক্ষেত্রে বলা যায় গ্রামও মানুষের হাতে সৃষ্টি। কিন্তু গভীরভাবে দেখলে বোঝা যাবে মানুষের নির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই গ্রাম গড়ে উঠেছিল।

প্রয়োজনের কারণে মানুষ সংগঠিত হয়েছিল নিজেদের মধ্যে। তারপর গৃহ, খামার আর আগে থেকেই পোষ মানানো পশু নিয়ে গড়ে উঠেছিল গার্হস্থ্য। তারপর একাধিক গার্হস্থ্য মিলে গ্রাম তৈরি হলো। পরিকল্পনা এসেছিল তারও অনেক পর এবং মানুষ যত আধুনিক হতে শুরু করল, গ্রামের চেহারা বদলে গেল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হলো নতুন প্রতীতী, যার নাম হয়েছিল ‘শহর’।

শহরও অবশ্য একদিনে গড়ে ওঠেনি। বহুদিন ধরে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে। এমনকি আজ আমরা শহর বলতে যাকে বুঝি, শুরুতে এমন ছিল না। গ্রামের চেয়ে সামান্য ভিন্নতা ছিল তার। তবে শহরেরও আগে গঠিত হয়েছিল নগর এবং এখান থেকেই বলা যায় নগর মূলত নাগরিকদের সৃষ্টি। নগরের কথায় সবচেয়ে ভালো উদাহরণ ক্ল্যাসিক্যাল গ্রিস। ছোট ছোট অনেক নগর ছিল গ্রিসে আর এ কথা আজ সবাই জানে এ নগর থেকেই নানা আদর্শ, তত্ত্ব, নীতি তৈরি হয়েছিল, যা পরবর্তী সময় নগর ও নাগরিকের জীবনকে আধুনিকায়ন করে, যার কিছু প্রভাব আজো বিদ্যমান। ব্যবহারিক রাজনীতির ক্ষেত্রে অবশ্য রোম এগিয়ে ছিল। এদের উল্লেখ করার কারণ গ্রিসের তত্ত্ব আর রোমের ব্যবহারিক রাজনীতির অনেক কিছুই পরবর্তী সময় শহর ছাড়িয়ে আজকের মহানগরকে চালিত করে।

মূলত এ বিংশ শতাব্দী থেকে মহানগরীগুলো বিশ্বের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠছিল। সমাজে যখন গ্রাম তৈরি হলো, সেখানে প্রথমে কেবল বসতিই ছিল। এরপর চাষ, ফসল সংরক্ষণের কারণে আরো অবকাঠামো তৈরি হলে পরে নির্দিষ্ট একটি অঞ্চলে গ্রাম রূপ পায়। মানুষ যত আধুনিক হতে শুরু করল, প্রযুক্তি, অবকাঠামোর উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের চেহারা বদলে যে রূপ নিল, তাকে নগর বলা যায়। শহর বলতে আমরা যে চিত্র কল্পনা করি তার সঙ্গে গতি, প্রযুক্তি এবং সবচেয়ে বড় সম্বন্ধ শিল্পের। কেননা যদিও খ্রিস্টপূর্ব আড়াই হাজার অব্দে মোহেনজোদারো, হরপ্পা গড়ে উঠেছিল, আমরা একে ‘শহর’ বলি না, ‘সভ্যতা’ বলি। কিন্তু আদতে এগুলো শহরই ছিল। বরং বলা চলে, সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এরাই ছিল তখনকার মেট্রোপলিস।

তুলনামূলকভাবে শিল্পায়ন একটি আধুনিক বিষয় হলেও আজকে আমরা ‘ইন্ডাস্ট্রি’ বলে যাকে জানি, তা অনেক আগেই তৈরি হয়েছিল তত্কালীন প্রযুক্তি নিয়ে। সেসব কলকারখানার আশপাশের বসতি, অবকাঠামো আর মানুষকে নিয়ে যে ‘সিস্টেম’ তৈরি হলো তাকেই শহর বলে আমরা চিনি। এ ‘শহর’ ধারণাটির বয়স যাই হোক না, আজ আমরা শহর পেরিয়ে যে মহানগর গড়ে তুলেছি, যেখানে পৃথিবীর প্রাণ ধুকপুক করে—তাদের সঙ্গে এসব শহরের চরিত্রগত মিল আছে। অর্থাৎ আজ প্রতিষ্ঠান, প্রযুক্তি, অবকাঠামো, কলকারখানা, জীবিকার সংস্থান নিয়ে যাকে মেট্রোপলিস বলি; এককালে রোম, ব্যাবিলন, বাগদাদে তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

আজকের টোকিয়ো, ম্যানহাটন, নিউইয়র্কের মতো চকচকে ছিল না সেকালের মহানগর। প্রযুক্তি ও অর্থ আমাদের ক্রমেই নতুন করে পোক্ত ভিতের ওপরে অবকাঠামো তৈরি করার সুযোগ দিয়েছে এবং আমরা তা ব্যবহার করছি। আগেও এমন করেই নগর বদলে গিয়েছিল শহরে। সিন্ধু নদের অববাহিকায় মোহেনজোদারো কিংবা ইউফ্রেতিসের তীরে ব্যাবিলন; প্রকৃতির যে অংশে মানুষ নিজেদের অনুকূল পরিবেশ পেয়েছে, সময়ের সর্বোচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেখানেই শহর তৈরি করেছে। আধুনিকতা, উন্নত জীবনের আশায় তখন ওই নির্দিষ্ট অঞ্চলের আশপাশ থেকে আরো মানুষ ছুটে এসেছিল। যেমন সিন্ধু অববাহিকার সেই সভ্যতার উদাহরণ থেকেই আমরা দেখি পরিকল্পিত এক শহর তারা গড়ে তুলেছিল নির্দিষ্ট সীমার মাঝে। ব্যাবিলনেও এর চেয়ে ভিন্ন কিছু হয়নি।

মেট্রোপলিসগুলোর অন্যতম এক বৈশিষ্ট্য হলো সে সব জাতি, ধর্ম, বর্ণ, রাজনৈতিক মত, অর্থনৈতিক অবস্থার মানুষকে বুকে টেনে নেয়। আধুনিক সামাজিক বিজ্ঞানের আলোচনায় শিকাগো স্কুলের একটি আলোচনায় দেখা গেছে আমেরিকায় স্থানীয় সীমারেখার বাইরে অন্য অনেক মানুষের অন্তর্ভুক্তি সেখানকার শিল্প ব্যবস্থাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলছে। মূলত এ একই ঘটনা ঘটেছে মানুষের ইতিহাসের সব জনপ্রিয় নগরে। মোহেনজোদারো, হরপ্পা, ব্যাবিলন, রোমের সীমানার বাইরে থেকে আসা নতুন মানুষদের বুদ্ধি, শ্রমও কাজে লেগেছিল এসব শহরের গঠনে। বরং বলা যায় ততদিনে গঠিত শহরকে আরো বর্ধিত করেছিল এ মানুষরা। ফলে শহর আরো সমৃদ্ধ হয়েছে, বৃদ্ধি পেয়েছে বৈচিত্র্য, বিস্তৃত হয়েছে ভৌগোলিক সীমানা এবং এ পর্যায়েই শহর কিংবা নগর থেকে সে মহানগরে পরিণত হয়।

নগর কিংবা শহরের ‘মহানগর’ হয়ে ওঠা মূলত একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। বলা চলে এ এমন এক প্রক্রিয়া, যেখানে শহর নিজেই নিজেকে মহানগর করে তোলে, যেখানে মানুষ কেবল কাজ করে চলে এবং এক সময় সে আবিষ্কার করে যে তার শহরটা ‘মহানগর’ হয়ে উঠেছে। যেমন আমরা যদি ঢাকার কথাই চিন্তা করি, ঢাকার ৪০০ বছরের ইতিহাসের প্রয়োজন নেই, গত ৪০ বছরে অবকাঠামো থেকে শুরু করে এ শহরের মানুষ, জীবনযাত্রা, চরিত্র সব বদলে গেছে। আজকে অনেক প্রৌঢ় কিংবা বৃদ্ধকে বলতে শোনা যায়, ‘শহরটা কেমন করে বদলে গেল, কিছু টেরই পেলাম না।’ অথচ শান্ত একটা সাধারণ শহর থেকে উঁচু উঁচু দালান, পাকা সড়ক, দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠানের অফিস আর নানা জাতের মানুষের জীবিকার উৎস হয়ে ওঠা এ শহরের মহানগর হয়ে ওঠার পেছনে এ মানুষরাই কাজ করেছে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে।

আধুনিক মেট্রোপলিস হিসেবে আমরা যদি নিউইয়র্ক, মুম্বাই, মস্কো, টোকিয়ো, লন্ডন, আমস্টারডাম, সিডনির কথা চিন্তা করি, তাহলে দেখব এ মহানগরীগুলো বৈশ্বিক যোগাযোগ, রাজনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রাণকেন্দ্র। মানুষের জীবনে মহানগরীর প্রভাব মূলত এখানেই। প্রতিটি মেট্রোপলিস মানুষকে ধারণ করার পাশাপাশি মানুষের এগিয়ে যাওয়ার পথকে প্রশস্ত করে। আধুনিক মহানগরীগুলো ছেড়ে মহানগরীর প্রাচীন ইতিহাসের দিকে তাকালেও একই চিত্র দেখা যাবে। সিন্ধু সভ্যতার সময় আশপাশের অঞ্চলের মানুষ বাণিজ্যের জন্য এসে জুটত সেখানে। এথেন্সের নানা তত্ত্ব আজো আমাদের পথ দেখিয়ে চলে। মধ্যযুগে বাগদাদ হয়ে উঠেছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রাণকেন্দ্র। এশিয়া, ইউরোপ থেকে জ্ঞানপিপাসুরা গিয়ে পাড়ি জমাতেন বাগদাদে। সেখানেই তৈরি হয়েছে আলকেমি, অ্যালজেবরা এমনকি চিকিৎসা শাস্ত্রের নানা উন্নতি। আলেকজান্দ্রিয়ার পাঠাগারের ইতিহাস আজকে আমরা সবাই কমবেশি জানি। মহানগর মানুষকে বারবার আকর্ষণ করেছে এভাবেই। মানুষ ছুটে ছুটে গেছে সেখানে। আর মহানগর তার ঝুলি থেকে সভ্যতার জন্য বের করে দিয়েছে নানা উপহার।

কোনো মহানগরের গৌরব প্রচারিত হলে আরো মানুষ সেখানে ছুটে আসে। যেমন কুবলাই খানের সভায় নানা দেশের নানা মতের মানুষ জড়ো হয়েছিলেন বলেই তিনি চীনকে নতুন করে গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। মোগল আমলে দিল্লি-আগ্রার সমৃদ্ধির কথা শুনে ইউরোপ থেকে ছুটে এসেছিল পর্যটক, বণিকের দল। একটু একটু করে তাদের মত, পরিকল্পনা, সংস্কৃতি মিশে গিয়েছিল দিল্লিতে। মহানগরের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর বৈচিত্র্য। এখানে নানা ধর্ম, বর্ণ, পেশা আর মতের মানুষ থাকবে। মহানগরীকে মানুষ গড়ে তুলেছিল যেন তাদের নানা মত, আবিষ্কার, সংস্কৃতিকে জড়ো করে মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। তাই আমরা দেখি বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজ, রাজনীতির যত বড় বড় আবিষ্কার তা মেট্রোপলিস থেকেই হয়েছিল। মানুষের প্রতি মেট্রোপলিসের অন্যতম দান হলো এ বহু স্থানের জ্ঞান-বিজ্ঞান একত্রিত করা এবং অধিবাসীদের মধ্যে বণ্টন। অর্থাৎ মহানগরে জমা হওয়া জ্ঞান মানুষ ব্যবহার করেছিল। কখনো সে জ্ঞান ছিল সক্রেটিসের, কখনো নিউটনের। কখনো পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন হারুন আল রশিদ, কখনো আব্রাহাম লিঙ্কন। মূলত যত আবিষ্কার, তা ছিল মহানগরকেন্দ্রিক। অবশ্য খোদ মহানগর যে মানুষের এক বড় আবিষ্কার, তা হয়তো মানুষই খেয়াল করেনি।

মেট্রোপলিস আধুনিক এবং প্রতিটি মেট্রোপলিস আধুনিকতায় নতুন পর্ব যুক্ত করেছে। মানুষ বারবার যে মহানগরের দিকে ছুটে যায়, তার কারণ হলো মহানগরীর বৈশিষ্ট্যই হলো মানুষকে এগিয়ে নেয়া। পৃথিবীর বড় বড় শহর শিল্পী, সাহিত্যিকদেরও তৈরি করেছে। ডিকেন্সের লেখায় যে লন্ডন আমরা দেখি, সেই লন্ডনই ডিকেন্সকে তৈরি করেছিল। ডাবলিনকে নিয়ে লিখে গেছেন জয়েস। দস্তয়েভস্কির উপন্যাসে আমরা সেন্ট পিটার্সবার্গকে পাই। সত্যজিৎ রায় তার ক্যামেরায় যে কলকাতাকে ধরেছেন, ‘জন অরণ্যে’র সেই ‘মহানগর’ই সত্যজিৎকেও তৈরি করেছিল। মানুষের প্রয়োজনের প্রায় সবকিছু আছে একেকটি মেট্রোপলিসে। আধুনিক প্রযুক্তিভিত্তিক জীবনে মেট্রোপলিসের প্রভাব থেকে বাইরে থাকা কঠিন, এমনকি আজ থেকে বহু আগে বিজ্ঞানী রবার্ট হুক শহরে এসে বক্তৃতা দিতেন, কেননা শহরেই শ্রোতা বেশি পাওয়া যেত। এমনকি বিশ্বের ওপর ক্ষমতার ছড়িও মেট্রোপলিস থেকে ঘোরে—তা সে মস্কোকেন্দ্রিক হোক কিংবা ওয়াশিংটন ডিসি। ষোড়শ শতাব্দীতে রাজা পঞ্চম চার্লস বলেছিলেন, ‘আমি লিসবনের রাজা হলে সারা পৃথিবী শাসন করতে পারতাম।’

তবে মেট্রোপলিস নিয়ে অভিযোগেরও শেষ নেই। সে ক্রমেই গ্রাস করে নিচ্ছে গ্রাম, প্রকৃতি আর তার গতির কারণে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের সুকুমারবৃত্তি—এ অভিযোগ পুরনো। তার পরও মানুষ মেট্রোপলিসের স্বাচ্ছন্দ্যই বেছে নিয়েছে। ফলে দিনকে দিন এর সীমানা বেড়ে চলেছে। উপশহর, এমনকি উপশহরের বাইরের অংশেও মেট্রোপলিসের প্রভাবে নগরায়ণ হচ্ছে।

অনেকেরই ধারণা পুরনো মেট্রোপলিসগুলো হয়তো পরিকল্পনা নিয়ে গড়ে ওঠেনি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো অনেক আধুনিক মেট্রোপলিসের চেয়ে প্রাচীন মহানগরগুলো অনেক বেশি পরিকল্পিত ছিল। মোহেনজোদারো, হরপ্পা, ব্যাবিলন, রোম, বাগদাদ, আলেকজান্দ্রিয়া এমনকি শাহজাহানাবাদের পরিকল্পনার দিকে দৃষ্টি দিলেই তা স্পষ্ট হয়।

উল্লেখিত প্রতিটি শহরই তার নিজ নিজ সময়ের মেট্রোপলিস এবং আজকের নিউইয়র্ক, লন্ডন, মেক্সিকো সিটি, দিল্লি বা ঢাকার চেয়েও হয়েতো অনেক বেশি পরিকল্পিত ছিল প্রতিটি। আবাসনের পাশাপাশি কারখানা, বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পয়োনিষ্কাশন সব বিষয়েই সুষ্ঠু ব্যবস্থা ছিল। হারুন আল রশিদের বাগদাদ, নেবুচাদনেজারের ব্যাবিলন, সাইরাসের পারস্য সবই পরিকল্পিত ছিল। প্রতিটি মেট্রোপলিস নানা সময়ে ধ্বংস হয়েছে, আবার পুনর্গঠিত হয়েছে। মহামারী, অতিমারী বাদেও একেকটা শহর পদানত হয়েছে বারবার। বাগদাদে হালাকু খান, দিল্লিতে নাদির এবং আবদালীর আক্রমণের পরও শহরগুলো টিকে আছে। কনস্ট্যান্টিনোপল বিজিত এবং পুনর্গঠিত হয়েছে বারবার। তৃতীয় নেপোলিয়নের সময়ে প্যারিসের পুনর্গঠন এখনো কিংবদন্তি হয়ে আছে।

একেকটি মেট্রোপলিস মানুষকে হাতছানি দিয়ে দিয়ে ডাকে। প্রযুক্তি, সেবা, উন্নত জীবনের আশা আর অর্থনৈতিক সুযোগের কারণে মানুষের মহানগরে আগমনের স্রোত নতুন নয়। কিন্তু এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে মেট্রোপলিসে থাকার জন্য মানুষ বস্তিতে থাকতেও রাজি। বিশেষত তৃতীয় বিশ্ব কিংবা উন্নয়নশীল দেশগুলোর একেকটি মেট্রোপলিসে আকাশছোঁয়া অট্টালিকার পেছনেই বস্তি দেখা যাবে এবং এখানে বসবাসকারীরা অনেকেই সুখী, কেননা তারা মেট্রোপলিসে আছেন এবং মহানগরের অনেক সুখ-সুবিধা ভোগ করতে পারছেন। পৃথিবীর একেকটি মহানগর এমনই মোহজাগানিয়া যে মানুষকে টেনে আনে এবং ধরে রাখে। মনে হতে পারে এ বক্তব্য আসলে তৃতীয় বিশ্বের মানস উপস্থাপন করে কিন্তু আমরা মাইকেল ক্যানিংহামের ১৯৯৮ সালের উপন্যাস ‘দি আওয়ার্স’ অবলম্বনে তৈরি ডেভিড হেয়ারের সিনেমায় শুনি ভার্জিনিয়া উলফ বলছেন, ‘আমি শহরের বাইরের অনুভূতি শূন্যতার মাঝে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে বসবাসের চেয়ে শহুরে ভিড় বেছে নেব।’

মেট্রোপলিসের এ আবেদন কখনো কমেনি, হয়তো অদূর ভবিষ্যতে কমবেও না। আরো একটি জরুরি কথা, প্রতিটি মহানগর নিজের এবং তার নাগরিকদের এমনকি কখনো কখনো ওই জাতির ইতিহাসের পরিবর্তনও ধারণ করে। ইউনিভার্সিটি অব ইয়র্কের প্রফেসর স্যাম ওয়েদারল তার ‘ফাউন্ডেশনস’ বইয়ে লেখেন, ‘ব্রিটিশ শহরের কোনো এক টাওয়ার ব্লকের ২৭ তলার সিঁড়িতে ফ্লুরসেন্ট বাতির নিচে দাঁড়িয়ে, সাম্প্রদায়িক আবর্জনা পেছনে রেখে পুরু কাচের ওপারে আকাশের দিকে তাকালে ইতিহাসের পূর্ণতা এবং গতি পরিবর্তন বোঝা যায়।’

স্যাম কেবল ব্রিটিশ শহরের কথা বলেছেন কিন্তু পৃথিবীর যেকোনো মেট্রোপলিসের জন্যেই এ কথা সত্য। একেকটি মহানগরীর ইমারত, রাজপথ, মানুষ আর তার আবহের মধ্যেই সেই মহানগরীর ইতিহাস লুকিয়ে থাকে। ঠিক কীভাবে সে গড়ে উঠেছিল, মানুষকে কতটা ধারণ করেছে, চরিত্র কীভাবে বদলে গেছে, সভ্যতায় তার কী অবদান; সবই থাকে মেট্রোপলিসের বাতাসে। বর্তমানের চাকচিক্য আর একবিংশ শতাব্দীর মেট্রোপলিসের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য—মানুষের ছুটে চলা—তার মধ্যে খানিক দাঁড়িয়ে যদি মেট্রোপলিসের বুকে কান পাতা যায়, তাহলে হয়তো জানা যাবে মেট্রোপলিস ছিল মানুষের সবচেয়ে বড় আবিষ্কারের একটি, যার বুকে দাঁড়িয়ে সে অনেক অসাধ্য সাধন করেছে।

 

মাহমুদুর রহমান: লেখক


শর্টলিংকঃ