- ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ - https://universal24news.com -

রাজশাহীতে যে ভাষণ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু


সদ্য স্বাধীন দেশে ১৯৭২ সালের ৯ মে রাজশাহী মাদ্রসা মাঠের ভাষণ দেন  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।  ভাষণে তিনি বলেন, ‘এই রাজশাহীর ওপর দিয়ে তাণ্ডবলীলা চলেছে। আমি জানতাম না যে, আপনাদের কাছে আমি ফিরে আসব। বিশ্বাস করুন, আমি জানতাম না যে, আপনাদের সাথে আমার আর জীবনে দেখা হবে’। দিনটি স্মরণে ইউনিভার্সাল নিউজের পাঠকদের জন্য বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ হুবহু দেয়া হলো-

১৯৭২ সালের ৯ মে রাজশাহী মাদ্রাসা মাঠের ঐতিহাসিক জনসভায় বঙ্গবন্ধু

আমার ভাইয়েরা ও বোনেরা, আমি জানি, আপনাদের কষ্ট হচ্ছে। আমি জানি, আপনারা অনেক দূর থেকে এসেছেন। আমি জানি, রৌদ্রের মধ্যে আপনাদের কষ্ট হচ্ছে। আপনারা শান্ত হোন। আপনারা জানেন, ত্রিশ লাখ লোক জীবন দিয়েছে। আজ প্রথম আপনাদের কাছে জেল থেকে বেরোবার পর আমি রাজশাহীতে এসেছি। আমি বক্তৃতা শুরু করার আগে আপনাদের অনুরোধ করবো, যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দোয়া করবেন। আসুন, প্রথমে বক্তৃতা শুরু করার আগে তাঁদের আত্মার জন্য দোয়া করি আমরা।

আমার ভাইয়েরা ও বোনেরা, আজ আমার স্বাধীনতা পেয়েছি, কিন্তু বড় ত্যাগের বিনিময়ে। এত রক্ত কোন দেশ কোনদিন কোন জাতি দেয়নি, যা আজ আমার বাংলার মানুষকে দিতে হয়েছে। আজ ঘরে ঘরে, গ্রামে গ্রামে মানুষ না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছে। জালেমরা রাস্তাঘাট ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে। চালের গুদাম ধ্বংস করে দিয়েছে। আমার সরকারি কর্মচারীদের গুলি করে হত্যা করেছে। আমার পুলিশ ভাইদের, বিডিআর সামরিক বাহিনীর ছেলেদের গুলি করে হত্যা করেছে। হত্যা করেছে আমার ছাত্র, আমার যুবক, আমার কৃষক, আমার বুদ্ধিজীবী, আমার সাংবাদিকদের। মানুষ যে এত বড় পাষণ্ড হতে পারে, দুনিয়ার ইতিহাসে তা কোনদিন দেখা যায়নি-যা পাকিস্তানের বর্বর সৈন্যরা করে গেছে।

আপনারা রাজশাহীর জনসাধারণ, আপনারা তা জানেন। আপনারা নিজেরা ভুক্তভোগী। এই রাজশাহীর ওপর দিয়ে তাণ্ডবলীলা চলেছে। আমি জানতাম না যে, আপনাদের কাছে আমি ফিরে আসব। আমাকে ২৫ তারিখে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। আমার ভাইদের ওপর মেশিনগান চালানো হয়। আমি মরে গেলেও আমার দুঃখ হতো না, কেননা আমার বাংলাদেশের মানুষ সংগ্রাম করে স্বাধীন হয়েছে। আমার আত্মা দেখতো। বিশ্বাস করুন, আমি জানতাম না যে, আপনাদের সাথে আমার আর জীবনে দেখা হবে। আমি জানতাম না যে, বাংলার মাটিতে আমি আবার ফিরে আসব। আমি জানতাম না যে, আপনাদের মুখ আমি আর দেখতে পাবো।

আমি জানতাম না যে, জীবনে কোনদিন আর এই সোনার দেশে সোনার বাংলায় আমি ফিরে আসতে পারব। আপনারা দোয়া করেছেন, আপনারা রক্ত দিয়েছেন আপনারা সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সংগ্রাম করেছেন। সেই সংগ্রামের ফল হিসেবে আমি পশ্চিম পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্ত হয়ে মাত্র ৪ মাস পূর্বে বাংলার মাটিতে এসেছি। এসে কি দেখলাম? দেখলাম চারদিকে হাহাকার। এসে দেখলাম গৃহহারার, সর্বহারার আর্তনাদ। এসে দেখলাম লাখ লাখ লোক বেকার। এসে দেখলাম আমার মা বোন কাঁদছে। হত্যা করা হয়েছে কারো স্বামীকে, কারো ছেলেকে, জ্বালিয়ে দিয়েছে কারো ঘর, ধ্বংস করে দিয়েছে, বাজার, গ্রামকে গ্রাম। রেল লাইন উড়িয়ে দিয়েছে, স্টিমার ভেঙ্গে দিয়েছে, অর্থ লুট করে নিয়ে গেছে। লুট করেছে বৈদেশিক মুদ্রা। কিছু রেখে যায়নি, ভষ্মীভূত একটা দেশ ছাড়া।

আপনারা আমাকে ভালোবাসেন, আমি আপনাদের ভালোবাসি। আমি যাবার বেলায় বলেছিলাম, আমি যদি মরে যাই, আমি যে ডাক দিয়ে যাব আমার বাংলার মানুষ অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করবে। আপনারা তা করেছেন। আপনারা বিনা অস্ত্রে জালেমদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। বাংলার মাটি থেকে বর্বরের দল চলে গেছে। কিন্তু ধ্বংস করে দিয়েছে আমার সবকিছু। ইনশাল্লাহ সোনার বাংলা একদিন হাসবে। ইনশাল্লাহ, সোনার বাংলার মানুষ একদিন পেটভরে ভাত খাবে। ইনশাল্লাহ, বাংলার মানুষ আবার সুখী হবে। শোষণ বাংলাদেশে থাকতে পারবে না। ভাইয়েরা আমার আজ আপনাদের আমি কিছুই দিতে পারি না। আমি কিছুই দিতে পারব না। যারা আপনাদের ধোকা দেয়, তারা দিতে পারে। আমি ধোকা দিতে পারি না।

আপনারা জানেন, জীবনে আমি কোন দিন মিথ্যা ওয়াদা করিনা। আমি জীবনে প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী হওয়ার জন্য রাজনীতি করিনি। একদিকে ছিল আমার প্রধানমন্ত্রীর সিংহাসন আর একদিকে ছিল আমার ফাঁসির ঘর। আমি বাংলার জনগণকে মাথা নত করতে দিতে পারি না বলেই ফাঁসিকাষ্ঠ বেঁছে নিয়েছিলাম।

আমি কি চাই? আমি কি চাই? আমি চাই আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাক। আমি কি চাই? আমার বাংলার বেকার কাজ পাক। আমি কি চাই? আমার বাংলার মানুষ সুখী হোক। আমি কি চাই? আমার বাংলার মানুষ হেসে খেলে বেড়াক। আমি কি চাই? আমার সোনার বাংলার মানুষ আবার প্রাণ ভরে হাসুক। কিন্তু বড় দুঃখ ভাই, জালেমরা কিছুই রেখে যায়নি। সমস্ত নোটগুলি পর্যন্ত পুড়িয়ে দিয়ে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রা, বিশ্বাস করুন, যেদিন আমি এসে সরকার নিলাম এক পয়সার বৈদেশিক মুদ্রাও পাইনি।

এক কোটি লোক, এক লাখ, দশ লাখ, পঞ্চাশ লাখ নয়, এক কোটি লোক বাংলাদেশে তাদের ঘর বাড়ি ত্যাগ করে, মাতৃভূমির মায়া ছেড়ে স্ত্রী-পুত্র কন্যার হাত ধরে ভারতবর্ষে আশ্রয় নিয়েছিল। মহিয়সী নারী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতের জনসাধারণ আমার দেশের লোককে ভাত দিয়েছিল, আশ্রয় দিয়েছিল। আমার মুক্তিবাহিনীর হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিল, যে অস্ত্র নিয়ে পাষণ্ড ইয়াহিয়া খাঁর সৈন্য বাহিনীকে পর্যুদস্ত করতে পেরেছিল আমার মুক্তি বাহিনীর ছেলেরা। কত ছেলে যে আজ মারা গেছে। ৩০ লাখ! এক লাক, দুই লাখ নয়।

আজ যখন এখানে এলাম আমার বোনেরা আমার কাছে এলো, তাদের স্বামীকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। আমি যখন গ্রামে যাই, আমি দেখতে পাই, চারিদিকে শুধু চোখের পানি। মানুষ এত বড় নির্দয় হতে পারে, মানুষ এত বড় পাষণ্ড হতে পারে, দুনিয়ার ইতিহাসে দেখা যায়নি। শুনেছি নমরুদের নাম, শুনেছি ফেরাউনের নাম, শুনেছি হিটলারের নাম, শুনেছি চেঙ্গিস খাঁর নাম। কিন্তু সব খানদেরকে পরাজিত করেছে ইয়াহিয়া খাঁর সৈন্যবাহিনী। তাঁরা এসেছিল ইসলামের নামে, তারা এসেছিল মুসলমানদের নামে।

শুনে আশ্চর্য হয়ে যাবেন আমার ভাইয়েরা ও বোনেরা, দুই লাখ মা বোনকে আমি উদ্ধার করেছি, যাদের উপর ইয়াহিয়ার সৈন্যরা পাশবিক অত্যাচার করেছে। আপনারা কি বিনা অস্ত্রে ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেননি? করেছেন? পারবেন না, এই গুণ্ডাদেরকে শায়েস্তা করতে? ওরা আমার শতকরা ৬০ ভাগ পুলিশকে হত্যা করেছে। শতকরা ৫০/৬০ ভাগ বিডিআর হত্যা করেছে। অর্ধেকের মত বাঙালি সৈন্য তারা হত্যা করেছে। পুলিশেরা আপনাদের ভাই। আপনারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। এবারও তারা অস্ত্র ধরবে।

আমি চাই যে, জনগণ তাদের সাহায্য করবে। আমার অস্ত্র না থাকতে পারে, আমার বাঁশের লাঠি আছে, আমি বলেছিলাম যে ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল। যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত হও। আবারও আমি বলছি বাঁশের লাঠি তৈয়ার করো। দরকার যদি হয় তোমাদের কাছে আমি অস্ত্র দিয়ে দেবো। কিন্তু বাংলার স্বাধীনতার দুশমনদের সঙ্গে আমার আপোষ নেই। ৩০ লক্ষ লোকের রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা এসেছে, সে স্বাধীনতা আমি নষ্ট করতে দিতে পারি না।

সকল বকেয়া খাজনা চিরদিনের জন্য মাফ করে দিয়েছি, ভাইয়েরা আমার, বোনেরা আমার, আপনাদের কাজ করতে হবে। আমি ১৬ কোটি টাকা দিয়েছি টেস্ট রিলিফের কাজে। আপনারা গ্রামে গ্রামে টেস্ট রিলিফের কাজ করেন এবং কেউ যেন এই টাকা চুরি করতে না পারে। দু’লাখ মা বোন! বলুন এদের আমি কোথায় কি করবো? কি করে আমি বাঁচাবো? কি করে আমি বাঁচাবো। কি করে আমি খাবার দেবো। আমার গুদামে চাল নাই। আমার তহবিলে পয়সা নাই। কিন্তু আমি মানুষের দুঃখ সহ্য করতে পারি না। তাই প্রথমে আমি বলে দিলাম, টাকা নাই ঠিক, কিন্তু গরীবকে অত্যাচার করে খাজনা আদায় করা চলবে না। তাই যত বকেয়া খাজনা ছিল আমি চিরদিনের জন্য মাফ করে দিয়েছি। লবণের ওপর কর থাকতে পারে না। আমি তা তুলে নিয়েছি।

এই ময়দানে একবার আমি একটা কথা বলেছিলাম, আপনাদের তা মনে আছে কিনা জানি না। আমি যদি বেঁচে থাকি ২৫ বিঘা জমি পর্যন্ত জমির খাজনা মাফ হয়ে যাবে। আমি মাফ করে দিয়েছি। প্রায় ৭০ কোটি টাকা আমি মাফ করে দিয়েছি। বলুন আমি টাকা পাবো কোথায়? আমার গুদামে চাল নেই। গত বছর মানুষ কৃষি কাজ করতে পারেনি। সাড়ে সাত কোটি টন ভারত সরকার এবং মিসেস গান্ধী দেবেন বলে ওয়াদা করেছেন এবং পাঠাচ্ছেন। জাতিসংঘ থেকে আমরা খাবার পাচ্ছি। বিভিন্ন দেশ থেকে খাবার আমি কিনছি। আনবো কি করে? জাহাজ কোথায়? বর্বররা জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে গেছে, যাতে অন্য জাহাজ না আসতে পারে। রাশিয়ার সাহায্য নিয়ে জাহাজগুলো তুলছি।

জাতিসংঘ আমাকে ৬ লাখ টন চাল দেবে। এছাড়াও দুনিয়ার অন্যান্য দেশকে বলছি, আমার লোককে বাঁচাও, আমার লোককে খাবার দাও। আমার দেশের লোক মরে গেলো। খাবার দাও। দুঃখ হয় কি জানেন? আমি ভিক্ষা করে চাল নিয়ে আসি, আমি গ্রামে গ্রামে পাঠাই, আর চোরাকারবারীরা সে মাল চুরি করে খায়। ইচ্ছে হয়, ওদের পেটের মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে আমি কালোবাজারীর পয়সা বের করে আনি। বাংলার জনগণ বিনা অস্ত্রে মোকাবেলা করেছে ইয়াহিয়ার সৈন্যদের। পারবেন না এদেরকে শেষ করতে? আমিতো অস্ত্র দিয়ে যাইনি। আমিতো পয়সা দিতে পারিনি। আমি তো দিয়েছিলাম শুধু আদর্শ, দিয়েছিলাম স্বাধীনতার ডাক।

বাংলা আজ স্বাধীন হয়েছে। আজ বাংলার পতাকা উড়ছে। দুনিয়ার প্রায় ৭০ টি দেশ আমার বাংলাদেশকে মেনে নিয়েছে। আজ এই পতাকা দুনিয়ার দেশে দেশে উড়ে। আজ আমি মনে শান্তি পাই যে, আমি আপনাদেরকে দেখতে পাই। কিন্তু শান্তি আমার নাই। আমার পয়সা নাই। গরীব কর্মচারী না খেয়ে কষ্ট পায়। আমি কি করবো? আমি বললাম, ২৫ টাকা বেতন বাড়িয়ে দাও। তাতে আমার ৪০ কোটি টাকা দিতে হয়েছে। পাবো কোথায়? ট্যাক্স কোথায়? খাজনা কোথায়? কোথা থেকে আনবো। কার কাছ থেকে আনবো? কিভাবে দেবো? রাস্তা নেই। বাস ট্রাক নেই। ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। রাস্তাগুলোর পুল উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ট্রাক ছিল না।

আমি ট্রাক পাঠিয়েছি। ট্রাক আনছি দুনিয়ার কাছ থেকে। আনতে সময় লাগে না? আনতে সময় তো লাগে। স্কুল-কলেজ ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়ে গেছে। কেমন করে ছেলেরা লেখাপড়া শিখবে? বই পর্যন্ত নেই। ল্যাবরেটরি নেই। টেবিল-চেয়ার নেই। কি করে ছেলেরা লেখাপড়া করবে? দশ কোটি টাকা দিয়েছিলাম আমি তাদের জন্য। আমি কোথায় পাব? কি করে দেবো? আমার তো নেই কিছু। আমি তো গরীব মানুষের উপর ট্যাক্স বসাতে পারব না। আজ পর্যন্ত আমি তা এক পয়সা ট্যাক্স বাড়াইনি। তাহলে বলবে কি করে? আপনাদের কাজ করতে হবে। ছেলেদের কাজ করতে হবে। আপনারা মনে রাখবেন, স্বাধীনতা পাওয়া যেমন কষ্টকর, স্বাধীনতা রক্ষা করাও তেমনি কষ্টকর। দুশমনরা বসে নেই। দুশমনরা খেলছে। দুশমনরা পয়সা লুটছে।

বাংলাদেশে দালাল ছিল, রাজাকার ছিল। ইয়াহিয়ার সাথে হাত মিলিয়ে ওরা আমার লোককে হত্যা করেছে। কিছু ধরেছি। আরো কিছু ধরার চেষ্টায় আছি। আপনারা খবর দেবেন তাদের ধরা হবে। আমি বলেছি, ওমুক তারিখের মধ্যে অস্ত্র জমা দাও। আমার বাংলার মানুষ, যারা আমাকে ভালোবাসে, তারা অস্ত্র জমা দিয়েছে। এখনও দু’চার জন যারা অনেকে নিজেকে মুক্তিবাহিনী বলেন, অথচ তারা মুক্তি বাহিনীর লোক নন, তারা অস্ত্র জমা দেননি। তারা ১৬ তারিখের পরে আচকানডা বদলিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গিয়েছেন। রাতে তারা সেই অস্ত্র দিয়ে ডাকাতি করে, মানুষকে খুন করে।

আমি দিয়েছি ১০ কোটি টাকার ঋণ যাতে মানুষ গরু কিনতে পারে এবং হাল চাষ করতে পারে। আমরা তো আল্লাহর মর্জি কম নই, সাড়ে সাত কোটি। ওই ১০ কোটি, ৫ কোটি টাকা, কিছুই না। কিন্তু দেবো কোত্থেকে আমি? পাবো কোথায়? কার কাছ থেকে আনবো? টাকা আমি পেতে পারি। টাকা আমি আনতে পারি। কিন্তু আমার ভবিষ্যত বংশধরকে গোলাম করে সেই পয়সা আমি মানুষের কাছ থেকে আনতে চাই না। আমি চাই না যে আমার ভবিষ্যত বংশধর গোলাম হয়ে থাক। যে যা বলুক না কেন, আমি পরিস্কার জানিয়ে দিতে চাই, আমি আপনাদের ধোকা দিতে পারব না। কারণ আমি গদির জন্য রাজনীতি করিনি।

আমি মরবার জন্যে রাজনীতি করেছিলাম। আমি আপনাদের ১০০ কোটি টাকার মত রিলিফ দিয়েছি। তবুও আমি বলছি তিন বছর আপনাদের কিছু দিতে পারব না। আপনারা যদি রাজী থাকেন, তবে হাত তুলে দেখিয়ে দেন। হাত তুলুন, দু’হাত তুলুন। (উপস্থিত জনসাধারণ দু’হাত তুলে সায় দিলো) আমি বলছি ইনশাল্লাহ, নিশ্চয়ই আপনাদের আমি এনে দেব মানুষের কাছ থেকে। কিন্তু কষ্ট করতে হবে। কষ্টে থাকতে হবে। এই ধ্বংস্তুপকে যদি একবার খাড়া করতে পারি, ইন্শাল্লাহ বাংলাদেশের মানুষ কষ্টে থাকবে না। কিন্তু সময় লাগবে। একটা গাছ লাগালেও পাঁচ বছরের আগে ফল হয় না।

সবাইকে আজ শুধু কাজ করতে হবে, শ্রমিক ভাইয়েরা আমার, কাজ করতে হবে। আর ছাত্র ভাইদেরকে বলি, একটু লেখাপড়া করো। বাবার হোটেলে আর কত কাল খাবে? পয়সা-কড়ি নেই। তোমাদের কষ্ট হচ্ছে জানি। কিন্তু লেখাপড়া একটু করো। আন্দোলন করো আমার আপত্তি নেই। আমার জন্ম আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু তোমাদের একটু মানুষ হতে হবে। মানুষ না হলে দেশ গড়তে আমি পারব না। ভবিষ্যতে তোমাদের এ দেশের শাসনভার হাতে নিতে হবে। চুঙ্গা ফুঁকাও, আমার আপত্তি নেই। কিন্তু মেহেরবানি করে একটু কাজ কর।

কৃষক ভাইয়েরা, চেষ্টা করবো, দুনিয়া থেকে বীজ ও পাম্প এনেছি আপনাদের দেবার জন্য। কিন্তু আপনাদেরকে কাজ করতে হবে। কাজ করে ফসল উৎপাদন করতে হবে। জানেন কত লাখ টন, বাংলাদেশে খাদ্যের অভাব? আমি কোথা থেকে দেবো? কি করে দেবো? কেমন করে বাঁচাব? আমার ঘুম হয় না। ৪ মাস হলো আমি জেল থেকে এসেছি কিন্তু একা দিন কেমন করে বিশ্রাম করতে হয় আমি তা জানি না। কিন্তু করবো কি? কি করে চালাবো? এই রাজশাহী আসলাম। রাস্তাঘাট নেই। মানুষের খাবার নেই। পানি নেই। বন্যায় সব নষ্ট হয়ে যায়। কি করে আমি চালাবো? আমি তো বুঝতে পারি না। আমি তো পাগল হয়ে যাই। আমি কি করে কি করবো? আমার তো চিন্তায় ঘুম হয় না। ভাইয়েরা আমার, আপনাদের কাজ করতে হবে। কাজ না করলে কিছুই হবে না।

একটা কথা আমি বলে দেবার চাই। একদল লোক এখন বেরিয়েছে, যারা মাঝে মাঝে এটা বলে, ওটা বলে। যখন রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চলছিল তাদের চেহারা দেখা যায়নি। তারা পালিয়ে ইয়াহিয়ার দালালী করেছে। এরা মনে করেছে শেখ মুজিবুর রহমান কিছু বলে না, বড় দয়ালু লোক। আমি সত্যিই দয়ালু লোক। কিন্তু গরীবকে যদি কেহ শোষণ করে তখন আমি দয়ালু নই। আর একদল লোক বের হয়েছে। তারাও এটা ওটা বলছে। কোথায় ছিলেন? ঘুমিয়ে ছিলেন আরামে। এখন এ কথা সে কথা বলেন। জীবনে কোন কাজ করতে পারেনি। মরবার আগেও করতে পারবে না। খালি মাঝে মাঝে মানুষের দুঃখ দূর্দশা দেখে হা হা এটা হলো না, এটা হলো না। এসো কাজ কর। তোমাকে মানা করেছে কে? একটা গ্রামে যাও। গ্রামের লোককে পেট ভরে খাবার দাও। আমি তো মানা করছি না। তবু কেন বলো কিছু হলো না। এ কারণেই বলতে হয় মার পোড়ে না, পোড়ে ডাইনির।

ভাইয়েরা আমার, আমার এ দেশে সাম্প্রদায়িকতা আর থাকতে পারবে না। আপনারা আমাকে ভালোবাসেন আমি জানি। আমি জানি আপনারা আমার কথা রাখবেন। আমরা বাঙালি। আমরা জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করেছি। আমরা বাঙালি। আমরা জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করেছি। আমরা বাঙালি আমার বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করি। আমরা আর পাকিস্তানি নই। আমরা আর কোন দেশের মানুষ নই। আমরা বাংলাদেশের মানুষ আমরা বাঙালি।

সমাজতন্ত্র ছাড়া বাংলার মানুষ বাঁচতে পারে না। সেজন্য সমাজতন্ত্র কায়েম করার পদক্ষেপ নিয়েছি। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, বড় বড় ব্যাংক ছিল। ভূঁড়িওয়ালাদের ব্যাংক। আল্লাহ মর্জি ওই ব্যাংক আমি কেড়ে নিয়েছি। ওই ব্যাংক এখন আর ভূঁড়িওয়ালাদের ব্যাংক নয়। ওই ব্যাংক এখন সাড়ে সাত কোটি মানুষের। বীমা কোম্পানি আর ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, সাড়ে সাত কোটি মানুষের। সেই আইন আমি পেশ করে দিয়েছি।

বড় বড় কাপড়ের কল। বড় বড় চট কল। বড় চিনির কল। আমি জাতীয়করণ করে সাড়ে সাত কোটি মানুষের সম্পত্তি করে দিয়েছি। আপনাদের এর সূফল ভোগ করতে একটু সময় লাগবে। কিন্তু এ সম্পত্তি আর ২/৫ জনের নয়। এই সম্পত্তি আমার বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি লোকের সম্পত্তি। কোন লোক একশ বিঘার ওপর জমি রাখতে পারবে না। এতে যে জমি উদ্বৃত্ত হবে তা ভূমিহীন গরীবদের মধ্যে বিলি করে দেওয়া হবে। খাসমহলের জমি গরীবকে ছাড়া কাউকেও দেওয়া যাবে না। আর সাম্প্রদায়িকতা যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে।

ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ। মুসলমান তার ধর্মকর্ম করবে। হিন্দু তার ধর্মকর্ম করবে। বৌদ্ধ তার ধর্মকর্ম করবে। কেউ কাউকে বাঁধা দিতে পারবে না। কিন্তু ইসলামের নামে আর বাংলাদেশের মানুষকে লুট করে খেতে দেওয়া হবে না। পশ্চিমারা ২৩ বছর ইসলামিক টেবলেট দেখিয়ে আমাদেরকে লুটেছে। আপনারা জানেন? খবর রাখেন? এই বাংলা থেকে ২৩ বছরে তিন হাজার কোটি টাকা পশ্চিমারা আমার কৃষকের কাছ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গেছে।

বেঈমানের কাছে মাথা নত করবো না আজ ৪ লাখ লোক পশ্চিম পাকিস্তানে আটক রয়েছে। আমি বললাম, ওদের ছেড়ে দাও। ভুট্টো সাহেব ছাড়ছেন না। ভুট্টো সাহেব! ছাড়তে হবে। ওদের আমি ইন্শাল্লাহ আনবো বাংলার মাটিতে। ওরা ফিরে আসবে এই মাটিতে। আপনি তো মুজিবুর রহমানকে ছাড়তেন না। আপনি মনে করেছেন আপনার সৈন্যরা আমার মা-বোনের উপর অত্যাচার করেছে, আমার গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, আমার ছেলেদের হত্যা করেছে, পশুর মত গ্রাম-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে আমি তাদের মাফ করে দেবো?

আমি যদি বেঁচে থাকি, ভুট্টো সাহেব, এই বাংলার মাটিতে তাদের বিচার হবে। কেউ রুখতে পারবে না। আমি কারো কথা শুনবো না। তুমি যতই দুনিয়া ভরে চিৎকার করে বেড়াওনা কেন, যারা আমার মা-বোনের উপর পাশবিক অত্যাচার করেছে, যারা আমার দুধের বাচ্চাকে গুলি করে হত্যা করেছে, যারা আমার গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, যারা আমার সেপাই পুলিশকে হত্যা করেছে এই বাংলার মাটিতে ওদের বিচার হবে যদি শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকে। মনে করেছো তোমার কথায় ভয় পাই। আমার সাথে খেলবার চেষ্টা করো না। দরকার যদি হয়, আমি আমার বাংলার মানুষকে ডাক দিয়ে অস্ত্র দিয়ে মোকাবেলা করবো। কিন্তু বেঈমানের কাছে মাথা নত করবো না।

ভাইয়েরা আমার, আমি কিছুই দিতে পারবো না। ধোকা আমি দিই না। ধোকা আমি দিবো না। মিথ্যা ওয়াদা আমি করি না। আমার হাতে কিছুই নেই। ভাইরা, আমি পেয়েছি, আমার যা পাবার। আমা হাতে কিছুই নেই। ভাইরা, আমি পেয়েছি, আমার যা পাবার। আমার চেয়ে বেশি কোন দেশে কোন নেতা কোনদিন পাননি। সেটা হলো আপনাদের ভালোবাসা। যে ভালোবাসা আপনারা আমাকে দিয়েছেন। আপনারা আমাকে দোয়া করুন, আমি যেন সেই ভালোবাসা নিয়ে মরতে পারি। আমার পাবার মত আর কিছুই নেই। প্রধানমন্ত্রীত্ত্ব আমার কাছে কিছুই না। ওটা নিতে আমি বাধ্য হয়েছি।

আমি প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য স্বাধীনতা আন্দোলন করিনি। আমি প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলতে চাইনি। আমি আমার বাংলায় মানুষকে ভালোবাসতাম। আমি আমার বাংলার মানুষকে ভালোবাসি। আমি বাংলার আকাশকে ভালোবাসি। আমি বাংলার বাতাসকে ভালোবাসি। আমি বাংলার নদ-নদীকে ভালোবাসি। আমি বাংলার প্রত্যেক মানুষকে মনে করি আমার ভাই, মাকে মনে করি আমার মা, ছেলেকে মনে করি আমার ছেলে। কিন্তু আমার হাতে তো কিছু নেই। আমার হাতে তো আলাদীনের প্রদীপ নেই। আমি আপনাদেরকে কোথা থেকে এনে দিবো। আমাকে চেষ্টা করতে হবে। ধ্বংসপ্রায় একটা দেশের মধ্যে এই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। একে গড়তে হবে। চাই ত্যাগ ও সাধনা। ত্যাগ এবং সাধনা ছাড়া এদেশকে গড়া যাবে না। সবুর করতে হবে। সহ্য করতে হবে। কাজ করতে হবে।

যুবক ভাইয়েরা, তোমরা আমার গরীব ভাইদেরকে লুট করে খাবার চেষ্টা করো না। তোমরা চেষ্টা করো, যাতে ওর সুখ হয়। কিছু কিছু যুবক অস্ত্র নিয়ে রাতের অন্ধকারে ডাকাতি করে। মনে করো না যে আমরা খবর রাখি না। খবর আমাদের কাছে আসবে ঠিকই। সময় মত আসবে। তোমাদেরকে আমরা ধরে ফেলবো। এমন ধরা ধরবো যেদিন দুনিয়ার আর মুখ দেখাতে পারবে না। তোমরা অনেকে ভদ্র লোকের ছেলে বলে দাবী করো। অনেকে শিক্ষিত বলে দাবী করো। কিন্তু আমি জানি ২/১ টা পিস্তল আছে। বের করে ফেলবো। আপনারা খবর দিবেন থানায় থানায়। খবর দিবেন?

(জনতার হ্যাঁ সূচক জবাব) আমিও পুলিশদের বলে দিচ্ছি এই গুণ্ডা পাণ্ডা যদি বন্দুক নিয়ে কোন লোককে আক্রমণ করে, এক মিনিট দেরী করো না। জনগণের সহযোগিতায় এদের ধরবে। আমার হুকুম, গুলি করে এদের নিশ্চিহ্ন করবে। আমি দেশে শান্তি শৃঙ্খলা চাই। আমি চাই, মানুষ আরামে ঘুমাক। পেটে ভাত না থাকলেও আরামে ঘুমাতে হবে। ওরা বন্দুক নিয়ে গ্রামে যায়। একটা গরীবের ঘরে গিয়ে লুটপাট করে নিয়ে আসে। এটা ফ্যাশন হয়ে গেছে? না। ফ্যাশন! মনে করেছ বুঝি আমি খুব দয়ালু? বেশিদিন দয়ালু থাকবো না ভাই। একবার যদি নেমে পড়ি পিছনে আর ফিরি না।

তাই তোমাদের কাছে আবেদন করি, বন্দুকখানা আর ব্যবহার করো না। পানিতে ফেলে দিও না, আমার কাছে ফেলে দাও। তা না হলে বিপদ আছে। আমার রাজশাহীর ভাইয়েরা, আপনারা অনেক কষ্ট করে এসেছেন। আমার ভাই কামরুজ্জামানের বক্তৃতা করার কথা ছিল। তিনি বক্তৃতা করতে পারলেন না। আপনারা অনেক জায়গা থেকে কষ্ট করে এসেছেন। আর আমি বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আগের মত আর বক্তৃতা করতে পারি না। আর যখন আপনাদের কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে এক কোটি মানুষের কথা যাদেরকে তাড়িয়ে দিয়েছিল ইয়াহিয়া খাঁ, তখন আমার বুক ভেঙ্গে যায়। গত চার মাসে এরা ফিরে এসেছে ভারতবর্ষ থেকে।

এই এক কোটি মানুষের ঘরবাড়ি নেই। আর ২ কোটি মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে পশুরা। বলুন তো, আমি কি করে এদের ঘরবাড়ি দেবো? কোথায় পয়সা পাবো? যার ঘর নেই, তার ঘর আপনারা চেষ্টা করে তৈরী করে দেবেন। যার খাবার নেই, নিজে একবেলা খেয়ে তাকে খাবার দেবেন। এটাই হলো মনুষ্যত্ব, এটা হলো মানবতা। এটা হলো ভ্রাতৃত্ব। আমি আশা করি, তাই আপনারা করবেন।

আপনারা গরমের মধ্যে অনেক কষ্ট পাচ্ছেন। আমি আপনাদের কাছ থেকে বিদায় দিচ্ছি। ইন্শাল্লাহ আবার দেখা হবে। আপনারা কাজ করুন। আপনারা প্রতিজ্ঞা করুন, আমরা সোনার বাংলা গড়ে তুলবো। আপনারা শান্তি রক্ষা করুন। এই কামনা করি। আমার কর্তব্য আমি করবো। আপনাদের কর্তব্য আপনারা পালন করুন, জয় বাংলা।

 

সূত্র : একাত্তর ডট কম