শহিদুন্নবী জুয়েল হত্যাকাণ্ড: গভীরে লুকিয়ে ‘রাজনীতি’


এস এম আব্রাহাম লিংকন:
লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী ইউনিয়নে শহিদুন্নবী জুয়েলকে পুড়িয়ে মারার মধ্য দিয়ে দানবীয় শক্তির উত্থান-প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছে। যেখানে জুয়েল নিহত হয়েছেন, সেই এলাকাটিতে স্বাধীনতাবিরোধীদের দৌরাত্ম্যের কথা কারোই অজানা নয়।

সেখান থেকে জামায়াতের জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব ছিল। জোটগত রাজনীতিতে লালমনিরহাট জেলায় যেটা তাদের ভাগের আসন। যদিও এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। কেননা, এই বুড়িমারীতেই ছিল ৬ নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার। পাটগ্রাম ছিল সাবসেক্টর কমান্ডের ঠিকানা। পুরো পাটগ্রাম থানাটি মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অনন্য অবদান রাখে। এখানে চালু হয়েছিল বেসামরিক প্রশাসনের অনেক শাখা-প্রশাখা। মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেই সূতিকাগারটি আজ উগ্র ধর্মীয় দাবানলে পুড়ছে! এ ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়। বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবার অবকাশ রয়েছে।

গুজব ছড়িয়ে এ ধরনের ঘটনা রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়ার সমতুল্য। যারা এ ঘটনার মাস্টারমাইন্ড তারা পবিত্র ধর্মগ্রন্থের অবমাননার বিষয়টিকে পরিকল্পিতভাবে ক্যাপিটালাইজড করে এ হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত করেছে। তাদের উদ্দেশ্য শুধু হত্যাকাণ্ড নয়, ক্ষমতার শক্তির জানান দেয়াও। গত কয়েক বছরে এই মৌলবাদী শক্তির বিনাশ হয়েছে বা মৌলবাদী শক্তির ক্ষমতা লোপ পেয়েছে, যারা এমনটি মনে করেন তাদের জন্য এটি একটি বার্তাও। আসলে এই অপশক্তির ক্ষয় হয়নি, এরা গর্তে লুকিয়ে রয়েছে। আগে প্রকাশ্য ছিল, এখন কৌশলে সবার মাঝে মিশে আছে। তাদের সে চেষ্টার কথা আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্য থেকে আগেই স্পষ্ট হয়েছিল। এ বিষয়টি আরোও পরিষ্কার হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ ডাকসু নির্বাচনের ফলাফলকে বিবেচনায় নিলে। কেননা এর মাধ্যমেই প্রমানিত হয়েছে মৌলবাদী রাজনীতি কোথায় ভর করেছে। সাধারণ ছাত্র পরিষদ বা ছাত্র অধিকার পরিষদ যে নামেই ডাকি, তাদের ভেতরের স্পনসর কিন্তু মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তি।

বুড়িমারীর ঘটনা সম্পর্কে ইতোমধ্যে স্থানীয়রা ঘটনার সূত্রপাতের কারণ সম্পর্কে ভিন্নমত প্রকাশ করছেন। স্বয়ং সেই মসজিদসংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিহত জুয়েল পবিত্র ধর্মগ্রন্থের প্রতি অবমাননাকর কিছু করেননি। যদি তা-ই হয়, তবে ঘটনা এত দূর এগোলো কিভাবে? ঘটনাটি তো সাধারণ চড়-থাপ্পড়ের মাধ্যমেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা না করে সেটিকে পরিকল্পিতভাবে গণপিটুনির আয়োজনের সুযোগ তৈরি করলো কারা? অনেক সময় গণপিটুনির উদ্দেশ্য থাকে টার্গেট ব্যক্তিকে সংঘবদ্ধ আক্রমণের মাধ্যমে খুন করা, যাতে বিচারে আমজনতার কাঁধে দায় চাপিয়ে পরিত্রাণ পাওয়া করা যায়। এতে লক্ষ্যও অর্জন হয়, আবার বিচারের হাত থেকে প্রকৃত অপরাধীকে রেহাইও দেয়া যায়।

বুড়িমারীর হত্যাটি শুধু গণপিটুনির রূপ দেয়া হয়নি, এমনভাবে ক্ষোভকে দেখানো হয়েছে যেখানে মানুষ সেই কথিত ঘৃণিত ব্যক্তিটিকে আগুনে পুড়িয়ে ক্ষোভ মিটিয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধী এবং বিভ্রান্তদের মতে তারা যথার্থ কাজটিই করেছেন। কিন্তু আইন ও ধর্ম কোনোটিই এ ধরনের কাজকে সমর্থন করে না। ধর্ম বা আইন সমর্থন না করলেও তারা এটি করেছে। এখন আমাদের প্রধান দায়িত্ব এ ঘটনার পেছনে যারা তাদের খুঁজে বের করা।

প্রতিটি ঘটনারই একটি প্রতিক্রিয়া থাকে। বুড়িমারীর ঘটনায় সত্যতা থাকলে তার প্রতিক্রিয়াও থাকবে, সেটি স্বাভাবিক। সেটির জন্য প্রতিবাদ হতে পারত, অবমাননাকারীর বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি বা প্রচলিত আইনে মামলা হতে পারত, তাকে পুলিশের কাছে তুলে দেয়া যেত; কিন্তু হত্যার মাস্টারমাইন্ডরা সে পথে এগোয়নি। গণমানুষকে শামিল করে হুজুগ সৃষ্টি করে হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত করেছে তারা। যারা ধর্মের অবমাননার নামে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করল, তারাই আবার একই ধর্মের বিরুদ্ধ রীতিতে পুড়িয়ে শেষকৃত্যও করল! কোনটি ধর্মভিত্তিক হলো? শেষকৃত্য, না হত্যা? আসলে কোনোটিই ধর্ম ও আইনসম্মত ছিল না। যারা এর মাস্টারমাইন্ড, তারা তো বটেই, এমনকি যাদের আমজনতা বলে সম্বোধন করছি, তারাও কিন্তু জানে হত্যা সমর্থনযোগ্য কাজ নয়। এটি না ধর্ম না আইন, কেউই সমর্থন করে না। তারপরও এই পদ্ধতি কেন? এটিও ভাবনায় নিতে হবে।

দশম সংসদ নির্বাচন বাতিলের অযৌক্তিক দাবিতে যে জ্বালাও-পোড়াও হয়েছিল, সেখানে অসংখ্য মানুষকে অগ্নিদগ্ধ করা হয়েছিল। অসংখ্য পরিবহনে পেট্রলবোমা দিয়ে আক্রমণ করা হয়েছিল। সেসব কারা করেছিল, সেটি কমবেশি আমরা সবাই জানি। শহিদুন্নবী জুয়েলকে পুড়িয়ে মারার ঘটনা অন্য সব ঘটনার প্রকৃতির সঙ্গে মেলালে চলবে না। এর পেছনে একটি রাজনৈতিক পরিকল্পনা আছে। যারা একটি ইস্যু সৃষ্টি করে সরকার ও রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করতে সচেষ্ট। ধর্মগ্রন্থের অবমাননার বিষয়টি অসত্য, সেটি এখন পরিষ্কার। যে বক্তব্যকে কেন্দ্র করে এই ঘটনার সৃষ্টি ও রটনা, সেটিই যদি অসত্য হয়, তাহলে বুঝতে অসুবিধা হয় না এটির গভীর রাজনীতি লুকিয়ে থাকা স্বাভাবিক। সেটি স্থানীয় বা জাতীয় দুই ক্ষেত্রেই হতে পারে।

এই হত্যাকাণ্ডের পর প্রশাসন পুলিশ সবাই তৎপর হয়েছে। মামলা হয়েছে, অনেকে গ্রেপ্তারও হয়েছে। গণপিটুনির মামলায় হয়রানি ও বাণিজ্য করার সুযোগ থাকে। বিষয়টি নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে। নতুবা ওই এলাকার বিপুলসংখ্যক মানুষকে মামলার নামে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানো হবে।

একদল লোক কোন ঘটনা ঘটলেই প্রশাসনে রদবদলের দাবি তোলে। বিশেষত যারা মনে করেন বর্তমান প্রশাসন তাদের জুতসই নয়। যারা অবহেলা করেছেন বা অপরাধকে উসকে দিতে চেষ্টা করেছেন বা ঘটনার নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখেননি, নিশ্চয়ই তাদের প্রতি সিদ্ধান্ত হতেই পারে; তবে অপরাধের মূলে যেতে হবে।

’৭০-এর নির্বাচনে তিস্তা নদীর দুই পারের নির্বাচনী আসনগুলোতে ভোটের ফলাফলে জামায়াত দ্বিতীয় শক্তি ছিল। স্বাধীনতার পর এই রংপুর বিভাগ থেকে তারা প্রকাশ্যে কাজ শুরুর উদ্যোগ নেয়। রংপুরে মসজিদের চট পুড়িয়ে কোরআন পুড়িয়ে ফেলার মিথ্যা অভিযোগ তুলে তারা মাঠে নামে। একসময় কারমাইকেল কলেজকে এরাই সাম্প্রদায়িক শক্তির দুর্গ হিসেবে গড়ে তোলে। শাসক দলকে কাজে লাগিয়ে এরাই শিক্ষা ও প্রশাসনে তাদের পছন্দের লোকজনকে নিযুক্ত করে। কারমাইকেল কলেজের অধ্যক্ষের সামনে তার টেবিলে জাতীয় ছাত্রলীগ নেতা আবদুস সবুরের হাত কেটে নিয়েছিল সেই মৌলবাদী শক্তির লোকজন। এর কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি। কলেজ প্রশাসনও কিছু করেনি। জেএমবির তৎপরতার সূচনাকালে এই অঞ্চলে ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল তারা। জেএমবির সামরিক প্রধান মতিন মেহেদী কুড়িগ্রামে থেকেই তার কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। তিনি চৌকস পুলিশ অফিসার চৌধুরী মঞ্জুরুল কবিরের নেতৃত্বে অপারেশনে ধরা পড়ে যাবজ্জীবন কারাভোগ করছেন। হোলি আর্টিজানের কিলার গ্রুপটি কুড়িগ্রামসহ রংপুর, লালমনিরহাট এলাকায় বেশ সরব ছিল। কুড়িগ্রামে তারা খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধা হোসেন আলীকে গলা কেটে হত্যা করে। তারাই রংপুরে জাপানি নাগরিককে হত্যা করে। কুড়িগ্রামে তারা একাধিক অপারেশন পরিচালনা করে। এদের বিরুদ্ধে হত্যা, সন্ত্রাস দমন ও বিস্ফোরক আইনে একাধিক মামলা রয়েছে। এসব গ্রুপের নানা কর্মতৎপরতা এ অঞ্চলে মৌলবাদীদের আগ্রাসী চিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছে। সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর প্রকাশিত শক্তির একটা ছোট্ট পরিসংখ্যান দেয়ার জন্যই এ কথাগুলো বলা হলো। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে জ্বালাও-পোড়াও মামলাগুলোর সিংহভাগই হচ্ছে এই রংপুর বিভাগের বিশেষত নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা জেলার তিস্তা নদীর দুই দিকের এলাকাগুলোর মধ্যে।

সম্প্রতি লালমনিরহাট জেলার পুলিশ সুপার আবিদা সুলতানা নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি হাতীবান্ধায় পুরোনো থানা ভবনটিকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্মারক নিয়ে একটি জাদুঘর করার উদ্যোগ নিয়েছেন। তার দায়িত্বে রাজারবাগে বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরটি দেশে গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিসত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কুড়িগ্রামে এসপি মহিবুল ইসলাম খান পুলিশ লাইনসে একটি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্মারক নিয়ে সংগ্রহশালা গড়ার কাজ শুরু করেছেন। রংপুর বিভাগজুড়ে এসব কাজ স্বাধীনতাবিরোধীরা মোটেই ভাল ভাবে নেয়নি। সংগত কারণে তাদের সরিয়ে দিতে পারলে এই কার্যক্রমগুলো শ্লথ বা ভেস্তে যেতে পারে। কিছুদিন আগে অধস্তনের কাজের ত্রুটির জন্য সাবেক জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনকে কুড়িগ্রাম থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল। তার আকস্মিক প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে কুড়িগ্রাম জেলায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কাজগুলো গতি হারিয়ে ফেলে। এতে লাভ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের। কারণ মুক্তিযুদ্ধ এখনো স্বাধীনতাবিরোধীদের জন্য গলার কাঁটা। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বৃহত্তর রংপুরের বড় বড় গণহত্যাকে নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এই কাজগুলোকেও বাধাগ্রস্ত করতে চলমান প্রশাসনকে ব্যাতিব্যস্ত রাখার কৌশলটিও অমূলক নয়। তাই অতি দ্রুত শহিদুন্নবী জুয়েল হত্যার মাস্টারমাইন্ডদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে হবে।

লেখক: সাবেক রাকসু নেতা, লেখক ও গবেষক


শর্টলিংকঃ