“রাখিবো নিরাপদ, দেখাবো চিতার পথ”


বাংলাদেশের কারা বিভাগের স্লোগান হলো: “রাখিবো নিরাপদ, দেখাবো আলোর পথ”। সেটা পরিবর্তিত হয়ে আজ দাঁড়িয়েছে: “রাখিবো নিরাপদ, দেখাবো চিতার পথ”।

কোহিনূর কেমিক্যালস এ আইন বিভাগে চাকরি করতেন এ্যাডভোকেট পলাশ কুমার রায়। ৩৬ বছর বয়সী এই মানুষটি তার কোম্পানির কোনো একটা অনৈতিক কাজের কাগজপত্র তৈরি করতে সম্মত হন নি বলে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয় বলে তার পরিবারের অভিযোগ।

এর পরেই তার বিরুদ্ধে কোম্পানির তহবিল তসরুফ এবং নারী নির্যাতনের মতো মামলা দেওয়া হয়। এর সবই ভূয়া বলেই পলাশের পরিবারের অভিযোগ।

কোহিনূর কেমিক্যালস এর দায়ের করা ওই ‘মিথ্যা’ মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে পঞ্চগড়ের ওই আইনজীবী পলাশ তার পরিবারের সদস্যদের সাথে নিয়ে গত ২৫ মার্চ পঞ্চগড় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অনশনে বসেন । এর পর তারা শহরের শের-ই-বাংলা পার্ক সংলগ্ন মহাসড়কে মানববন্ধন করেন।

পলাশের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ওই মানববন্ধন থেকে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, রাষ্ট্রের প্রশাসন ও পুলিশ কে নিয়ে কটূক্তি করেছেন। এ অভিযোগে পঞ্চগড় সদর থানা পুলিশ পলাশ কে সেখান থেকে আটক করে।

পরে জনৈক রাজীব  রানা নামের এক যুবক প্রধানমন্ত্রী কে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে পলাশের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলে সে মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়।

বড়ই ভয়ংকর অভিযোগ বটে। প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে সমালোচনা !  এই ‘অপরাধে’ তাকে বিচারের মুখোমুখি করা যেতো। বিচারে রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন অনুযায়ী তার সাজা হতে পারতো। কিন্তু তাই বলে কারাগারের মধ্যে একজন আসামীকে পুড়িয়ে মারা!

কিংবা কারাগারের মধ্যে একজন আসামীর নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে পুড়ে মরার সুযোগ পাওয়া!!! হ্যাঁ,  আপনি ঠিকই পড়েছেন, আগুনে পুড়িয়ে অথবা পুড়ে মারা/মরা। হ্যাঁ, হ্যাঁ, কারাগারের মধ্যেই । ঘটনাটি পঞ্চগড় কারাগারের মধ্যে।

ওই কারাগারের জেলার মুশফিকুর রহমানের ভাষ্য: “গত ২৬ মার্চ পলাশ রায় কে কারাগারে আনা হয়। তার পায়ের সমস্যার কারণে তাকে কারা হাসপাতালে ভর্তি রাখা হয়। ২৬ এপ্রিল শুক্রবার তাকে পঞ্চগড় থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর প্রস্তুতি চলছিলো। ঢাকায় ২৮ এপ্রিল তার মামলার হাজিরা ছিলো। কিন্তু সকালে হঠাৎ টয়লেটের পাশে গিয়ে তিনি নিজের পরনের ট্রাউজারে আগুন ধরিয়ে দেন।

পরে কারারক্ষীরা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে জেলা হাসপাতালে এবং পরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে তার অবস্থার অবনতি হলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়।” কিন্তু মারা যাবার আগে কী বলে গেছেন এ্যাডভোকেট পলাশ কুমার রায়?

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় পলাশ বলে গেছেন, “অসুস্থ হওয়ায় কারা হাসপাতালে ভর্তি করা হয় আমাকে। সেখানে গত ২৬ মার্চ এসবি পরিচয়ে ৩ জন লোক এসে ছবি তুলে নিয়ে যায়।

২৬ এপ্রিল শুক্রবার সকাল ১১ টার দিকে পুনরায় দুজন লোক আমার কাছে আসে এবং কারা হাসপাতালের এক নম্বর ওয়ার্ডের টয়লেটের পাশে নিয়ে আমার শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়।” ওই ভাষ্যে পলাশ কুমার রায় জানিয়েছেন, টাইগারের বোতলে করে কেরোসিন ছোড়া হয় তার গায়ে । তারপর আগুন লাগানো হয়।

ভাবতে পারেন কতোখানি ভয়ংকর?!

ধরেও যদি নিই,  কারাকর্তৃপক্ষের ভাষ্যসত্য, অর্থাৎপলাশ কুমার রায় নিজের গায়েই আগুন ধরিয়েছিলেন, সেটাইবা সম্ভব হলো কীভাবে? কারাগার তো নিরাপদ জায়গা। সেখানে একজন বন্দী কারারক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কীভাবে একাজ করতে পারলেন?

আর যদি পলাশ কুমার রায়ের অভিযোগ সত্য হয়? কারাগারের স্লোগান বদলে হবে: “রাখিবো নিরাপদ, দেখাবো চিতার পথ”!!! ২৬ এপ্রিল অগ্নিদগ্ধ হবার পর ৩০ এপ্রিল দুপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে তিনি মারা যান।

মারা যাবার আগ পর্যন্ত বিষয়টা গণমাধ্যমের ঠিকঠাক সংবাদ হয়ে ওঠেনি। মারা যাবার পরেও অনেক গণমাধ্যমই সংবাদটিকে গুরুত্বহীন করে প্রচার করেছে,  অনেকেই প্রচারই করেনি। কারণ কী?  অভিযোগের অন্যতম লক্ষ্য ‘কোহিনুর কেমিক্যালস’ বলে? বিজ্ঞাপন? তিব্বত-স্যান্ডালিনা-ফাস্টওয়াশ? টাকা?  কোহিনুরের মালিকের ক্ষমতা? আর কারা জড়িত ছিলো? কারা কর্তৃপক্ষের কেউ না কেউ তো বটেই । যারা পলাশ রায়ের সাথে কারা অভ্যন্তরে দেখা করতে গিয়েছিলো,  তারা কারা? সরকারের লোক? পুলিশের লোক? নাকি কোহিনুরের লোক?

পলাশের পরিবারের ভাষ্য মতে কোহিনুর কেমিক্যালস যে অনৈতিক কাজ করাতে চেয়েছিলো তাদের ওই সাবেক আইন বিভাগের কর্মকর্তাকে দিয়ে, সেটি কী ছিলো?

ঢাকার আদালতে মামলার শুনানীর আগেই পলাশকে মেরে ফেলতে চাইলো কারা এবং কেন? মামলার শুনানীর আগেই কোন সত্য আড়াল করার প্রয়োজন হয়ে পড়লো?  সত্য অনুসন্ধান হোক।

মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী,  আপনি কি কিছু বলবেন? আপনি কি কোনো পদক্ষেপ নেবেন? নাকি এর জন্যও সবেধন নীল মনি প্রধানমন্ত্রীর দিকেই তাকিয়ে থাকতে হবে?

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সাইয়্যেদুল হক সুমন এ বিষয়টি নিয়ে জনস্বার্থে হাইকোর্টে রিট করেছেন। সে রিটের প্রেক্ষিতে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের তদন্ত প্রক্রিয়া ইতোমধ্যেই প্রশ্নবিদ্ধ।

আশাকরি, পলাশ রায়ের কারাগারের অভ্যন্তরে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ অথবা আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের প্রতিবেদন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবেনা। আশাকরি,  এবার সঠিক তদন্তের মধ্যদিয়ে এমন ব্যবস্থা নেওয়া হবে যাতে কারাগার আবার আলোর পথ দেখানোর সংশোধনাগার হয়ে ওঠে।কারাগার যেন আর কাউকে চিতার পথ দেখানোর মৃত্যুকূপ না হয়ে যায়!

এবং আশা করি, বার্ন ইউনিটে শুয়ে পলাশ রায় যে বক্তব্য দিয়ে গেছেন,  তাকে মৃত্যুকালীন জবানবন্দী হিসেবে বিবেচনা করে বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটি পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন। কেবলমাত্র অগ্নিদগ্ধ হবার ঘটনাটিই নয়,  কোহিনুর কেমিক্যালস এর সাথে পলাশের দ্বন্দ্ব ছিলো কী নিয়ে সেখান থেকেই তদন্ত হোক।

লেখক: বাপ্পাদিত্য বসু: সাধারণ সম্পাদক, ইয়ুথ ফর ডেমোক্রেসি এন্ড  ডেভেলপমেন্ট।


শর্টলিংকঃ