রাজশাহীতে সক্রিয় শিবির, নিষ্ক্রিয় পুলিশ


নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজশাহীতে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে ইসলামী ছাত্রশিবির। স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতে ইসলামের এই ছাত্রসংগঠনের দুর্ধর্ষ বেশকিছু ক্যাডার এখন রাজশাহীতে অবস্থান করছেন। প্রকাশ্যেই তারা নানা কর্মসূচি পালন করছেন। কিন্তু এদের ব্যাপারে নিষ্ক্রিয় পুলিশ।

ফলে যে কোন সময় রাজশাহীতে শিবিরের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের আশঙ্কা করছেন প্রগতিশীল সমাজের মানুষ। শিবিরের ক্যাডারদের নতুন করে সংগঠিত হওয়ায় তারা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। তারা শিবিরের তৎপরতা রুখে দেয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজশাহীতে শিবির ক্যাডাররা সংঘবদ্ধ হচ্ছে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ঘিরে। প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘মসজিদ মিশন একাডেমি’। এই স্কুলটি শিবিরের ‘আঁতুর ঘর’ হিসেবেই পরিচিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি ‘মসজিদ মিশন সংস্থা’ নামে জামায়াতের একটি সংস্থা দ্বারা পরিচালিত।

সংস্থাটি ১৯৭৬ সালে জেলা সমাজসেবা কার্যালয় থেকে নিবন্ধন নেয়। পরে তারা রাজশাহীতে একে একে তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। কিন্তু নিবন্ধন নেয়ার পর মসজিদ মিশন সংস্থা কোন দিন অডিট করায়নি। নিজেদের ইচ্ছেমতোই কমিটি করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির অন্তত ১১ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে নাশকতার মামলা রয়েছে। সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্তে উঠে এসেছে প্রতিষ্ঠানটির ১১ কোটি টাকার কোন হদিস নেই। এই টাকা জঙ্গিবাদে ব্যয় করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মসজিদ মিশন একাডেমির প্রত্যেক শিক্ষক-কর্মচারী জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। এসব জানাজানির পর প্রতিষ্ঠানটিকে এখন ঢেলে সাজানোর দাবি উঠেছে।

এ দাবিতে গত ২২ আগস্ট মুক্তিযোদ্ধা সংসদের জেলা ও মহানগর ইউনিট মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। এছাড়া ২৫ আগস্ট সম্মিলিত সাংষ্কৃতিক জোট, ২৯ আগস্ট বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এবং ৫ সেপ্টেম্বর একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটি মানববন্ধন করে একই দাবি জানায়। সর্বশেষ রোববার রাজশাহীর মুক্তিযোদ্ধা ও প্রগতিশীল সমাজের প্রতিনিধিরা জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিয়ে মসজিদ মিশনকে ঢেলে সাজানোর দাবি জানান।

প্রগতিশীল মানুষের এমন কর্মসূচির বিপরীতে এখন রাজশাহীতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে ইসলামী ছাত্রশিবির। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন ইসলামী ছাত্রী সংস্থার সদস্যরাও। ‘মসজিদ মিশন একাডেমি প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী পরিষদ’ এর ব্যানারে তারা সংঘবদ্ধ হচ্ছেন। এর নেতৃত্বে রয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সাবেক সভাপতি আশরাফুল আলম ইমন। শিবিরের দুর্ধর্ষ এই ক্যাডারকে এখন রাজশাহীতে প্রকাশ্যেই ঘুরে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে।

২০১৩ সালে রাবি ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এসএম তৌহিদ আল হোসেন তুহিনের হাত ও পায়ের রগ কেটে দেয়ার মামলার অন্যতম আসামি রাবি শিবিরের তৎকালীন সভাপতি আশরাফুল আলম ইমন। আসামিদের মধ্যে মহানগর ছাত্রশিবিরের তৎকালীন ক্রীড়া সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মাসুম পুলিশের এক সংবাদ সম্মেলনে তুহিনের ওপর হামলার দায় স্বীকার করে বলেছিলেন, আশরাফুল আলম ইমনের নির্দেশনা অনুযায়ী তুহিনের রগ কাটা হয়। ইমন রাবি শিবিরের দায়িত্বে থাকাকালে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের ভেতর গুলিতে নিহত হন ছাত্রলীগ নেতা রুস্তম আলী আকন্দ। তিনি হল শাখা ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। রুস্তম হত্যা মামলায় আশরাফুল আলম ইমনসহ শিবিরের আটজনকে আসামি করা হয়েছিল। রাবিতে ২০১৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বর্ধিত ফি ও সান্ধ্যকালীন কোর্স বাতিলের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর অস্ত্রসহ হামলা ঘটে। এ ঘটনায় শিবির ক্যাডার আশরাফুল ইসলাম ইমনসহ ৩৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়।

এরপর গত বছরের সেপ্টেম্বরে মামলার সব আসামিই খালাস পান। সেদিনই তারা ফুলের মালা গলায় দিয়ে আদালত চত্বরে আনন্দ মিছিল করে। ২০১৪ সালের পর শিবির সেদিন থেকেই নতুন করে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। এখন শিবিরকে সংঘবদ্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন ইমন। মসজিদ মিশনে জামায়াত-শিবিরের তৎপরতার বিরুদ্ধে প্রগতিশীল মানুষ সোচ্চার হওয়ার প্রতিবাদে ২২ আগস্ট প্রথমেই ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মসজিদ মিশন একাডেমি প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী পরিষদের ব্যানারে মানববন্ধন হয়। এতে নেতৃত্ব দেন রাবির সেই দুর্ধর্ষ শিবির ক্যাডার আশরাফুল আলম ইমন। এরপর তিনি চলে এসেছেন রাজশাহী। শহরের বিভিন্ন এলাকায় তাকে প্রকাশ্যেই ঘুরে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে। পুলিশ তাকে ধরছে না।

গত শুক্রবার শিবির ও ছাত্রী সংস্থার নেতাকর্মীরা নগরীর প্রাণকেন্দ্র সাহেববাজার বড়কুঠি এলাকায় মসজিদ মিশন একাডেমির সামনে প্রকাশ্যেই সমাবেশ করেন। এরপর তারা সাহেববাজার, রেলগেট, আরডিএ মার্কেট, নিউমার্কেট, দরগাপাড়া ও মনিচত্বর এলাকায় লিফলেট বিতরণ করেন। মসজিদ মিশনকে যেন আগের মতোই চলতে দেয়া হয় সে জন্য সাধারণ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানানো হয় এই লিফলেটে। এই লিফলেট তারা রাজশাহীর কিছু পত্রিকা বিক্রেতার মাধ্যমে স্থানীয় ও ঢাকা থেকে প্রকাশিত সব পত্রিকার ভেতরে ঢুকিয়ে পাঠকের বাড়ি বাড়ি পাঠিয়েছেন। শুধু তাই নয়, শিবিরের সাবেক নেতাকর্মীরা গত ৬ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসকের কাছে গিয়ে একটি স্মারকলিপিও দিয়েছেন। সেখানেও একই দাবি জানানো হয়েছে।

এছাড়া মসজিদ মিশন একাডেমির প্রাক্তন শিবির ক্যাডারেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও ‘মসজিদ মিশন একাডেমি প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী পরিষদ’ নামে একটি গ্রুপ এবং পেইজ খুলেছেন। সেখানে তারা সংঘবদ্ধ হচ্ছেন। নিজেদের মধ্যে গোপনে যোগাযোগের জন্য খোলা হয়েছে একটি গ্রুপ চ্যাট। সেখানে সব ধরনের পরিকল্পনার আলাপ হচ্ছে। শিবিরের এমন তৎপরতায় রাজশাহীতে যে কোন সময় নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের আশঙ্কা করা হচ্ছে।

রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি রকি কুমার ঘোষ বলেন, বিএনপি-জামায়াত ১২ বছর ক্ষমতার বাইরে। তারা সুযোগ পেলেই নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে। সে কারণে তারা এখন রাজশাহীতে সংঘবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছে। এখন মসজিদ মিশন একাডেমিকে ঘিরে তাদের তৎপরতা শুরু হয়েছে। তবে আমরা লক্ষ্য করেছি, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অরাজনৈতিক নাম দিয়ে ছাত্রশিবির নানা ধরনের ক্লাব গঠন করেছে। এসব ক্লাবের আড়ালেই তাদের কার্যক্রম চলছে। তারা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির চেষ্টা করছে। কিন্তু পুলিশের কোন ভূমিকা দেখি না।

জানতে চাইলে রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র গোলাম রুহুল কুদ্দুস বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাবের আড়ালে শিবিরের তৎপরতার খবর তাদের কাছে আছে। তারা বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে শিবিরের নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেন। এখন নতুন করে শিবিরের তৎপরতার খবর তাদের কাছে নেই। তবে গোয়েন্দাদের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হবে। এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে।


শর্টলিংকঃ