রোগীর সংস্পর্শে এলেই কি করোনা হয়?


‘কোভিড রোগী হওয়ায় আম্মার সংস্পর্শে থাকার কারণে তার মৃত্যুর পর অনেকেই আমাদের বলেছেন, করোনাভাইরাস আমাদের আক্রান্ত করেছে কিনা সেটা জেনে নিতে কোভিড টেস্ট করিয়ে নেয়া ভালো। আমরা কেউই সেটা করিনি। আমরা কোয়ারান্টাইনে থেকেই বুঝতে চেয়েছি, করোনার কোনো লক্ষণ আমাদের মধ্যে দেখা যায় কি না’।

করোনা নিয়ে এতোই লেখালেখি হয়েছে যে তাতে এক শ্রেণির মানুষের মনে ভয়াবহ রকমের ভীতি জন্মেছে। এই ভীতির কারণে করোনা রোগী তো বটেই, করোনা সন্দেহে সাধারণ রোগীদেরকেও হাসপাতালে ফেলে স্বজনরা পালিয়ে গেছেন! অনেকে ফেলে গেছেন প্রিয়জনদের লাশও! এমন অনেক ঘটনার কথাই সংবাদমাধ্যমে এসেছে, যেখানে দেখা গেছে, স্বজনরা লাশ দাফন করতে কবরস্থানে পর্যন্ত যাননি! কোনো কোনো হাসপাতাল তো রোগীদের স্বজনদের না জানিয়েই লাশ কবরস্থ করে ফেলেছে! মানুষ হিসেবে আমরা কতোটা নির্দয়, কতোটা ভয়ংকর- এ সবই তার জ্বলন্ত উদাহরণ।

আমরা দু’ ভাই শুরু থেকে শেষ অব্দি আম্মার সংস্পর্শে ছিলাম। তাকে শেষবারের মতো দেখতে হাসপাতালে এসেছিলো আমাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও। এ ছাড়া হাসপাতালে থাকার সময়ে আম্মাকে দেখতে গেছে আমার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী শাওন, ওর ছোট ভাই ডা. শোভন ও আমার ছোট বোন শিলার স্বামী মির্জা হাসানও। আমরা দু’ ভাই অন্যদেরকে হাসপাতালে যেতে নিষেধ করলেও তারা তা শোনেনি! শাওন তো কোনো পিপিই ছাড়াই কেবল সাধারণ মাস্ক ও গ্লাভস পরেই হাসপাতালে হাজির হয়ে গেছে! আমি, সাজ্জাদ, শোভন ও হাসান কবরস্থানে গিয়ে জানাজা ও দাফনকাজেও অংশ নিয়েছি।

আমি ভাবতে ভালো লাগছে যে আমার স্বজনদের প্রায় সকলেই মানুষ হিসেবে অত্যন্ত মানবিক। হাসপাতালে যাওয়ার ব্যাপারে তাদের কারোর মধ্যে সামান্যতম দ্বিধা বা অস্বস্তিও আমি দেখিনি।

কোভিড রোগী হওয়ায় আম্মার সংস্পর্শে থাকার কারণে তার মৃত্যুর পর অনেকেই আমাদের বলেছেন, করোনাভাইরাস আমাদের আক্রান্ত করেছে কিনা সেটা জেনে নিতে কোভিড টেস্ট করিয়ে নেয়া ভালো। আমরা কেউই সেটা করিনি। আমরা কোয়ারান্টাইনে থেকেই বুঝতে চেয়েছি, করোনার কোনো লক্ষণ আমাদের মধ্যে দেখা যায় কি না।

না। আমাদের কারোর মধ্যেই আজ অব্দি কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি! আগামীকালই আমাদের কোয়ারান্টাইনে থাকার ১৪ দিন পুরো হবে। আমরা এখনো মাশায়াল্লাহ সবাই সুস্থ আছি। ভালো আছি।

করোনা রোগীর সংস্পর্শে এলেই সবাই করোনায় আক্রান্ত হবেন, বিষয়টা হয়তো শেষ পর্যন্ত এমন নয়। অনেকে করোনা রোগীর সংস্পর্শে আসার পরই পরিবারসুদ্ধ কোভিড টেস্ট করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন! তাদের কেউ কেউ কোভিড পজিটিভ হিসেবে শনাক্তও হন। কিন্তু তাদের সকলের মধ্যেই যে করোনার লক্ষণ দেখা যায়, তা নয়। বরং কোভিড পজিটিভ ধরা পড়লে তাদের মানসিক অবস্থা কী হতে পারে- সেটা অনুমান করতে কষ্ট হয় না।

আমি মনে করি, কোভিড রোগীদের সংস্পর্শে গেলেও করোনার কোনো লক্ষণ দেখা না দেয়া পর্যন্ত টেস্ট করানোর একেবারেই প্রয়োজন নেই। মানে, করোনার লক্ষণ দেখা দিলে তবেই টেস্ট করানো উচিত। খামোখা টেস্ট করে কেন একটা মূল্যবান কিট আপনি নষ্ট করবেন?

কোভিড রোগীদের সংস্পর্শে এলেই আপনি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যাবেন, ব্যাপারটা যে তেমন নয়, তার জলজ্ব্যান্ত উদাহরণ- আমরা কেউই হয়তো আক্রান্তই হইনি। আবার আক্রান্ত হলেই আমরা অসুস্থ হয়ে পড়বো, বা মরে যাবো ব্যাপারটা হয়তো তেমনও নয়। কারণ এখনো পর্যন্ত এ দেশে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে মৃত্যুর হার মাত্র ২-৩ শতাংশই। এর অর্থ, প্রিয়জনদের কেউ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তার পাশে আপনি এটুকু ঝুঁকি নিয়ে দাঁড়াতেই পারেন। শারীরিকভাবে। সেটা সম্ভব না হলে অন্যভাবেও। এটা নিশ্চয়ই মানবেন, সরাসরি কোভিড রোগীর সংস্পর্শে না এলেও আপনি করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন। সেই ঝুঁকি আপনার সহসা কমছে না।

আমার এখনো স্থির বিশ্বাস যে, আমাদের দেশে মানুষ যতোটা না করোনায় মারা গেছেন, তার চাইতে বেশি মারা গেছেন সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে। ঝুঁকিপূর্ণ যে কোনো রোগীর জন্য সঠিক সময়ে চিকিৎসা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু ভুক্তভোগীরা জানেন, কোভিড টেস্ট থেকে শুরু করে তাৎক্ষণিকভাবে হাসপাতালের একটা সিট কিংবা অক্সিজেন সুবিধা পাওয়া কতোটা কঠিন। এমনকি কোভিড কোনো রোগীর জন্য তাৎক্ষণিকভাবে একটা কবর পাওয়াও অনেক কঠিন।

এমন বিপর্যয়ের সময় মানুষ সামান্য একটু মানবিক না হলে সে আর মানুষ থাকে কী করে?

ফরিদ কবির : কবি


শর্টলিংকঃ