‘লিবিয়ার চে গুয়েভারা’


মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব একবার যুদ্ধজয়ের কৌশল হিসেবে সৈনিকদের বর্শার মাথায়, তলোয়ারের হাতলে একটা করে তাবিজ বেঁধে দিলেন। এটা যোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধিতে কাজে লেগেছিল। ফলে প্রায় অসম যুদ্ধেও তারা লড়াইয়ে ছিলেন ওই তাবিজের অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাস থেকে। শেষ পর্যন্ত তারা জয়লাভও করেছিলেন। পরে দেখা গেল সেই তাবিজে অলৌকিক কিছু ছিল না, স্রেফ একটা চিরকুটে লেখা আওরঙ্গজেবের নাম ছাড়া।

এই নামের ভেতর থেকে শক্তি পাওয়ার আধুনিক প্রতীক হচ্ছে নেতার ছবি বহন করা। এক্ষেত্রে দুনিয়াজুড়ে যে কারো চেয়ে আর্জেন্টাইন কমিউনিস্ট গেরিলা আর্নেস্তো চে গুয়েভারার (১৪ জুন ১৯২৮—৯ অক্টোবর ১৯৬৭) ছবি সবচেয়ে বেশি দেখা যাবে। মৃত্যুর সময় তার পরিচিতি ও প্রভাব কেমন ছিল তা অনুমানসাপেক্ষ বটে, তবে আজকের দিনে তার বিস্তার শতকোটি ছাড়িয়ে গেছে, তা হলফ করে বলা যায়।

বিশ্বের অনেক সশস্ত্র বিপ্লবী গেরিলা দল পতাকায় চের ছবি ব্যবহার করে, তার নামে শপথ নেয়। একই ধরনের ঘটনা দেখা যায় লিবিয়ায় ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী নেতা ওমর মুখতারের (২০ আগস্ট ১৮৫৮—১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৩১) ক্ষেত্রে। চলতি দশকের শুরুতে মধ্যপ্রাচ্যে ‘আবর বসন্ত’ বলে যে স্বৈরাচারবিরোধী অভ্যুত্থান ঘটে, লিবিয়ায় তা শুরু হয় ২০১১ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে। সেখানে অনেক তরুণকে দেখা যায় ওমর মুখতারের মৃত্যুর ৮০ বছর পর তার মুখাবয়ব খচিত পতাকা নিয়ে মুয়াম্মার গাদ্দাফিবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন।

che-guevara

অবশ্য ২০০৯ সালে মুয়াম্মার গাদ্দাফিও ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী প্রতীক হিসেবে বুকে ওমর মুখতারের ছবি বহন করে রোম গিয়েছিলেন। এটা ছিল ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর লিবিয়ার কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের সাবেক ঔপনিবেশিক ইতালিতে প্রথম সফর। এমনকি ১৯৬৯ সালে গাদ্দাফি তার ক্ষমতা আরোহণের প্রথম বর্ষ উদযাপনে ওমর মুখতারকে অন্যতম প্রতীক হিসেবে সামনে আনেন। সেই ইতিহাসে প্রবেশের আগে চের সঙ্গে মুখতারের সংযোগটা সম্পন্ন করা যাক।

গ্রেফতারের পর ওমর মুখতার
গ্রেফতারের পর ওমর মুখতার

গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের শুরু থেকেই ওমর মুখতারকে তুলনা করা হয় ‘লিবিয়ার চে গুয়েভারা’ হিসেবে। চে গুয়েভারা যেমন আর্জেনটাইন হয়েও কিউবায় বিপ্লব করেছিলেন, যোগ দিয়েছিলেন কঙ্গো ও বলিভিয়ায় বিপ্লবী গেরিলা তত্পরতায়। ওমর মুখতারও লিবিয়ার নেতা হলেও উনিশ শতকের শুরুতে মিসর সীমান্তে ব্রিটিশবিরোধী এবং দক্ষিণ সুদান ও চাদে ফরাসি ঔপনিবেশবিরোধী গেরিলা যুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন। চের সঙ্গে আরেকটি সংযোগ আছে ওমর মুখতারের। চে গুয়েভারা যে কিউবায় বিপ্লব করেছিলেন, তার রাজধানী হাভানায় আবক্ষ ভাস্কর্য আছে তার। চে গুয়েভারার বিপ্লব ও রাজনৈতিক মতাদর্শ দিয়ে অনুপ্রাণিত ভেনিজুয়েলায়ও আছে চের আবক্ষ ভাস্কর্য, দেশটির রাজধানী কারাকাসে এটি স্থাপিত হয়েছে।

মনে করা যাক, চে গুয়েভারাকে যখন বলিভিয়ার পাহাড়ের এক পরিত্যক্ত স্কুলে হত্যার জন্য বন্দুক তোলা হয়, তখন হন্তারকের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা কেবল একজন বিপ্লবীকে হত্যা করতে পারো, কিন্তু তার আদর্শকে নয়।’ বেনগাজির পূর্ব দিকের পাহাড়ে ওমর মুখতারকে যখন ইতালীয় সৈন্যরা ঘিরে ফেলে আত্মসমর্পণের জন্য আহ্বান জানায়, তখন জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘অর্থ, খ্যাতি চিরস্থায়ী নয়, আমরা কখনই আত্মসমর্পণ করব না, হয় বিজয় অথবা মৃত্যু।’ যেমন চে একবার বলেছিলেন, ‘আমরা ততক্ষণ বাঁচি না, যতক্ষণ না আমরা মৃত্যুর জন্য তৈরি থাকি।…হয় মুক্তি অথবা মৃত্যু।’ কীভাবে এই বক্তব্য পরস্পরের সহগামী হয়, তা বোঝা কঠিন নয়।

ওমর মুখতারের জীবন নিয়ে গবেষণা করেছেন বেনগাজির গারিইউনিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ আথিয়া মাকজুম। তিনি বলেন, ‘এই সময় আমরা যার মধ্যে বেঁচে আছি, ওমর মুখতার তার সবকিছুর প্রতীক।…তিনি হচ্ছেন লিবিয়ার একক ব্যক্তি, যাকে নিয়ে আমরা সত্যিকারের গর্ব করতে পারি।’ (লস অ্যাঞ্জেলস টাইমস, মে ৬, ২০১১)

লিবিয়ায় আরব বসন্তে গাদ্দাফির শাসনের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামা তরুণ ‘বিদ্রোহীদের’ টুপি, স্টিকার, পোস্টার, সৈনিকদের গাড়ি, চেক পয়েন্ট, এমনকি সাংবাদিকদের দেয়া পরিচয়পত্রেও ওমর মুখতারের ছবি দেখা যায়। বিদ্রোহীরা বলেছেন, ওমর মুখতার আরবের সব নেতার নেতা, আফ্রিকার সব রাজার রাজা।

রাজা ইদরিসের নেতৃত্বে লিবিয়াকে ১৯৫১ সালে জাতিসংঘ যখন স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়, ইদরিস বেনগাজি শহরের ওমর মুখতারের নামে বিভিন্ন জাদুঘরসহ স্থাপনা তৈরি করেন, যা জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয় গোত্রগুলোর তীর্থস্থান।

গাদ্দাফি যতই ওমর মুখতারের ছবি বহন করুন না কেন, বেনগাজিতে তার শাসন শেষ পর্যন্ত জনপ্রিয় ছিল না। ২০০০ সালে মুখতারের ছেলে মোহাম্মেদ ওমর মুখতার ওমর বলেন, ‘বেনগাজিতে তার ফিরে আসায় আমার বাবা কখনই খুশি হতেন না।’ ওই এলাকায় ঐতিহ্যবাহী শাসন এখনো চালু আছে। গাদ্দাফি শেষ পর্যন্ত ইতালির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরিতে উদগ্রীব ছিলেন।

অলাত এহসান: গল্পকার ও সমালোচক


শর্টলিংকঃ