মোহনপুরে দু’বছরে ফসলি জমি কমেছে ১১০০ হেক্টর


রিপন আলী, মোহনপুর(রাজশাহী):

কৃষি অধ্যুষিত জেলা রাজশাহীর সবচেয়ে ছোট আয়তনের উপজেলা মোহনপুর। এখানে ধান, পান, গম ও আমের চাষ হয় সবচেয়ে বেশি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী- ২০১৬ সালে মোহনপুরে ফসলি জমি ছিল ১২ হাজার ৪৩২ হেক্টর। তবে ২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী তা কমে দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৩২০ হেক্টরে।

স্থানীয় কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তারা অভিযোগ করেন, উপজেলাজুড়ে বাণিজ্যিক পুকুর খননের কারণে কমছে ফসলি জমি। জোর করে কৃষকদের কাছ থেকে জমি নিয়ে পুকুর খনন করছে প্রভাবশালী একটি মহল। পুকুর খননকারীরা মাঠের মাঝামাঝি স্থানের কোনো জমি টার্গেট করেন। সেই জমির মালিককে অর্থের প্রলোভনে জমি কব্জা করেন। ওই জমিতে পুকুর খনন শুরু করলে তখন বাধ্য হয়ে আশেপাশের কৃষকরাও তাদেরকে জমি দিয়ে দেন।

কৃষকদের অভিযোগ- তারা এ বিষয়ে কৃষিবিভাগ ও বরেন্দ্র বহমুখী প্রকল্পসহ (বিএমডিএ) স্থানীয় প্রশাসনকে লিখিত অভিযোগ দিলেও কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ফলে বর্ষা মৌসুমে উঁচু জমির ফসলহানির পাশাপাশি জলাবদ্ধতার ঝুঁকিতে রয়েছে তিন শতাধিক বাড়িঘর।

এদিকে, গত ১০ মার্চ উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী অবৈধভাবে ফসলি জমিতে পুকুর খনন বন্ধ করতে একটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সানওয়ার হোসেন। এরপরও থেমে নেই প্রভাবশালী মহলের পুকুর খনন।

স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি মৌসুমে যেসব পুকুর খনন শুরু করা হয়েছে, তা শেষ হলে ফসলি জমি কমবে আরও ৭০০ হেক্টর। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৫ থেকে ৭ বছরের মধ্যে উপজেলায় ফসলি জমির অস্তিত্ব থাকবে না।

বৃহস্পতিবার (২০ জুন) উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে দেখা যায়, অন্তত দশটি পুকুর খননের কাজ পুরোদমে চলছে। দিনরাত প্রায় ২৪ ঘণ্টায় এক্সকেভেটর দিয়ে মাটি কাটার কাজ চলছে। প্রতিটি পুকুরের আয়তন ২০ বিঘা জমি থেকে ৮০ বিঘা পর্যন্ত রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেশরহাটের পৌর এলাকার মগরা বিলে আলমগীর হোসেন, ধুরইল বিলে বাবু ও লিখন, বিদ্যাধরপুর বিলে শাফিউল আলম, তেঘর মাড়িয়া বিলে এনামুল হক ও রানা হোসেন এবং শিবপুর বিলে নাজমুল হোসেন জমি লিজ নিয়ে পুকুর খননের কাজ করছেন।

তারা সবাই স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ ও ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বিএনপি ও জামায়াতের কিছু নেতাও বেশি টাকা দিয়ে এদের সঙ্গে শেয়ারে পুকুর খননে যুক্ত হচ্ছেন। ফলে অনেক সময় পুকুর বন্ধে মাঠে নেমে ব্যবস্থা নিতে গেলেও রাজনৈতিক প্রভাবে নিস্ফল ফিরে আসতে হচ্ছে প্রশাসনিক কর্তাদের।

উপজেলার বাকশৈল গ্রামের কৃষক আব্দুর রহমান, সাদেকুর রহমান ও রাশেদুল ইসলাম ইউনিভার্সাল২৪নিউজ-কে জানান, উপজেলার কয়েকটি বিলে তিন ফসলি জমিতে পুকুর করে আবাদি জমি প্রায় শেষ। খালের মাঝে পুকুর খনন করে বাঁধ দেওয়ায় পানি বের হয় না। জলাবদ্ধতায় ধান নষ্ট হয়ে যায়। গত মৌসুমে কৃষকের দুর্দশা দেখে এমপি আয়েন উদ্দিন নিজে পানিতে নেমে পুকুরের পাড় কেটে পানি বের করার ব্যবস্থা করেন। কয়েকদিন পরে পুকুর মালিকরা আবার পাড় বেঁধে দেন। বারবার তো আর এমপি আসতে পারবেন না। তাই বাধ্য হয়ে অনেকে তাদেরকে (পুকুর খননকারী) জমি দিয়ে দিচ্ছেন।

জানতে চাইলে পুকুর খননকারী আলমগীর হোসেন ও এনামুল হক দাবি করেন, চাষাবাদ ভালো না হওয়ায় জমির মালিকরা ডেকে পুকুর খননের জন্য জমি দিচ্ছেন। কৃষকদের জমির খাজনা পরিশোধের পাশাপাশি সাংবাদিকসহ স্থানীয় প্রশাসনকেও ম্যানেজ করতে হয়। অল্প জমিতে পুকুর খননে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। একসঙ্গে বেশি জমি হলে ভালো হয়।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রহিমা খাতুনইউনিভার্সাল২৪নিউজ-কে বলেন, ‘মোহনপুর ছোট আয়তনের একটি উপজেলা। এখানে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পরিমাণ পুকুর খনন করা হচ্ছে। ফলে কৃষি ভূমির পরিমাণ দিন কমে আসছে। হুমকির মুখে পড়ছে এখানকার প্রধান ফসল পান ও ধানের চাষ। এ ধরনের পুকুর খনন বন্ধের জন্য প্রতিনিয়ত কাজ করে আসছে উপজেলা কৃষিবিভাগ ও উপজেলা প্রশাসন।

মোহনপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুস্তাক আহমেদ ইউনিভার্সাল২৪নিউজ-কে বলেন, ‘পুকুর খননের খবর পেলেই আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে বন্ধ করছি। তারা রাতের আঁধারে পুকুর কাটছে, ফলে প্রতিরোধ করা মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সঙ্গে কিছুটা রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে।’

তবে অবৈধ পুকুর খনন বন্ধে পুলিশ তৎপর রয়েছে বলেও দাবি করেন ওসি।


শর্টলিংকঃ