- ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ - https://universal24news.com -

লড়াইটা নারীর একার নয়


অনেক কন্যা সন্তানের মা, বাবা ও ছোট বোনের একমাত্র বড় ভাই প্রতিনিয়ত জানাচ্ছেন, এখন মেয়েদের নিয়ে রাস্তায় বের হতেও ভয় হয়!! ভাবতে অবাক লাগে, ২০২০ সালে দাঁড়িয়ে এই ক্ষুদেবার্তাগুলো পাচ্ছি, আমি নিশ্চিত আপনারাও এই ধরণের বার্তা পরস্পরকে শেয়ার করছেন! দুঃসময় ও দুর্ঘটনা আমাদের বাধ্য করছে! অথচ এটা ২০২০!!! যে সময়ে আমাদের স্বপ্ন দেখা দরকার ছিল যে, কবে আমাদের কন্যা, বোন দেশ সেরা বিজ্ঞানী হবে, আগামী দিনের রাষ্ট্র প্রধান হবে, কিংবা বিশ্ব জয় করবে অলিম্পিক কিংবা ক্রিকেট দুনিয়ায়! কিন্তু এসব ভাবা তো দূরে থাক, এখন মেয়ে/বোনকে নিয়ে বাসা থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছে!!

ডাব্লিউইএফ এর জরিপ অনুযায়ী, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন- এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে পাঁচ, যদিও অর্থনৈতিক সুযোগ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধার আওতার সূচকে অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ৷ সংস্থা টি আরও জানিয়েছে যে, বেশকিছু বিষয়ে বৈশ্বিক লিঙ্গ বৈষম্য আগামী ১০৮ বছরেও দূর হবে না!! তাহলে বুঝাই যাচ্ছে বিশ্ব পরিস্থিতি কি লিঙ্গ বৈষম্যের ক্ষেত্রে!

কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্বে কয়টি রাষ্ট্র এই সুযোগ পেয়েছে যে, তাদের রাষ্ট্র প্রধানেরা প্রায় ২৭/২৮ বছর ধরে নারী! যদি এই সুযোগ পেতো তাহলে তারা কতোটা পরিবর্তন আনতেন? রাষ্ট্র কি চাইলে এই পরিবর্তন আনতে পারেনা? আইন কি কঠোর কঠিন করা যায়না? সেক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক সরকারের উপর অনেক চাপ থাকে, কারণ ইতিমধ্যেই অনেকে নারী নির্যাতনের ভুয়া মামলা হয় বলে গণমাধ্যমে নালিশ করেছেন অনেকেই, এবং সমাজে তা হয়ও বটে! কিন্তু এই মুহূর্তে দেশের নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ নিয়ে যে হারে প্রতিদিন খবর দেখতে পাচ্ছি, তাতেও কি কঠিন কোন সিদ্ধান্ত নেয়া যাচ্ছেনা?

এবার আসি, লড়াই প্রসঙ্গে!
নারীরা ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচার কালো করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে| প্রতিবাদ জানানোটাই বড় কথা, যে যেভাবে যার যার অবস্থান হতে জানালেই হল| এমনকি আমি বিশ্বাস করি, যিনি প্রতীকীভাবে হয়তো প্রতিবাদ করছেন না, কিন্তু ব্যক্তি মানুষ হিসেবে তার সংসার বা কর্মক্ষেত্রে নিজের মতো করে প্রতিবাদ করে, সেটাও প্রতিবাদ ই! আবার যিনি বা যারা শাহবাগে গিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, তাদের প্রতি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি|

শেষ কথা একটাই, যে যেখানেই থাকুক, নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে| যেহেতু ভারচুয়াল জগতে বসবাস করি আমরা, তাই প্রতিবাদের ভাষা ভার্চুয়ালি হবে, সেটাও স্বাভাবিক| কিন্তু তা রাষ্ট্রকে আমলে নিতে হবে| এবং এই প্রতিবাদটা নারীপুরুষ নির্বিশেষে সকলের পক্ষ হতে আসা দরকার| কেন?

কারণ, আমার মনে হয়, ধর্ষণের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ কেবল নারীর একার নয়, পুরুষ সমাজেরও| পুরুষরাও এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতে হবে, ধর্ষণের বিরুদ্ধে কেবল নারী দাঁড়াবে, পুরুষ দাঁড়াবে না, তা হয়না| নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ করে পুরুষ সমাজের এক অংশ, সবাই নয়| তাই পুরুষ সমাজের সেই অংশকে বাদ দিয়ে আন্দোলন/লড়াই করার অর্থ হল, তাদেরকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলা| কিন্তু সমাজে বড় কোন পরিবর্তন আনতে হলে অধিকাংশকে সাথে নিয়ে লড়াইটা করতে হবে, জগতের সকল পুরুষ একইরকম নির্যাতক, নিপীড়ক নয়|

এই পুরুষরাই নিপীড়িত নারীর বাবা, ভাই, কিংবা আত্মার আত্মীয়| এই পুরুষরাই ধর্ষকের বাবা, ভাই, বন্ধু কিংবা আত্মীয়| তাই দায় ও দায়িত্ব তাদেরও নিতে হবে| আবার নারীদের সকলকেই নারী বান্ধব বা নারীর অধিকার সম্পর্কে সোচ্চার তা ভাবার কোন অবকাশই নেই| সমাজের বহু নারী সহিংসতার শিকার হচ্ছে তাদের আশে পাশের নারীর দ্বারাও, তা নিম্মবিত্ত হতে শুরু করে উচ্চবিত্ত পর্যন্ত | সেইসব নারীরা পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শে বেড়ে উঠা নারীর দৈহিক অবয়ব, কিন্তু মনমানসিকতায় পুরুষতন্ত্রের মতাদর্শকে ধারণ ও বহন করে|

নিজের বেলায় নারীবাদ, অন্য নারীর বেলায় পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শের চর্চা করার হিপক্রেসি থেকে বের হতে হবে অনেক নারীকেই | সেই নারীদেরও এই যুদ্ধে সামিল করতে হবে, তারা পুরুষতন্ত্রের মতাদর্শে মোহাচ্ছন্ন নারী সমাজ, সেই অংশকেও বুঝাতে হবে তারা কিভাবে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করছেন, ইন্ধন জুগাচ্ছেন|

সমাজ মাত্রই নারী-পুরুষের সহাবস্থান| একদলকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে আরেকদলের যুদ্ধ জয় সম্ভব নয়, তাহলে এতদিনে অনেক সফলতা আসতো, নারী হতো আরও সাহসী, উদ্যমী, নারীর জন্য সমাজ হতো নিরাপদ| কিন্তু তা হয়নি, বরং দিন কে দিন নারীকে আরও পিছিয়ে ফেলার সমস্ত আয়োজন হচ্ছে, নিরাপত্তার ভয়ে নারীরা এখন ভীত হয়ে পড়তে বাধ্য হচ্ছে|

একটি সমাজ উন্নত হতে পারেনা যদি সেই সমাজের অর্ধেক অংশ এখন নিরাপত্তার অভাবে কাজে বের না হয়, স্বাধীন সত্তা নিয়ে কাজ না করতে পারে| তাই রাষ্ট্র যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বলছে, সেই উন্নয়নের জন্য সমাজের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে নিরাপত্তা দিতে হবে, আর সেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একদিকে দরকার রাজনৈতিক দুবৃত্তায়ন হতে সমাজের মুক্তি, রাজনৈতিক বলয়ের ঊর্ধ্বে উঠে প্রশাসনকে এই সব অন্যায়, নির্যাতন, ধর্ষণের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে, এবং ধর্ষণের ক্ষেত্রে আইনের পরিবর্তন আনা |

এই তিনটি বিষয়কে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলেই সমাজ অনেকটাই বদলে যাবে| সমস্যা কেবল নারীর একার নয়, সমাজের, রাষ্ট্রের, সরকারের, পরিবারের| প্রতিটি ঘটনায় সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়, এটা যেমন সত্য তেমনই পরিবার হয় সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত| আর নিপীড়িত নারীর কথা নাই বা বললাম| তাই সকলকেই এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হবে| আসুন, নারী-পুরুষ সকলে ধর্ষণের বিরুদ্ধে এবং একটি সুস্থ স্বাভাবিক সমাজব্যবস্থার লক্ষ্যে এই যুদ্ধে সামিল হই|