যে কারণে অফিস খুলছে না ফেসবুক গুগল অ্যামাজন


ইউএনভি ডেস্ক: 

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তিনটি ধারার কারণে বাংলাদেশে অফিস খুলে ব্যবসা করতে আসছে না ফেসবুক, গুগল, অ্যামাজনের মতো বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান। যদিও অ্যামাজন ২০১৯ সালে বাংলাদেশে কোম্পানি নিবন্ধন করেছে এবং ফেসবুক সম্প্রতি ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে অফিস না খোলার ব্যাপারে তারা অনড় রয়েছে।

এমনকি এ তিনটি ধারার কারণে বাংলাদেশে বিশ্বমানের টায়ার ফোর ডাটা সেন্টার স্থাপন করা হলেও সেটি ব্যবহার করছে না কোনো বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানই। সংশ্নিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সমকালকে এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সুমন আহমেদ সাবির।

সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র আরও জানিয়েছে, গুগল, ফেসবুক, অ্যামাজনের মতো প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তিনটি ধারা এবং আইনটির বিধিবদ্ধ সাংগঠনিক প্রয়োগ ব্যবস্থার অনুপস্থিতির কারণে বাংলাদেশে দূর থেকেই ব্যবসা পরিচালনা করতে আগ্রহী। এ মুহূর্তে তাদের ফোর টায়ার ডাটা সেন্টার ব্যবহারেরও কোনো পরিকল্পনা নেই।

সমকালের প্রশ্নের জবাবে ফেসবুকের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, বাংলাদেশে অফিস স্থাপনের কোনো পরিকল্পনা এ মুহূর্তে তাদের নেই। আর ফেসবুক প্রগতিশীল আইনের প্রয়োগকেই সমর্থন করে। বাংলাদেশে আরও নিরাপদ ব্যবহারে নীতিগত ক্ষেত্রে উন্নয়নেও সহায়তা দিচ্ছে ফেসবুক। ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার সমকালকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশে যে কোনো প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করতে পারে, কিন্তু দেশের আইন মানতে হবে। বিভিন্ন দেশের স্থানীয় আইন না মেনে ফেসবুক, গুগল, অ্যামাজনের মতো প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা করার সুযোগ দিন দিন সীমিত হয়ে আসছে। বরং তারাও বুঝতে পারছে, প্রতিটি দেশের আইন মেনেই ব্যবসা করতে হবে।

যে তিনটি ধারা নিয়ে আপত্তি: সংশ্নিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩৫, ৩৬ ও ৪৩ ধারা নিয়েই আশঙ্কা বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলোর। আইনের ৩৫ ধারায় অপরাধ সংঘটনে কোনো ব্যক্তি সহায়তা করলে তাকেও মূল অপরাধীর সমান দণ্ড দেওয়ার বিধান রাখা রয়েছে। এ ধারায় কীভাবে সহায়তা করা, প্রত্যক্ষ না পরোক্ষ এবং সুনির্দিষ্টভাবে সহায়তা করার অর্থ কী বোঝায়- তা বলা হয়নি।

আইনের ৩৬ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো কোম্পানি কর্তৃক এই আইনের অধীন কোনো অপরাধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংশ্নিষ্টতা রয়েছে এমন ক্ষেত্রে ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক, প্রধান নির্বাহী, পরিচালক, ম্যানেজার, সচিব, অংশীদার বা অন্য কোনো কর্মকর্তা বা প্রতিনিধি অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবে- যদি না তিনি প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে, এই অপরাধ তার অজ্ঞাতসারে হয়েছে বা ওই অপরাধ রোধ করার জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন।

আর ৪৩ ধারায় বিনা পরোয়ানায় পুলিশকে তল্লাশি, গ্রেপ্তার এবং জব্দ করার ক্ষমতা দিয়ে বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো পুলিশ অফিসারের এইরূপ বিশ্বাস করার কারণ থাকে যে, কোনো স্থানে এই আইনের অধীনে অপরাধ সংঘটিত হইয়াছে বা হওয়ার সম্ভাবনা রহিয়াছে, কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণাদি হারানো, নষ্ট হওয়া, মুছিয়া ফেলা, পরিবর্তন বা অন্য কোনো কারণে দুষ্প্রাপ্য হইবার বা করিবার সম্ভাবনা রহিয়াছে, তাহা হইলে তিনি অনুরূপ বিশ্বাসের কারণ লিপিবদ্ধ করিয়া নিম্নবর্ণিত কার্যসম্পাদন করিতে পারিবেন। এগুলো হচ্ছে, উক্ত স্থানে প্রবেশ করিয়া তল্লাশি এবং প্রবেশে বাধাপ্রাপ্ত হইলে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, উক্ত স্থানে তল্লাশিকালে প্রাপ্ত অপরাধ সংঘটনে ব্যবহার্য কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, তথ্য-উপাত্ত বা অন্যান্য সরঞ্জাম এবং অপরাধ প্রমাণে সহায়ক কোনো দলিল জব্দকরণ, উক্ত স্থানে উপস্থিত যে কোনো ব্যক্তির দেহ তল্লাশি এবং উক্ত স্থানে উপস্থিত কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ করিয়াছেন বা করিতেছেন বলিয়া সন্দেহ হইলে উক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার।’

এ তিনটি আইন সম্পর্কে বিশ্বখ্যাত তিনটি প্রতিষ্ঠানের আশঙ্কার কারণ ব্যাখ্যা করে সুমন আহমেদ সাবির বলেন, অপরাধ সংঘটনের সহায়তার জন্য সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা না থাকার কারণেই আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। ধরা যাক, বাংলাদেশে অ্যামাজন কোনো বাণিজ্যিক সার্ভার প্রতিষ্ঠা করল। সেখানে কোনো ব্যক্তি জায়গা ভাড়া নিয়ে তথ্যাদি রাখল। এখন এ তথ্য কোনো অপরাধ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে চিহ্নিত হলো। এ ক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এ ধারার মাধ্যমে অ্যামাজনকে তথ্য রাখতে দেওয়ার কারণে ‘অপরাধ সংগঠনে সহায়তার অপরাধে’ এবং কোম্পানি কর্তৃক অপরাধের ধারা ব্যবহার করে অভিযুক্ত করা যেতে পারে। এটা অবশ্যই সংশ্নিষ্ট কোম্পানিগুলোর জন্য উদ্বেগের কারণ। এ ছাড়া পরোয়ানা ছাড়াই পুলিশকে সন্দেহবশত তল্লাশি, জব্দ এবং গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া আরও বড় উদ্বেগের কারণ। ফলে তারা বাংলাদেশে অফিস খোলার কোনো চিন্তাই আপাতত করছে না।

ফোর টায়ার ডাটা সেন্টারের প্রসঙ্গ তুলে তিনি জানান, বাংলাদেশে যখন টায়ার ফোর ডাটা সেন্টার নির্মাণ করা হয়, তখন গুগল, ফেসবুক, অ্যামাজনের কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়া হয়। এ কার্যক্রমের সঙ্গে তিনিও যুক্ত ছিলেন। তিনটি প্রতিষ্ঠানের পরামর্শ অনুযায়ীই ডাটা সেন্টারের কাঠামো তৈরি করা হয়। কিন্তু গুগল ও অ্যামাজনের উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে একাধিকবার আলাপকালে তারা তাকে জানান, বাংলাদেশে টায়ার ফোর ডাটা সেন্টার নির্মাণে তারা উৎসাহিত হয়েছিলেন। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এই ধারাগুলোর কারণে তারা টায়ার ফোর ডাটা সেন্টার ব্যবহারে একেবারেই আগ্রহী নন। ফলে বিপুল ব্যয়ে নির্মিত বিশ্বমানের এই ডাটা সেন্টার কার্যত অব্যবহূত অবস্থাতেই পড়ে আছে।

সুমন আহমেদ সাবির আরও বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে আরও একটা সমস্যা হচ্ছে, এটি প্রয়োগে কোনো বিধিমালা এখন পর্যন্ত নেই। আইনের আওতায় যে সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তোলার কথা ছিল, সেটাও হয়নি। ফলে আইনটির প্রয়োগে প্রকৃতপক্ষে যথেচ্ছচার হয়ে যাচ্ছে। এটাও বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্বেগের কারণ।

এ ব্যাপারে সংশ্নিষ্ট অপর একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, এ মুহূর্তে ভারতে খোলা অফিস নিয়েই দুশ্চিন্তায় রয়েছে ফেসবুক, গুগল, অ্যামাজন। কারণ, ভারতের যে প্রগতিশীল আইনকে বিবেচনায় রেখে তারা অফিস খুলেছিল, তার পরিবর্তে অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ক্ষেত্রে এখন অনেক বেশি রক্ষণশীল আইনের দিকে যাচ্ছে ভারত। সম্প্রতি ফেসবুকের অধীন প্রতিষ্ঠান হোয়াটসঅ্যাপ ভারতের আদালতে একটি মামলাও দায়ের করেছে। ফলে এ মুহূর্তে দূর থেকেই যতটা সম্ভব বাংলাদেশে ব্যবসা করার কথা ভাবছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

ফেসবুক মুখপাত্রের বক্তব্য: সমকালের পক্ষ থেকে জানতে চাইলে ফেসবুকের একজন মুখপাত্র ই-মেইল বার্তায় জানান, বাংলাদেশে অফিস খোলার কোনো পরিকল্পনা ফেসবুকের নেই। তা ছাড়া একটি দেশের প্রতি প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্রে অফিস কোনো নির্দেশকও নয়। ফেসবুক বিশ্বের অনেক দেশে অফিস ছাড়াই ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনা সম্পর্কে মুখপাত্র বলেন, ফেসবুক বাংলাদেশ, বাংলাদেশের ফেসবুক ব্যবহারকারী ও ফেসবুকের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করেন এমন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রতি দায়বদ্ধ। বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা এবং কৌশলগত অবস্থান সম্পর্কে খুব ভালো জানে এমন ব্যক্তিরা ফেসবুকে কর্মরত আছেন। তাদের মধ্যে পাবলিক পলিসি ম্যানেজার, কমিউনিকেশন ম্যানেজার, মার্কেট স্পেশালিস্ট এবং ল্যাঙ্গুয়েজ এক্সপার্ট আছেন। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী স্থানীয় ভাষায় বিশেষজ্ঞ এমন প্রায় ১৫ হাজার কনটেন্ট রিভিউয়ার ফেসবুকে কর্মরত আছেন।

ফেসবুক মুখপাত্র বলেন, ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তাকে ফেসবুক সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়। এ জন্য এমন কিছু ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে, যার মাধ্যমে নিরাপত্তা, স্বচ্ছতা ও নিজেদের ডাটার প্রতি ব্যবহারকারীর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত হয়। ফেসবুক যখনই নতুন কোনো উদ্ভাবনের কথা চিন্তা করে, তখনই ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের বিবেচনায় রাখে। ব্যক্তিগত তথ্যের আরও বেশি সংবেদনশীল নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং এন্ড টু এন্ড এনক্রিপটেড সেবা চালুতে ফেসবুক বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছে।

তিনি আরও বলেন, ফেসবুক সব সময়ই গঠনমূলক ব্যক্তিগত নিরাপত্তার আইনকে সমর্থন করে।

ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর বক্তব্য: ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, কিছুদিন আগেও ফেসবুক-গুগলের মতো প্রতিষ্ঠানের যে নাক উঁচু ভাব ছিল, সেটা এখন নেই। তারা এখন নিয়মিত বৈঠক করছে। দেশের আইন মানার ক্ষেত্রে নমনীয় হচ্ছে। কারণ তারা বুঝতে পারছে, বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় ব্যবসা করতে হলে বিভিন্ন দেশের স্থানীয় আইন মানতে হবে। আইন না মেনে ব্যবসা করার কোনো সুযোগ নেই। অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্সে সেটা দেখা গেছে। ভারতও নতুন আইনের কথা ভাবছে। বাংলাদেশেও তাদের ব্যবসা করতে হলে আইন মেনেই করতে হবে। গ্রাহকের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটা তাদের ব্যবসায়িক বিষয়, কিন্তু যে দেশে ব্যবসা করবে, সে দেশের নিরাপত্তার জন্য প্রণীত আইন মানাটা আরও জরুরি বিষয়। এটা তাদের বিবেচনায় রাখতে হবে।


শর্টলিংকঃ