রিমান্ডে পুলিশের নির্যাতনে আসামির মৃত্যুর অভিযোগ


নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজশাহীতে রিমান্ডে নিয়ে হত্যা মামলার এক আসামিকে নির্যাতনের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বাদীপক্ষের কাছে প্রভাবিত হয়ে তদন্ত কর্মকর্তা তাকে রিমান্ডে নিয়ে শারীরিক নির্যাতন করেছিলেন বলে অভিযোগ তার খালা ইউএস বেগম রোকেয়ার। তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক।

মারা যাওয়া এই যুবকের নাম কনক চৌধুরী (৩৩)। তিনি নওগাঁর বদলগাছি উপজেলার চকরাইল গ্রামের নয়াজেস চৌধুরীর ছেলে। রাজশাহী মহানগরীর বিলশিমলা এলাকায় খালা বেগম রোকেয়ার বাড়িতেই তিনি থাকতেন। রোকেয়ার স্বামীর নাম মোজাম্মেল হক তালুকদার একজন আইনজীবী ছিলেন। মোজাম্মেল-রোকেয়া নিঃসন্তান হওয়ায় তাদের সঙ্গেই থাকতেন কনক চৌধুরী।

তার মৃত্যুর ঘটনায় কনককে রিমান্ডে নেয়া তদন্ত কর্মকর্তাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করতে গত বুধবার রাজশাহী নগরীর রাজপাড়া থানায় এজাহার নিয়ে যান বেগম রোকেয়া। তবে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহাদাত হোসেন খান মামলা গ্রহণ করেননি। তাই পরদিন বৃহস্পতিবার বেগম রোকেয়া পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই) একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযোগের অনুলিপি পাঠানো হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ হেড কোয়ার্টার্স এবং রাজশাহী মহানগর পুলিশে (আরএমপি)।

কনকের মৃত্যুর ঘটনায় মামলা না নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে রাজপাড়া থানার ওসি শাহাদাত হোসেন খান বলেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন না পাওয়ায় মামলা নেয়া যায়নি। মামলা করার মতো যদি কোনো ‘গ্রাউন্ড’ থাকে তবে পরে মামলা হবে।

কনক যে হত্যা মামলার আসামি ছিলেন সে মামলার আসামি বেগম রোকেয়াও। তার স্বামী মোজাম্মেল হক তালুকদারের মৃত্যুর ঘটনায় হত্যা মামলা করে তাদের আসামি করা হয়েছিল। রাজপাড়া থানা পুলিশ এই হত্যা মামলাটি না নেয়ার কারণে তার শ^শুরপক্ষের লোকজন মামলা করেছিলেন আদালতে।

এখন কনকের মৃত্যুর জন্য বেগম রোকেয়া ১১ জনকে অভিযুক্ত করছেন। এর মধ্যে প্রধান অভিযুক্ত মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই এর রাজশাহীর উপ-পরিদর্শক (এসআই) জামাল উদ্দীন। অন্য ১১ জন বেগম রোকেয়ার শ্বশুরপক্ষের আত্মীয়।

অভিযোগে বেগম রোকেয়া বলেন, শ্বশুরপক্ষের জমির ভাগ-বন্টন হয়নি। তারা নিঃসন্তান হওয়ায় কনক তাদের বাড়িতে থেকে সবকিছু দেখাশোনা করতেন। ভাই-ভাতিজাদের সঙ্গে মনোমালিন্য থাকায় মানসিক অস্বস্তিতে গেল বছরের সেপ্টেম্বর তার স্বামী মোজাম্মেল হক তালুকদার গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি জমির ভাগ চান। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন তার শ^শুরপক্ষের আত্মীয়-স্বজন। তারা মোজাম্মেল হককে হত্যার অভিযোগে তাদের দুজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এ মামলায় তারা উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেন।

এরপর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বাদীপক্ষের কাছে প্রভাবিত হয়ে গেল বছরের ২৮ নভেম্বর আদালতে কনক চৌধুরীর রিমান্ডের আবেদন করেন। আদালত দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এই রিমান্ডে নিয়ে তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। এরপর তাকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। পরে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় কারা কর্তৃপক্ষ চিকিৎসার জন্য কনক চৌধুরীকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের প্রিজন সেলে নিয়ে যায়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত সোমবার (০৪ মে) কনক মারা যান। পরে ময়নাতদন্ত শেষে তাদের লাশ দেয়া হয়। পরবর্তীতে লাশ নওগাঁয় গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে দাফন করা হয়।

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, রিমান্ডে নিয়ে কনকের পিঠে লাঠি দিয়ে পেটানো হয়েছিল। এতে সারাপিঠে কালো দাগসহ মাংস পঁচে ইনফেকশন হয়েছিল। ডান পায়ের হাঁটুর নিচেও ইনফেকশন হয়েছিল। নাভির নিচে আগুনের ছ্যাকা দেয়ার কারণে সেখানেও পঁচন ধরেছিল। অন্ডকোষ আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ফুলে নিচের দিকে ঝুলে গিয়েছিল। কিন্তু ঠিকমতো চিকিৎসাও হয়নি। তাই তিনি মারা গেছেন।

রামেক হাসপাতালের মৃৃত্যু সনদেও কনকের মৃত্যুর জন্য তিনটি কারণ উল্লেখ রয়েছে। এগুলো হলো- সেপটিসেমিয়া, সেলুলিটিস এবং গ্যাংগ্রিন। রামেক হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. সাইফুল ফেরদৌস বলেন, সেপটিসেমিয়া হলো রক্তে ইনফেকশন। সেলুলিটিস অর্থ চামড়ায় ইনফেকশন এবং গ্যাংগ্রিন মানে পঁচে যাওয়া। লাঠি দিয়ে মারধরের কারণে টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সেলুলিটিস এবং গ্যাংগ্রিন হতে পারে।

নির্যাতনের কারণেই কনকের মৃত্যু হয়েছে দাবি করে বেগম রোকেয়া বলেন, আমার যা সম্পত্তি আছে তার ভবিষ্যৎ মালিক ছিলো কনক চৌধুরী। সে জন্য তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। থানা পুলিশ মামলা নেয়নি। যদি হাইকোর্টে যাওয়া লাগে যাব। তিনি দাবি করেন, তার সম্পত্তি লুটপাট করতে তাকে এবং কনককে মিথ্যা হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে।

মুঠোফোনে যোগাযোগ করে কনককে নির্যাতনের বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযোগ অস্বীকার করেন এসআই জামাল উদ্দীন। তিনি বলেন, রিমান্ডে আনার সময় এবং ফেরত পাঠানোর সময় আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী হাসপাতালে শারীরিক পরীক্ষা করা হয়েছে। সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় আসামিকে আনা হয় এবং রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হয়। নির্যাতনের অভিযোগ মিথ্যা।

রাজশাহী পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ বলেন, এ ধরনের কোনো বিষয় তিনি জানেন না। আরএমপির মুখপাত্র গোলাম রুহুল কুদ্দুস বলেন, অভিযোগের একটি অনুলিপি তারা পেয়েছেন। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

আরও পড়তে পারেন বিয়েতে অমত : কলেজছাত্রী ও তার মাকে মারপিট


শর্টলিংকঃ