রামেক হাসপাতালে রোগীর খাবার বিক্রি


ইউএনভি ডেস্ক:

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে রোগীর জন্য বরাদ্দ খাবার বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট হাসপাতালে অবস্থানরত রোগীর স্বজনদের কাছে খাবার বিক্রি করে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের অর্থ।

এ চক্রের সদস্যরা দেড় থেকে দুই যুগ ধরে রোগীর খাবার বিতরণের দায়িত্বে রয়েছেন। ইতোমধ্যে তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সম্পদের মালিক হয়েছেন। এতে রামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীরা সরকারিভাবে বরাদ্দ খাবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যুগান্তরের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য। এ সংক্রান্ত প্রমাণ যুগান্তরের সংরক্ষণে রয়েছে।

 

জানা গেছে, প্রতিদিন কমপক্ষে দেড় হাজার রোগীকে তিন বেলা খাবার সরবরাহ করা হয়। সকালে নাশতার জন্য একজন রোগীর জন্য দুইশ গ্রামের হাফ পাউরুটি, দুইটি কলা, ৩০ গ্রাম জেলি এবং দুইটি ডিম বরাদ্দ রয়েছে। আর দুপুরে একশ গ্রামের একটি মুরগির পিস, ১৭০ গ্রাম ভাত, দেড়শ গ্রাম সবজি, ১৫ গ্রাম ডাল বরাদ্দ। রাতে একই পরিমাণ ভাতের সঙ্গে একশ গ্রামের একটি মাছের পিস এবং একই পরিমাণ সবজি ও ডাল বরাদ্দ রয়েছে। এছাড়া যারা দুপুরে ও রাতে ভাত নেন না তাদের জন্য ৬টি কলা, ৮০০ গ্রামের দুইটি পাউরুটি, দুইটি ডিম, ১১৫ গ্রাম জেলি, চিনি ৮০ গ্রাম এবং দুধ ৫০ গ্রাম বরাদ্দ রয়েছে।

 

 

জানা গেছে, রামেক হাসপাতালে রোগীদের জন্য তিন বেলা খাবার বিতরণের নেতৃত্বে রয়েছেন কুক মশালচি আবদুল হাকিম, শাহ নেয়ামত আলী ও রাকিবুল ইসলাম। এদের পাশাপাশি দায়িত্ব পালন করেন রাজা, রুবিয়া খাতুন, নার্গিসসহ চতুর্থ শ্রেণির ১৬ কর্মচারী। এছাড়া দৈনিক মজুরিভিত্তিক কর্মচারী হিসাবে মঞ্জু, সঞ্জু ও বাবু নামের আরও তিনজন রোগীর খাবার বিতরণ করেন। তবে রোগীর খাবার বিক্রির সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন হাকিম, নেয়ামত ও রাকিবুল। উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা রোগীর স্বজনরাই মূলত রোগীর জন্য বরাদ্দ খাবারের ক্রেতা। আবদুল হাকিম খাবার বিতরণকালে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডসহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটি ওয়ার্ডের চিকিৎসাধীন কয়েকজন রোগী খাবার না পেয়ে ফিরে যান। কারণ রোগী আসার আগেই হাকিম তাদের জন্য বরাদ্দ খাবার বিক্রি করে দেন। খাবার না পাওয়া এসব রোগী নাম ও পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি।

 

আবদুল হাকিমকে এর আগেও ৩০ ডিসেম্বর রোগীর জন্য বরাদ্দ খাবার বিক্রি করতে দেখা গেছে। এছাড়াও ৯ জানুয়ারি সকালের খাবার বিতরণের সময় তিনি পাউরুটি ও জেলি বিক্রি করেছেন। এসব ভিডিও যুগান্তরের কাছে সংরক্ষিত আছে। হাকিম ২০০৫ সাল থেকে রামেক হাসপাতালে কুক মশপালচি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ সময় থেকেই তিনি খাবার বিতরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তার বেপরোয়া কর্মকাণ্ড এবং তার নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হাসপাতালের কর্মচারীরা। হাকিম ইতোমধ্যে মহানগরীর সিটিহাটসংলগ্ন এলাকায় অর্ধকোটি টাকা মূল্যের তিন কাঠা জমি কিনেছেন। আরও অর্ধকোটি টাকা ব্যয়ে শ্বশুরবাড়ি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে নির্মাণ করেছেন দোতলা বাড়ি। এছাড়াও রয়েছে তার দৃশ্য ও অদৃশ্যমান অঢেল সম্পদ।

 

 

রামেক হাসপাতালে খাবার বিক্রি সিন্ডিকেটের প্রভাবশালী সদস্য আরেক কুক মশালচি শাহ নেয়ামত আলী। তিনিও রোগীর স্বজনদের কাছে প্রতিনিয়ত খাবার বিক্রি করছেন। নেয়ামত ২০১৩ সালে রামেক হাসপাতালে কুক মশালচি পদে যোগ দেন। এরপর তিনিও মহানগরীর উপকণ্ঠ ডাঙ্গেরহাটে জমি কিনেছেন। আর শ্বশুরবাড়ি হরিয়ানে বানিয়েছেন বিশাল গরুর খামার।

 

খাবার বিক্রি সিন্ডিকেটের আরেক হোতা রাকিবুল ইসলাম। মহানগরীর ভাটাপাড়া বাকির মোড় এলাকার বাসিন্দা তিনি। তিনি নিজ এলাকায় ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে বাড়ি নির্মাণ করেছেন। ২০১৯ সালের জুলাইয়ে রোগীর জন্য বরাদ্দ মাছ বিক্রির সময় হাসপাতালে কর্মরত আনসার সদস্যরা রাকিবুলকে হাতেনাতে আটক করেন। পরে তিনি উৎকোচ দিয়ে বিষয়টি ম্যানেজ করেন। একইভাবে এ সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যরাও প্রতিনিয়ত খাবার বিক্রি করছেন।

 

রামেক হাসপাতালের কয়েকজন কর্মচারী বলেন, সকালে দুইশ গ্রামের অর্ধেক পাউরুটি এবং দুইটি ডিম ১০ থেকে ১২ টাকায় রোগীর স্বজনদের কাছে বিক্রি করা হয়। দুপুরে এবং রাতে মাছ-মাংস ও সবজি ২৫-৩০ টাকায় বিক্রি হয়। এছাড়া প্রতি লিটার দুধ বিক্রি হয় ২০ টাকায়। জেলির এক কেজির একটি পট বিক্রি হয় ৮০-১০০ টাকায়। হাসপাতালের খাবারের মান ভালো হওয়ায় রোগীর সঙ্গে থাকা স্বজনরা বাইরে থেকে খাবার না কিনে হাসপাতালের কুক মশালচিদের কাছ থেকেই কেনেন। আর প্রতিদিন দেড় থেকে দুইশ ব্যক্তির কাছে এভাবে খাবার বিক্রি করা হয়।

 

অভিযোগ অস্বীকার খাবার বিক্রি সিন্ডিকেটের মূলহোতা আবদুল হাকিম বলেন, আমরা খাবার বিক্রি করি না। রামেক হাসপাতালে বিভিন্ন এলাকা থেকে গরিব মানুষ চিকিৎসা নিতে আসেন। আমরা তাদের জন্য বরাদ্দ খাবার বিক্রি করে বঞ্চিত করতে পারি না। আমাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হচ্ছে তা ভিত্তিহীন। তবে রাকিবুল ইসলাম মাছ বিক্রির সময় আটকের বিষয়টি সত্য। আমি এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।

 

তবে রামেক হাসপাতালের পরিচালক ডা. সাইফুল ফেরদৌস বলেন, রোগীর জন্য বরাদ্দকৃত খাবার বিক্রির অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি তদন্ত করছেন সহকারী পরিচালক (প্রশাসন)। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

সূত্র: যুগান্তর


শর্টলিংকঃ