রাজশাহীতে তামাকপণ্যের অবৈধ বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি


নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজশাহী মহানগরীর ৩০টি ওয়ার্ডের ২ হাজার ৭৩৬টি তামাকপণ্যের অধিকাংশ দোকানেই কোম্পানীগুলোর অবৈধ বিজ্ঞাপন আর পুরস্কার-প্রনোদনায় ভরপুর। অথচ তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী এসব বিজ্ঞাপন ও পুরস্কার-প্রনোদনা নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আইন লঙ্ঘন করে মহানগরীর পাবলিক প্লেসগুলোতেও দেদারছে চলছে ধূমপান।

ফলে তামাকের ধোঁয়ায় গ্রীন, ক্লিন, এডুকেশন ও হেলদি সিটি হিসেবে পরিচিত রাজশাহী সিটিতে প্রতিনিয়ত ঘটছে স্বাস্থ্যহানি। তামাক কোম্পানী ও দোকানিরা এভাবে দিনের পর দিন আইন অমান্য করে চললেও কর্তৃপক্ষ যেন কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। তাই নগরবাসী রাজশাহীতে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানিয়েছেন।

রাজশাহী মহানগরীর ৩০টি ওয়ার্ডে সরেজমিন পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, তামাকপণ্যের সকল বিজ্ঞাপন প্রচারণা আইনগত নিষিদ্ধ হলেও মহানগরীর সর্বত্রই অবাধে চলছে বিজ্ঞাপন পদর্শন। ভোক্তা ও বিক্রেতাদের নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের তামাক ব্যবহার করতে দেয়া হচ্ছে উপহার।

সম্প্রতি রাজশাহীর বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘এ্যাসোসিয়েশন ফর কম্যুনিটি ডেভেলপমেন্ট-এসিডি’র একটি পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে- মহানগরীর ৩০টি ওয়ার্ডের ২ হাজার ৭৩৬ টি দোকানে বিভিন্ন ধরনের তামাকপণ্য বিক্রয় করা হয়। এর মধ্যে ১ নম্বর ওয়ার্ডের ৮৪টি দোকানে তামাকপণ্য বিক্রি হয়, ২ নম্বর ওয়ার্ডে ৮৫টি, ৩ নম্বর ওয়ার্ডে ১০৭টি।

৪ নম্বর ওয়ার্ডে ১০০টি, ৫ নম্বর ওয়ার্ডে ৫৮টি, ৬ নম্বর ওয়ার্ডে ৬৬টি, ৭ নম্বর ওয়ার্ডে ৬২টি, ৮ নম্বর ওয়ার্ডে ৫৯টি, ৯ নম্বর ওয়ার্ডে ৫৫টি, ১০ নম্বর ওয়ার্ডে ৫৩টি, ১১ নম্বর ওয়ার্ডে ৪০টি, ১২ নম্বর ওয়ার্ডে ১৪৪টি, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে ৮৭টি, ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে ১২৭টি, ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে ৯৩টি, ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে ৯৭টি, ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে ১৩০টি।

১৮ নম্বর ওয়ার্ডে ৮৬টি, ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে ১২১টি, ২০ নম্বর ওয়ার্ডে ৪৬টি, ২১ নম্বর ওয়ার্ডে ৭৩টি, ২২ নম্বর ওয়ার্ডে ৫৯টি, ২৩ নম্বর ওয়ার্ডে ৫০টি, ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে ৯০টি, ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে ৬৬টি, ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে ১৫১টি, ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে ১১৮টি, ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে ১৫৮টি, ২৯ নম্বর ওয়ার্ডে ৭৮টি এবং ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের ১৯৩টি দোকানে বিক্রি হয় তামাকপণ্য।

ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ সংশোধন) আইন, ২০০৫ (২০১৩) এর ধারায় বলা আছে- বিক্রয় স্থলে তামাকপণ্যের প্যাকেট বা মোড়ক সাদৃশ্য কোন দ্রব্য, লিফলেট, হ্যান্ডবিল, পোস্টার, ছাপানো কাগজ, বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড বা অন্য কোনোভাবে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করা যাবে না।

এছাড়া তামাক ব্যবহারে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে কোনো উপহার, দান, পুরস্কার, বৃত্তি প্রদান আইনত দন্ডনীয় ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আইনের এই ধারা অমান্যকারীকে ৩ মাস বিনাশ্রম কারাদন্ড বা অনধিক ১ লাখ টাকা জরিমান বা উভয় দন্ডে দন্ডিত করার বিধান রয়েছে।

পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, মহানগরীর ২ হাজার ৭৩৬টির অধিকাংশ দোকানে লঙ্ঘিত হচ্ছে এ আইন। ৩০টি ওয়ার্ডের এসব দোকানের প্রায় অর্ধেক দোকানে বিভিন্ন সিগারেট কোম্পানি ডামি সিগারেটের প্যাকেটে ডেকোরেশন করে দেয়া হয়েছে। দোকানে দোকানে শোভা পাচ্ছে- সিগারেট কোম্পানীগুলোর হ্যান্ডবিল, স্টিকার ও লিফলেট।

দোকানগুলোর দোকানীকে তারা দিচ্ছে বিভিন্ন ধরনের উপহার। এর মধ্যে রয়েছে- সুদর্শনীয় শো-কেস, দোকানির ছবিসহ পান-সিগারেটের বাক্স, গেঞ্জি, ছাতা, ঘড়ি, মগ ইত্যাদি। এছাড়া সিগারেট-বিড়ি কোম্পানীগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারিরা কোম্পানির লোগো সম্বলিত শার্ট-প্যান্ট পড়েও চালিয়ে যাচ্ছে প্রচারণা।

পর্যবেক্ষণে আরও দেখা গেছে, মহানগরীর ৩০টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২২টি ওয়ার্ডে ১০৬টি তামাকপণ্যের দোকান বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ১০০ গজের মধ্যে রয়েছে। শতাধিক এসব দোকান শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে গড়ে তোলা হয়েছে। তামাক নিয়নন্ত্রণ আইন অনুযায়ী- ১৮ বছরের কম কোনো ব্যক্তির নিকট তামাকপণ্য বিক্রয় নিষিদ্ধ।

আইনের এই বিধান অমান্যকারীর অনধিক ৫ হাজার টাকা অর্থদন্ডের বিধান রয়েছে। অথচ মহানগরীর এই শতাধিক দোকানে আইন লঙ্ঘন করে অপ্রাপ্ত বয়স্ক হাজার হাজার শিক্ষার্থীর নিকট বিক্রি করা হচ্ছে তামাকপণ্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে তামাকপণ্যের দোকান থাকায় অনেক শিক্ষার্থী আসক্ত হচ্ছে ধূমপানে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মহানগরীর বিভিন্ন পাবলিক প্লেস যেমন- হাসপাতাল চত্ত্বর, বাস টার্মিনাল, যাত্রী ছাউনি, গণপরিবহন, সরকারি বিভিন্ন অফিস, আদালত চত্ত্বর, আবাসিক হোটেল, রেস্টুরেন্ট, খাবার হোটেল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভবন ইত্যাদিতে যত্রতত্র করা হচ্ছে ধূমপান।

গ্লোবাল এ্যাডাল্ট টোবাকো সার্ভের (গ্যাট্স) তথ্য অনুযায়ী- প্রতিনিয়ত দেশে মোট গণপরিবহনে যাতায়াতকারী ৪৪ শতাংশ (২ কোটি ৫০ লাখ), নিজ বাড়িতে ৩৯ শতাংশ (৪ কোটি ৮ লাখ), কর্মক্ষেত্রে ৪২ দশমিক ৭ শতাংশ (৮১ লাখ), সরকারি ভবন/অফিসে ২১ দশমিক ৬ শতাংশ, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে ১২ দশমিক ৭ শতাংশ।

বিদালয়ে ৮ দশমিক ২ শতাংশ এবং রেঁস্তোরায় প্রায় ৪৯ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছেন। অথচ আইন অনুযায়ী- এসব পাবলিক প্লেসে ধূমপান করলে তিনশত টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। ধূমপান নিয়ন্ত্রণ আইন রয়েছে কিন্তু এর বাস্তব প্রয়োগ না থাকায় প্রতিনিয়ত এতো সংখ্যক মানুষ স্বাস্থ্যহানির শিকার হচ্ছে।

এব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর রাজশাহীর সমন্বয়ক সুব্রত পাল বলেন, ‘তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন একটি দুর্বল আইন। তারপরও এ আইনের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন না হওয়ায় তামাক কোম্পানিগুলো যেমন অবৈধ প্রনোদনা ও বিজ্ঞাপন ছড়াচ্ছে তেমনি লাখ লাখ মানুষ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে। এজন্য আইন সংশোধন করে জেল-জরিমানার বিধান করা উচিত। পাশাপাশি আইন বাস্তবায়নে জনসচেতনা সৃষ্টি দরকার।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘একটি নগরীকে উন্নত নগরীকে পরিণত করতে হলে কিছু উদ্যোগ নিতে হয়। ক্লিন সিটি, গ্রীন সিটি, এডুকেশন সিটির পাশাপাশি কর্তৃপক্ষ যদি রাজশাহীকে ধূমপানমুক্ত নগরী ঘোষণা করে তাহলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাজশাহীকে একটা বিশেষ জায়গায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব।’

রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, ‘তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের জন্য মহানগরীর অভ্যন্তরে তামাকপণ্যের অবৈধ বিজ্ঞাপন বন্ধ করতে হবে। পাশপাশি নগরবাসীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পাবলিক প্লেসে ধূমপান বন্ধের কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’

তবে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের বাস্তবায়নের বিষয়ে জেলা প্রশাসক এসএম আব্দুল কাদের বলেন, ‘রাজশাহীকে তামাকমুক্ত রাখার লক্ষ্যে বিভিন্ন সময় মোবাইল কোর্টও পরিচালনা করা হচ্ছে।’

তবে ২০০৮ সালে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন সিটিকে তামাকমুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন মেয়র। সিটি মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন জানান, আমি দায়িত্বে না থাকায় উদ্যোগটি তখন আর আলোর মুখ দেখেনি। তবে এবার দায়িত্ব নেওয়ার পর কাজ শুরু করেছি। আশা করছি, এবার উদ্যোগটি সফল হবে।


শর্টলিংকঃ