মোদীর বিরুদ্ধে মমতার মারকুটে মেজাজ


 

 মোদীর বিরুদ্ধে মমতার মারকুটে মেজাজ : আসলেই লাভ-ক্ষতি কার?  নির্বাচনের দিন আজ।  মমতা- মোদির নির্বাচনী টানাপড়েন নিয়ে ভারত থেকে লিখেছেন গোলাম রাব্বানী-

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিন দিন নরেন্দ্র মোদী ও ভারতীয় জনতা পার্টি-বিজেপির বিরুদ্ধে সুর চড়াচ্ছেন। আক্রমণের তীক্ষ্ণতা সময়ে সময়ে ব্যক্তিগত সীমা ছাড়িয়ে তো যাচ্ছেই, অনেক সময়ে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রীর বক্তব্যের আসল কথা বুঝে ওঠাও যাচ্ছে না।  শুধু বোঝা যাচ্ছে যে তিনি মোদীর বিরুদ্ধে তর্জন-গর্জন একটুও কমাতে রাজি নই। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তাঁর ভাষার প্রয়োগ যে সবসময় রুচিশীল তা বলা যাবে না, কিন্তু মমতা জানেন যে তাঁর নিজের সমর্থককূলকে চাঙ্গা রাখতে তা টনিকের মতোই কাজ করছে আর করতে থাকবে।

ধুরন্ধর রাজনীতিবিদ মোদী সেটা জানেন। আর তাই “মমতা আমাকে কুর্তা, মিষ্টি পাঠিয়েছেন” বলে বেশ এক গেইম খেলে ফেলেছেন; উদ্দেশ্য একটাই তৃণমূল নেত্রীর সমালোচকদের উস্কে দেওয়া এবং তাদের মুখ থেকে বলানো যে “দ্যাখো, দিদি মুখে মোদীকে তুলোধোনা করলেও আড়ালে আবডালে ভালোই সম্পর্ক রেখেছেন।” ভারতের ভোটারদের কাছে এই সমস্ত ঘটনার আবেদন যে নেহাত কম বড় নয়, তা মোদী ভালোই বোঝেন আর তাই মমতা যত চিৎকার জুড়ছেন, তিনি ততই ঠান্ডা মাথায় পাল্টা চাল দিচ্ছেন।

তবে একথাও সত্য, এত গুলো রাজ্যের এত নেতার ভীড়ে সরাসরি মোদিকে আক্রমনাত্মক বক্তব্য দিয়ে পুরো ভারতে লাইম লাইটে খুব সহজেই মমতা জায়গা করে নিয়েছেন।

“অহেতুক মমতা এবারের লড়াইটিকে কঠিন করছেন” দিদির প্রতি মোদীর এই কৌশলী রাজনৈতিক চালাচালির কথা বুঝতে পারলেও যেটা বোধগম্য হয় না সেটা হল মমতা কেন অবিরাম মোদীকে আক্রমণ করে চলেছেন। মমতার একথা বোঝা দরকার যে হাজার হলেও মমতার দ দলটি একটি আঞ্চলিক শক্তি যাদের পক্ষে একা কেন্দ্রে কিছু করে ওঠা সম্ভব নয়। কিন্তু তবু তাঁর মনে হচ্ছে এবারে কেন্দ্রে সরকার গড়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নেবে উত্তরপ্রদেশ ও বাংলা।

আশি লোকসভা আসনের উত্তরপ্রদেশের কথা তাও না হয় মানা গেল কিন্তু বাংলা কীসের নিরিখে এই বিশ্লেষণে আছে? মমতা কি এবারের নির্বাচনে একটু বেশি আকাঙ্খী হয়ে উঠেছেন আর তার ফলে এই মরিয়া ভাবমূর্তি?

২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালেও মমতার ইচ্ছে ছিল রাষ্ট্রীয় স্তরে বড় ভূমিকা পালন করার কিন্তু আন্না হাজারের শেষ মুহূর্তের ডিগবাজি তৃণমূল নেত্রীর সেই আকাঙ্খাকে ধুলিস্মাৎ করে । ব্যাপারটি কম অসম্মানসূচক ছিল না আর তাই হয়তো এবারে মমতার আরও মারকাটারি মেজাজ নিজের রাজ্যের মুসলমান ভোটটিকে দখলে রাখতেও যে মমতার অনবরত মোদীর মুণ্ডুপাত করে চলা, তাও বুঝতে অসুবিধে হয় না।

এদিকে মমতা দাঙ্গা নিয়ে কেন কথা বলেন যেখানে ২০০৪-এ ফিরে গিয়েছিলেন এনডিএ-তে। কিন্তু প্রশ্নটি হল, মমতা তাঁর যা বলার রয়েছে মোদীর সম্পর্কে, তা তো শুধুমাত্র সুচিন্তিত ও সাবলীল ভাষাতেও বলা যায়। কিন্তু উনি যা বলেন তাতে ছেলেমানুষির ছোঁয়াই যেন বেশি। ধরা পড়ে হোমওয়ার্কের ঘাটতিও।

মোদীকে দাঙ্গার জন্যে অভিযুক্ত করে ‘গোধরা ভুলে গিয়েছ?’ বলে কটাক্ষ করলে সেই কটাক্ষ তাঁরই দিকে ফিরে আসে। কারণ, ২০০২ সালে ঘটে যাওয়া সেই নরসংহারের দু’বছর পরেও মমতা বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ-তে যোগ দেন কেন্দ্রে; মন্ত্রীও হন। তিনি যদি সত্যিই এই ব্যাপারে অন্যকে মোদী-বিরোধী অবস্থান নিতে পরামর্শ দেন, তবে তাহলে তাঁকে আগে এই ব্যাখ্যা দিতে হবে যে তিনি তাহলে সেই বিজেপি সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন কেন?

আসলে মনে হচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই নির্বাচনী লড়াইতে একটু বেশিই মরিয়া হয়ে উঠে নিজের উপরে চাপ বাড়াচ্ছেন। কিন্তু যেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে মোদী এবং তাঁর সরকারের মোকাবিলা করার জন্যে তিনি বেশি গভীরে ঢুকতে নারাজ; প্রশাসনিক নিরিখেও লড়াই করতে তাঁর অনীহা। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর নিজের আট বছর হয়ে যাওয়ার পরে মমতা প্রশাসক হিসেবে মোদীর প্রতিপক্ষ হতেই পারতেন কিন্তু তিনি সেসবের ধার না ধেরে শুধুমাত্র রাজনীতি ও ধর্মের সমন্বয়ে একটি এজেন্ডা তৈরী করে মোদীকে আক্রমণ করতেই থাকেন।

শুধু গলার জোরে বিজেপিকে হারানো যাবে কি?
হয়তো রাজনীতিতে মোদীর চেয়ে সিনিয়র হওয়ার সুবাদে মমতা প্রধানমন্ত্রীর তখ্তটিকে নিশানা করেছেন আরও বেশি করে। সারা দেশের সামনে নিজেকে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির এক আদর্শ বিকল্প হিসেবে দাঁড় করাতে চাইছেন, কিন্তু তিনি যাই ভেবে থাকুন না কেন, কেন্দ্রে ক্ষমতা জিততে গেলে দেশব্যাপী সংগঠন ছাড়াও বিকল্প ভিশন এবং দেশসুদ্ধ ভোটারদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে হয়।

সেইসব বিচারে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী কতটা এগিয়ে রয়েছেন? আর সেই উত্তর জানেন বলেই কি তিনি শুধুমাত্র গলার জোরে বিজেপিকে হারাতে চাইছেন? কথা হল, সারা দেশের মনের কথা কি তিনি শুধুমাত্র কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনে বসেই বুঝতে পারছেন?

গোলাম রাব্বানী :  সাংবাদিক (মাছরাঙা টিভি)


শর্টলিংকঃ